<p>ইসলামী অর্থনীতি এবং এর সব বিধি-বিধান ইসলামের মৌলিক আদর্শ থেকে উৎসারিত। ইসলামী অর্থনীতির উৎসসমূহকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—ক. প্রধান উৎসসমূহ : ১. কোরআন, ২. হাদিস বা সুন্নাহ।</p> <p>খ. সম্পূরক উৎসসমূহ : ১. ইজমা, ২. কিয়াস, ৩. আল-ইসতিহসান, ৪. আল-ইসতিদলাল,  ৫. আল-ইসতিসলাহ, ৬. আল-ইসতিহসাব, ৭. মাসালাহ মুরসালা ও ৮. উরফ।</p> <p>প্রধান উৎস : আল-কোরআন : ইসলামী অর্থনীতির মূল ও প্রধান উৎস আল-কোরআন। কোরআন ইসলামী শরিয়াহর প্রধান উৎস। এটি সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কোরআনে ইসলামী অর্থনীতির মূল বিষয় সুদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন মহান আল্লাহ। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ ব্যবসায়কে বৈধ এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)</p> <p>প্রধান উৎস : আল-হাদিস : মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী, কর্ম ও অনুমোদিত বিষয় হলো সুন্নাহ। সুন্নাহ হাদিস নামেও পরিচিত। মুসলমানরা স্বীকার করেন যে রাসুল (সা.) শুধু মহামানবই ছিলেন না, বরং তিনি এমনভাবে জীবন যাপন করেছেন, যাতে ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সুন্নাহর লিখিত অংশকে হাদিস বলা হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) সুদের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। নবীজি বলেন, ‘সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের দলিল লেখক, হিসাবরক্ষক এবং এর সাক্ষীদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)</p> <p>সম্পূরক উৎসসমূহ : গৌণ বা সম্পূরক উৎস ওহিভিত্তিক নয়। বরং এগুলো ইসলামী ফিকহবিদদের ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, যা ইজতিহাদ নামে পরিচিত। ইজতিহাদের ব্যবহার মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে।</p> <p>সম্পূরক উৎস : ইজমা : ‘ইজমা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ ঐকমত্যে পৌঁছা। কোরআন হাদিসের মৌলিক বিষয়কে সামনে রেখে নতুন কোনো বিষয়ের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছার নাম ইজমা। সুতরাং রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম সমাজে শরিয়াহর কোনো বিধান সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মুজতাহিদদের মধ্যে সম্পাদিত সর্বসম্মত চুক্তির নাম ইজমা। উদাহরণস্বরূপ ‘নবী করিম (সা.) আমল অনুসরণে স্থিরীকৃত ইজমার ভিত্তিতে বাই আল-মুজাইয়াদাহ বৈধ বলে স্বীকৃত। বাই আল-মুজাইয়াদাহ হলো পণ্যের বিক্রেতা কর্তৃক ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ, যা ক্রেতা প্রতিযোগিতামূলক সর্বোচ্চ মূল্যে ক্রয় করবে। যে ক্রেতা সর্বোচ্চ মূল্য পরিশোধ করতে রাজি হয়, বিক্রেতা তার কাছে পণ্য হস্তান্তরের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।’</p> <p>সম্পূরক উৎস : কিয়াস : ইসলামী অর্থনীতির চতুর্থ উৎস কিয়াস। কিয়াস এর আভিধানিক অর্থ অনুমান করা, পরিমাপ করা, তুলনা করা, সামঞ্জস্য করা। ইমাম গাজালির (১০৫৫-১১১১) মতে, ‘কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে অন্য কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করে সামঞ্জস্যপূর্ণকরণের পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের ইতিবাচক বা নেতিবাচক একই বিধান বা ফলাফল সাব্যস্ত করাকে ‘কিয়াস’ বলে। কিয়াসের একটি উদাহরণ হিসেবে এখানে বলা যেতে পারে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্যনির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থেকো—যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা : আল-মায়েদা, আয়াত : ৯০)</p> <p>এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, অন্যান্য খারাপ জিনিসের মধ্যে জুয়া মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এটি ইসলামী অর্থনীতিতে নিষিদ্ধ। কিয়াস প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈধ বিষয় ও নতুন সমস্যার মধ্যে সাদৃশ্য সূত্র খুঁজে পাওয়া জরুরি। যখন মূল বিধান ও সম্পৃক্ত বিষয়ে মিল অর্থাৎ একই ধরনের ইল্লত বা সদৃশ কারণ পাওয়া যায় তখন মূল বিষয়ের বিধানের ভিত্তিতে সম্পৃক্ত বিষয়ের সমাধান নির্ণীত হয়। এভাবে নতুন নির্ণীত ফায়সালা মূল বিধানের সমপর্যায়ভুক্ত গণ্য হয়। যেমন—মদপান হারাম হওয়ার সূত্রে অন্যান্য নেশাদ্রব্য গ্রহণকে কিয়াসের মাধ্যমে হারাম করা হয়েছে। বিশ্লেষণটি নিম্নরূপ : মূল বিষয় : মদপান। সম্পৃক্ত বিষয় : চেতনানাশক বস্তু গ্রহণ। ইল্লত বা সদৃশ : নেশা। আইন : হারাম বা নিষিদ্ধ।