২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বীজ বপন

  • মো. জাহিদ হোসেন
শেয়ার
২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বীজ বপন

যদি কোনো জাতির নিজস্ব সত্তাকে স্থায়ীভাবে বিলীন করতে হয়, তাহলে আঘাত করতে হয় তার সংস্কৃতিতে। হয়তো সেই অভিলাষ চরিতার্থ করতেই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গেই শাসকচক্র পূর্ব বাংলার সংস্কৃতির মূলভিত্তি, ভাষার ওপর করে কুঠারাঘাত। এরই পরিক্রমায় সৃষ্টি হয় এক অমর দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, যার ইতিহাস কষ্টের হলেও বাংলার ঐতিহ্যে দান করেছে গর্বিত অধ্যায়।

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ফজলুল হক তাঁর বক্তৃতায় প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন।

মূলত সেখানেই ফজলুল হকের বক্তব্যের পর পাঞ্জাববাসী তাঁকে শের-ই-বঙ্গাল বা শেরেবাংলা উপাধিতে ভূষিত করে। লাহোর প্রস্তাবটি ছিল যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাগুলোর মতো যেসব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ (স্টেটস) গঠন করতে হবে, যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলো হবে স্বশাসিত ও সার্বভৌম।

১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে একটি মৌলিক বিষয় হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৬ সালে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার সময় এই প্রস্তাবকে সামান্য পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা হয়।

এখানে স্টেটস শব্দটিকে একবচন শব্দ স্টেট-এ পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তন মূল লাহোর প্রস্তাবের মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলা ও আসাম নিয়ে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সমন্বয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা মূলত একটি রাষ্ট্র, পাকিস্তানেরই নামান্তর। কৌশলে সেদিন বহুবচনকে একবচনে রূপান্তর না করলে হয়তো বাংলাদেশের জন্ম আরো ২৩ বছর আগেই হতে পারত।

২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বীজ বপন১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত নামে ধর্মভিত্তিক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় এই অঞ্চলে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই বাংলা যেমন পরাধীন ছিল ব্রিটিশ কলোনির কাছে, ঠিক একইভাবে আবারও পরাধীনতার শিকল নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের দ্বারা। প্রথমেই তারা আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু করে এই অঞ্চলের ভাষাকে। মূলত পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সৃষ্টি যখন সুনিশ্চিত, তখন ভাষা নিয়ে এই বিতর্ক আরো ঘনীভূত হয়।

মে মাসে চৌধুরী খলীকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। এর বিরুদ্ধে শুরু হয় ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহাম্মাদ এনামুল হকসহ এই অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ।

১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। ওই সংগঠনের সদস্যরা বাংলাকে শিক্ষা ও আইন-আদালতের বাহন করার প্রস্তাব করেন। ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হলে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। সেই মাসেই গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এরপর ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে এর সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। সেটি অগ্রাহ্য হয়।

এরপর ১৯ মার্চে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ২৪ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তিনি অনুরূপ ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ নেয়। এর বিরুদ্ধেও পূর্ব বাংলার জনগণ তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানায়। 

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারিতে নতুনভাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিক্যালের দিক থেকে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকে। পুলিশ প্রথমে লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলেও পরবর্তী সময়ে গুলিবর্ষণ করে। শহীদ হন বরকত, জব্বার, রফিকসহ আরো অনেকেই। প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি শোকযাত্রা বের করা হয়। সেখানে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান।

পরের দিন শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ভেঙে ফেলে। শহীদ মিনার ভেঙে ফেললেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে যে চেতনা জাগ্রত হয়, তা ছিল অমর। ভাষার দাবিতে করা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতি উপলব্ধি করে যে তাদের রয়েছে একটি পৃথক সত্তা, নিজস্ব সংস্কৃতি। তারা পাকিস্তানি নয়, তারা বরং একটি স্বতন্ত্র জাতি। আর এই অনুপ্রেরণার কাছে পরাস্ত হয়েই পাকিস্তানি শাসকরা বাধ্য হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে।

