রাজধানীসহ সারা দেশে কিউলেক্স মশার উপদ্রব এখন চরম পর্যায়ে। সিটি করপোরেশন মাঝেমধ্যে মশা মারার নানা তোড়জোড় দেখালেও তা কাজে আসেনি। উল্টো দাপট আরো কয়েক গুণ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কীটতত্ত্ববিদরা ভরসা দিচ্ছেন, বৈশাখ মাস থেকে ঝড় ও বৃষ্টিপাতের কারণে মশার উপদ্রব কমবে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে মশার লার্ভার ঘনত্ব এবং উড়ন্ত মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। ঢাকাসহ সারা দেশের অবস্থা প্রায় একই। কয়েক মাস আগে ঢাকায় মশার লার্ভার ঘনত্ব প্রতি ডিপে (মশার ঘনত্ব পরিমাপের ফাঁদ) গড়ে ১২ থেকে ১৭ ছিল, কিন্তু এখন তা ৮৭-রও বেশি। এ ছাড়া উড়ন্ত মশার ঘনত্ব প্রতি মিনিটে গড়ে ২৫ থেকে বেড়ে এখন ৩০০-রও বেশি হয়ে গেছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, এপ্রিলে ঝড়বৃষ্টিতে কিউলেক্স মশা প্রাকৃতিকভাবেই কমবে। এরপর কিছুদিন মশা কম থাকবে। জুন মাসে গিয়ে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা বাড়তে থাকবে।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, মশার ঘনত্বের এই দ্রুত বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ মশার প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল এবং খাল পরিষ্কার না করে লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করায় তা কোনো কাজে আসেনি।
রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের চা-দোকানি সুলতান বলেন, ‘দোকানে সারাক্ষণ কয়েল জ্বালিয়ে রাখি, কিন্তু কাজ হয় না। রাতে বাসায়ও মশার উৎপাতে টেকা যাচ্ছে না। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে দেখেন, মানুষ চা খেতে খেতে অন্য কথা রেখে মশার আলাপ করে।
’ বনানী এলাকার বাসিন্দা রকিব হোসেন বলেন, ‘স্থির হয়ে কোথাও বসা বা কিছুই করা যায় না। মশা কামড়াতেই থাকে। আগের চেয়ে মশার উৎপাত কয়েক গুণ বেড়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে মাঝেমধ্যে কীটনাশক ছিটাতে আসে। এতেও মশা কমে না।’
গত কয়েক দিন বাংলামোটর, হাতিরঝিল, ধানমণ্ডি, আগারগাঁও, মিরপুর, বনানী ও উত্তরা ঘুরে বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনরাত সব সময়ই মশারি টানিয়ে নয়তো কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। সিটি করপোরেশনের ছিটানো মশার ওষুধের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক না হওয়ায় মশা বাড়ছে। শহরের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার প্রধান দায়িত্ব হলো সরকার ও কর্তৃপক্ষের। দ্বিতীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ও তৃতীয় পর্যায়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক। আমরা শুধু ব্যক্তি ও পরিবারের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা একটা সমন্বিত বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কখনো সম্ভব নয়। শহরকে যদি আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না করি মশা, তেলাপোকা, ইঁদুর এ ধরনের কীটপতঙ্গ বাড়বে।’
দুই করপোরেশন কী বলছে : মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নিয়মিত ক্রাশ প্রোগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করা হলেও এটি তেমন কাজে আসছে না। কারণ এ শহরে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল ও খালে পানির প্রবাহ নেই। এসব স্থানে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। এতে পানির ঘনত্ব বেড়ে মশার প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে অনেক ধরনের কমিটি হয়েছে। কারিগরি কমিটি, স্পেশাল টাস্কফোর্স কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটি, ওয়ার্ড লেভেল কমিটি, এখন আবার নতুন কীটনাশক গুণাগুণ যাচাইয়ের জন্য কমিটি। এসব কমিটির বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন, আমরা সেগুলো মেনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দিন শেষে মশা কমছে না। কারণ একটি অপরিচ্ছন্ন শহরের কোথাও পানির প্রবাহ নেই।’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. নিশাত পারভীন বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। নিয়মিত ক্রাশ প্রোগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ চলমান আছে। এর সঙ্গে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। আশা করি সামনে মশার উপদ্রব কমে আসবে।’