দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধান উৎপাদনের ওপর ব্যাপক নির্ভরশীলতা রয়েছে। মোট চাষযোগ্য জমির ৭৮ শতাংশই ধান চাষের আওতায়। ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধানের উৎপাদন বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ লক্ষ্যে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
ধানবিজ্ঞানীদের মতে, উৎপাদন বাড়াতে অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনা জরুরি। এমনকি যেসব জমি আবাদের উপযোগী বলে আগে বিবেচনা করা হয়নি, সেগুলোও চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮৮ লাখ ১৭ হাজার ৯৩৫ হেক্টর। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রায় চার লাখ ৩১ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক পরামর্শক মইন উস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধান উৎপাদন বাড়াতে শুধু আবাদযোগ্য অনাবাদি জমিই নয়, এমন জমিও আবাদের আওতায় আনতে হবে, যেগুলো আগে চাষের কথা চিন্তাও করা হয়নি। আমরা এমন জমি চিহ্নিত করেছি, যা এখনো কোনো কাজে ব্যবহার করা হয়নি। এসব জমিতে কৃষিকাজ শুরু করলে কৃষকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।’ তিনি জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনা সম্ভব। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সাফল্যও পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ১৭ কোটিরও বেশি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজ্ঞানী, কৃষি প্রশাসন ও কৃষকরা নিরলসভাবে কাজ করছেন। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের তিনটি দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির মধ্যে একটি হবে বাংলাদেশ। ধান খাতকেও এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বর্তমান ভূমি ব্যবহারের অবস্থা ও ধান চাষের উপযুক্ততা বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শের মাধ্যমে পাঁচটি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব এলাকার অনাবাদি ও পতিত জমি ব্যবহার করে পরিকল্পিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৮.৩ লাখ টন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১০.৬ লাখ টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদন সম্ভব হবে।
এলাকা-১-এর মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল। এই এলাকার প্রায় ২.৬ লাখ হেক্টর জমিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বোরো ধান চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ধানের (চাল) উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ৩.৬৯ টন।
এলাকা-২-এর মধ্যে রয়েছে উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশ, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল। উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের পতিত জমি, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ১.৩ লাখ হেক্টর জমিকে আউশ ও বোরো ধানের অধীনে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
এলাকা-৩-এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম ও বৃহত্তর যশোর অঞ্চল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ত অঞ্চলের একটি অংশ ও বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১.৩ লাখ হেক্টর জমি বোরো ধান চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এই পরিমাণ ৩.১ লাখ হেক্টরে উন্নীত করা সম্ভব।
এলাকা-৪-এর মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় চরাঞ্চল, বিশেষ করে বৃহত্তর বরিশাল ও নোয়াখালী জেলা। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল ও নোয়াখালী জেলার উপকূলীয় চর এলাকায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০ হাজার হেক্টর এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দুই লাখ হেক্টর জমি আমন ধানের অধীনে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
এলাকা-৫-এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা, বিশেষ করে কাপ্তাই লেক সংলগ্ন অঞ্চল। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে, বিশেষ করে কাপ্তাই লেক সংলগ্ন এলাকায় বোরো ধান চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেচ সুবিধার অভাব এটি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা। এই অঞ্চলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার হেক্টর এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৭০ হাজার হেক্টর পতিত জমিকে ধান চাষের আওতায় আনার সম্ভাবনা রয়েছে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কর্মকার বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি, যেসব অনাবাদি জমি রয়েছে, সেগুলো আবাদের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। তবে মাঠ পর্যায়ে তদারকি বাড়াতে হবে।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।