</p> <p>সম্পূরক উৎস : আল-ইসতিহসান : ‘ইসতিহসান’ হচ্ছে দলিলভিত্তিক বিদ্যমান বিধানকে স্থগিত করে অধিকতর বলিষ্ঠ ও যুক্তিযুক্ত বিকল্প বিধান নির্ধারণ করা, যা একই সঙ্গে দলিলভিত্তিক এবং ন্যায়বিচার ও জনস্বার্থে অপেক্ষাকৃত উত্কৃষ্ট। ইসতিহসান হচ্ছে আইনগত অগ্রাধিকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘বিক্রয়চুক্তির অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে বিক্রয়চুক্তি সম্পাদনের সময় বিক্রয়পণ্যের অস্তিত্ব থাকতে হবে। তবে এই নীতির ব্যতিক্রমও হতে পারে। এই ব্যতিক্রম ‘বাই-ইসতিসনা’ ও ‘বাই-সালাম’ চুক্তির বেলায় প্রযোজ্য। ক্লাসিকাল ফকিহদের কর্তৃক নিরূপিত এরূপ বিধান হলো ‘ইসতিহসান’ বা চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তার নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।’</p> <p>সম্পূরক উৎস : আল-ইসতিদলাল : ‘ইসতিদলাল’ ইসলামী অর্থনীতির জ্ঞানের অন্যতম সম্পূরক উৎস। ইসলামী আইনে যুক্তিনির্ণীত সিদ্ধান্তকে ‘ইসতিদলাল’ বলে। অন্য কথায় কোনো একটি বিষয় হতে যুক্তি-তর্কের সাহায্যে অন্য একটি অনুরূপ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ইসতিদলাল বলে। ইসতিদলালের মাধ্যমে এক নীতি থেকে যুক্তি-তর্কের সাহায্যে অন্য নীতির প্রবর্তন করা হয়। </p> <p>সম্পূরক উৎস : আল-ইসতিহসাব : ‘ইসতিহসাব’ অর্থ পূর্বের বিধান-হুকুম বহাল রাখা, যতক্ষণ না নির্দিষ্ট বিধান-হুকুম পরিবর্তনের অনুকূলে কোনো দলিল বা সাক্ষ্য পাওয়া যায়। ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের অন্যতম উৎস ইসতিহসাব। এটি পূর্বে প্রচলিত একটি আইনগত বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার সংগত দাবি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ হিসেবে নেওয়া অর্থ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে, যতক্ষণ না তার ঋণ থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো অকাট্য প্রমাণ বা সাক্ষ্য পেশ করা সম্ভব হবে। এভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকেই ফিকহ বিজ্ঞানে বলা হয় ইসতিহসাব।  </p> <p>সম্পূরক উৎস : আল-ইসতিসলাহ : ‘ইসতিসলাহ’ অর্থ জনকল্যাণ নীতি বা জনহিতনীতি। এটি ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের অন্যতম উৎস। ইসতিসলাহ তথা জনকল্যাণ হচ্ছে এমন একটি পথের অনুসরণ, যা জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ আনয়ন করবে। অতএব যদি কোনো বিধি জনসাধারণের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। </p> <p>সম্পূরক উৎস : মাসলাহা : ‘মাসলাহা’ অর্থ জনকল্যাণ। যেসব বিষয়ে ইসলামী আইনের মূল উৎসসমূহ অর্থাৎ কোরআন ও হাদিসে স্পষ্ট এবং নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই সেসব বিষয়ে জনস্বার্থে প্রণীত বিধানকে মাসলাহা বলা হয়। ইসলামী শরিয়াহতে শরিয়াহর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও যথাযথ যে বিধান ধর্ম, জীবন, বিবেক, বুদ্ধি, বংশধারা এবং সম্পদ সুরক্ষার জন্য প্রণীত সেসব বিধান মাসলাহা বলে গণ্য। উদাহরণস্বরূপ : বাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত ক্রয়-বিক্রয় দলিলের আবশ্যকীয়তা অথবা উৎপাদনকারী কর্তৃক বিক্রীত পণ্যের ব্যাপারে ওয়ারেন্টি বা মেয়াদি নিশ্চয়তা প্রদান প্রভৃতি মাসলাহা, যা ইসলামী আইনের সাধারণ উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যদিও এসব বিষয়ে কোরআন-হাদিসে সরাসরি কোনো বর্ণনা নেই।</p> <p>সম্পূরক উৎস : উরফ : ‘উরফ’ অর্থ দেশাচার বা প্রচলিত প্রথা বা প্রচলন। এটি প্রচলিত ভালো রেওয়াজ বা নিয়ম। একটি সমাজে বেশির ভাগ মানুষের কথা বা কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রীতিকে ‘উরফ’ বলা হয়। এটি হচ্ছে সাধারণ চর্চা, যা শরিয়াহর বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং সামষ্টিকভাবে গৃহীত ও প্রয়োগযোগ্য হিসেবে বিধান বলে গণ্য। ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের অনেক সিদ্ধান্ত, বিধি-বিধান, কৌশল তদানীন্তন আরবের প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। মহানবী (সা.)-এর আবির্ভাবকালে আরব দেশে অনেক ধরনের প্রথা ও রীতিনীতি প্রচলিত ছিল। ওই সব প্রথা বা রীতিনীতি কোরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট অনুজ্ঞা বা আদেশ দ্বারা রহিত করা হয়নি। মহানবী (সা.) তাঁর নীরবতার দ্বারা সেগুলোকে অনুমোদন করেছেন বলে ধরে নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, মুদারাবা, মুশারাকা, মুজারায়া, মুশাকাত ইত্যাদি ইসলামপূর্ব আরবদেশে প্রচলিত ছিল। এসব ইসলাম কায়েমের পরও অব্যাহত রাখা হয়।</p> <p>লেখক : সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. বর্তমানে হেড অব বিজনেস অ্যান্ড শরিআহ সেক্রেটারিয়েট, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লি.</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>