মূলত এই আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস পায়। আর ঐক্যবদ্ধ মানসিকতাই তাদের মাঝে জাতীয় সংহতির চরম সঞ্চার ঘটায়। তারা বুঝতে পারে যে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে আবদ্ধ থেকে হাজার মাইল দূরের এই সম্পর্ক অব্যাহত রাখা কঠিন। এই আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনে এক হওয়ার অনুভূতি সম্ভবত আর জাগ্রত হবে না। বাঙালি জাতির চেতনা ও একতার চরম বিস্ফোরণ গড়ায় মুক্তিযুদ্ধে। আর সেখানেও জীবন দিয়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। একটি পরাধীন ও নিষ্পেষিত জাতি পায় একটি স্বাধীন দেশ। এর পশ্চাতেও রয়েছে একুশের চেতনা।

আসলে ভাষার জন্য যে কেবল বাঙালিরাই জীবন দিয়েছে, এমনটি নয়। আরো অনেক জাতিই ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৬৫ সালে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করলে মাদ্রাজের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মানুষ রাস্তায় নেমে আসে দলে দলে। প্রায় দুই মাস ধরে দাঙ্গা হয় দক্ষিণে, বিশেষ করে মাদ্রাজে। শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। সারা দক্ষিণ ভারত, বিশেষ করে তামিলনাড়ু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদে আত্মাহুতির ঘটনাও ঘটে। পরবর্তী সময়ে সরকার তার একপেশে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে সেই প্রদেশে কংগ্রেসের হয় ভরাডুবি।

দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন ট্রান্সভাল প্রদেশে আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ আফ্রিকানার ভাষায় (দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত শ্বেতাঙ্গ ডাচদের জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণ) শিক্ষাদান স্কুলে বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। তারা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যাবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা ইংরেজিতে শিক্ষা নিতে বেশি আগ্রহী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়। এ ঘটনাকে বলা হয় সুয়েটো অভ্যুত্থান। তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার নির্বিচারে গুলি করে শতাধিক শিক্ষার্থীকে হত্যা করে। এই ট্র্যাজেডির দিনটিকে বলা হয় ডে অব চাইল্ড

যুক্তরাষ্ট্রে অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা বিলীন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সেই ভাষা রক্ষার দাবিতে আন্দোলন ও জীবন দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র আদি ভাষা রক্ষায় একটি আইন প্রণয়ন করে।

বাঙালির গর্বিত সেই ইতিহাসে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, যখন ইউনেসকো বাংলাদেশের শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাঙালির সেই ভাষা দিবসকে আজ সমগ্র বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে, যা সব বাংলাদেশিকে করছে গর্বিত। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাঙালির যত ক্রান্তিলগ্ন এসেছে, সব ক্ষেত্রেই সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছে এই জাতির ছাত্র ও তরুণ সমাজ। তাই তাদের অর্জনের গর্বটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। একইভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে সেই তরুণ ছাত্রসমাজকে। তাহলেই বাংলাদেশের অবস্থান একদিন দেখা যাবে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়।

  

লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

বরিশাল ক্যাডেট কলেজ

ahidbd462@gmail.com

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ফুটবলে ভারত-বাংলাদেশ মহারণ আজ

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
ফুটবলে ভারত-বাংলাদেশ মহারণ আজ
হামজা চৌধুরী

ভারতের বিপক্ষে শিলংয়ের জওয়াহেরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে আজ (২৫ মার্চ) এএফসি এশিয়া কাপ যোগ্যতা মানের খেলা হবে। এই খেলা ঘিরে যে রোমাঞ্চ, স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা, উন্মাদনার জন্ম হয়েছে, অতীতে কখনো কোনো একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ ঘিরে এত বেশি আলোচনা-উত্তেজনা দেখতে পাইনি। মিডিয়া দিনের পর দিন দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে এই ম্যাচটি ঘিরে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের খেলোয়াড় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হামজা চৌধুরীর অভিষেক হবে ফুটবলে ভারত-বাংলাদেশ মহারণ আজবাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ভারতের বিপক্ষে।

