‘দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে যেখানে পোশাক পরিহিত সশস্ত্র পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে, সেখানে নিরস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী পুলিশের সহযোগী হিসেবে কিভাবে কাজ করবে? আর আটকের সময় হামলা চালালে কে সামাল দেবে! এভাবে তো দায়িত্ব নিতে গেলে বিপদে পড়তে হবে।’ রাজধানীর উত্তরার শপিং মল মাসকট প্লাজার নিরাপত্তাকর্মীদের প্রধান মাজেদ মিয়া গত সোমবার কালের কণ্ঠকে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী রাজধানীতে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের ‘অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স’ বা সহায়ক পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ডিএমপি কমিশনারের ওই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় মাজেদ মিয়া এসব কথা বলেন।
নিরাপত্তা বিষয়ে অভিজ্ঞ মাজেদ মিয়া বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে শপিং মলগুলোয় অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স নিয়োগ দেওয়ার কথা শুনেছি। তবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত পুলিশের কেউ আমাদের কাছে আসেনি। আমাদের কিছু বলাও হয়নি।’
মাসকট গ্রুপের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শপিং মলের সিকিউরিটি ইনচার্জ আমি।
সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর এই পেশায় যুক্ত হয়েছি। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কাউকে গ্রেপ্তার করা সহজ কাজ নয়। কেউ অপরাধ করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। মূলত কাজটি পুলিশের। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া আসামি গ্রেপ্তার করা সহজ নয়। হাতিয়ার ছাড়া, অস্ত্র ছাড়া আসামিদের কিভাবে গ্রেপ্তার সম্ভব? ফলে এ দায়িত্ব বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীরা পেলে এর অপব্যবহার হতে পারে।’
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী খান গত ৮ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে অক্সিলিয়ারি ফোর্স নিয়োগের কথা জানান। রমজান ও ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেন তিনি। সে অনুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন শপিং মলের বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের তালিকা করার কথা।
তাঁদের সহায়ক পুলিশ হিসেবে হাতে ‘সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা’ লেখা ব্যান্ড দেওয়ার কথা। তাঁরা অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করতে পাারবেন।
মাঠে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ আর এই বাহিনীর কাজে কী কী পার্থক্য রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই অক্সিলিয়ারি ফোর্সের পুলিশ বাহিনীর মতো প্রশিক্ষণ, দক্ষতা কিংবা দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো থাকবে না।’
তবে পুলিশ বাহিনীর বাইরে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ যখন পুলিশের ক্ষমতা পাবেন, তাঁর ক্ষমতার ব্যবহার কতটা স্বচ্ছ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
রাজধানীর আটটি ক্রাইম বিভাগের পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ডিএমপির ৪৮ থানা এলাকায় অক্সিলিয়ারি ফোর্স নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই বাহিনীর সদস্যদের বেতন দেওয়া হবে না, তবে পুলিশের মতো গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন তাঁরা।
শিগগিরই মাঠে তাঁদের দেখা যেতে পারে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী খান গত ৮ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঈদের আগে বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অক্সিলিয়ারি ফোর্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ১০ ধারা অনুযায়ী কমিশনার নিজ ক্ষমতাবলে এই নিয়োগ দেবেন। এটা হবে সাময়িক।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ যেমন দায়িত্ব পালন করে, সহযোগী ফোর্স ঠিক একইভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, আটক বা নিয়মিত টহলের মতো দায়িত্বগুলো পালন করতে পারবে। তবে তারা কোনো ধরনের ইনভেস্টিগেশন বা তদন্ত পরিচালনা করতে পারবে না।’
ডিএমপি কমিশনারের এমন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর কয়েকটি মার্কেটে গিয়ে দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন মত। মিরপুর ১১ নম্বরে মোহাম্মদিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. বিপ্লব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের মার্কেট সমিতির নেতারা তাঁদের পরিচিতদের নিয়োগ দিয়ে নিরাপত্তার কাজ করাচ্ছেন। তবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা না থাকায় তারা অনেকটা পাহারাদার হিসেবেই কাজ করছে। এখানে তাদের কিভাবে অক্সিলিয়ারি পুলিশ হিসেবে ব্যবহার করা হবে তা বুঝতে পারছি না। এ কাজের জন্য তো ন্যূনতম প্রশিক্ষণ তাদের নেই। অস্ত্র বা গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও তারা অবগত নয়। পুলিশের সহযোগী হয়ে তাহলে কিভাবে তাদের কাজ করা সম্ভব?’ উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরে একটি সরকারি আবাসিক কোয়ার্টারের নিরাপত্তাকর্মী মো. জিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে বাসার সামনে সব সময় কিশোর গ্যাংয়ের উত্পাত লেগে থাকে। পাশেই পুলিশের আবাসিক কোয়ার্টার ও পুলিশ বক্স। তারাই জনসাধারণের নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। পোশাক পরিহিত পুলিশকেও এই কিশোর অপরাধীরা তোয়াক্কা করছে না। সেখানে নিরস্ত্র সাধারণ নিরাপত্তাকর্মী কিভাবে এ দায়িত্ব পালন করবে তা বুঝে আসছে না।’
বারিধারা আবাসিক এলাকার নিরাপত্তাকর্মী মহসিন উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশের যে পোশাক আছে, সেটি তো আমাদের নেই। আমাদের মতো সিভিলদের কেন সন্ত্রাসীরা ভয় করবে?’
একইভাবে রাজধানীর নিউমার্কেট, মিরপুর এবং উত্তরার একাধিক শপিং মল, মার্কেট ও আবাসিক এলাকায় দায়িত্বরত বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বললে একই ধরনের মতামত দেন তাঁরা। তাঁরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ উদ্যোগ সফল করা কঠিন হবে। জানতে চাইলে রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আমাদের এলাকার শপিং মলগুলোর নিরাপত্তার জন্য বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের তালিকা করে ডিএমপি সদর দপ্তরে জমা দিয়েছি। সেই তালিকা ধরে বেসরকারি সহায়ক ফোর্স নিয়োগ দেওয়া হবে।’