এর আগে প্রবাসী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং নাগরিকত্ব নিয়ে যাঁরা বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন, তাঁদের তুলনায় হামজা চৌধুরী অনেক উঁচুমানের খেলোয়াড়, এটি বাস্তবতা। বিরাট জনগোষ্ঠী মনে করছে, গত পাঁচ দশকের মধ্যে জাতীয় দলে হামজা চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তি সেরা এবং কার্যকর। ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ এখন ১৮৫-তে।

এদিকে দেশের প্রয়োজনে অবসরে যাওয়া সুনীল ছেত্রীকে ভারতের ফুটবল ফেডারেশন জাতীয় দলে ফিরিয়ে এনেছে।

তারা অনুভব করেছে, বাংলাদেশের বিপক্ষে মাঠের লড়াইয়ে এই স্ট্রাইকারের ভীষণ প্রয়োজন আছে। সুনীল তাঁর দেশকে গত কয়েক বছর দারুণভাবে সার্ভ করেছেন, যখনই বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেছেন মাথাব্যথার কারণ হয়েছেন। সুনীল যে অবসরে যাওয়া সত্ত্বেও খেলার ছন্দ হারাননিতার প্রমাণ দিয়েছেন মালদ্বীপের বিপক্ষে প্র্যাকটিস ম্যাচে একটি গোল করে। এদিকে হামজা চৌধুরীর সুযোগ হয়নি দলে যোগ দেওয়ার পর ম্যাচ খেলার।
খেলতে পারলে ভালো হতো। ফুটবল দলীয় খেলা। দলের মধ্যে বোঝাপড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কোচ মারুফ বলেছেন, হামজা বক্স টু বক্স খেলতে পারে। হামজা বল পায়ে যখন যেখানে যেতে চায় যেতে দাও, অন্যদের উচিত তাকে মার্ক করা।
হামজাকে জায়গামতো বল দেওয়া, হামজা কখন কোথায় বল ছাড়বে, সেটি যেন সঙ্গের খেলোয়াড়রা বুঝতে পারে, ভুল যেন না হয়।

হামজা চৌধুরী ইতিবাচক খেলোয়াড়। তিনি জানেন দেশের জাতীয় দলে তাঁর কী ভূমিকা হওয়া উচিত। তাঁর বড় প্রয়োজন সতীর্থ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সহযোগিতা এবং তাঁদের বোঝা। একা খেলে তো হামজা দলকে জেতাতে পারবেন নাঅন্যদের সহযোগিতা লাগবে।

হামজার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ দলের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। খেলোয়াড়রা অনুপ্রাণিত এবং উজ্জীবিত। তাঁরা মাঠে সামর্থ্য উজাড় করে লড়বেন দেশের জন্য। ভারতের বিপক্ষে যদি দল জেতে, তাহলে কি ফুটবলের গতিপথ বদলে যাবে রাতারাতি? তা নয়। ফুটবল আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে, উজ্জীবিত হবে। গতিপথ বদলাতে হলে নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন রূপরেখা নির্ণয় করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন ফুটবলে ফিফা অনুমোদিত সংস্কার সাধন। ফুটবলে প্রয়োজন দ্রুত সমস্যার সমাধান এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, ঐকমত্য পোষণের ভিত্তিতে। প্রবাসী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং নাগরিকত্ব নিয়ে খেলোয়াড়দের খেলা নিয়ে কিছু কথা উঠেছে। এটি যাঁরা বলছেন, তাঁরা অজ্ঞতা এবং সচেতনতার অভাবের জন্য এটি বলছেন। শুধু বলব, দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশের ফুটবলে এই প্র্যাকটিস আছে। আর এটি ফিফা কর্তৃক অনুমোদিত। এই প্র্যাকটিস দেশের ফুটবলকে ধ্বংস করে না বরং সমৃদ্ধ করে, জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে।

ইতালি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ খেলোয়াড় ফাহমিদুল সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশ স্কোয়াডে যোগ দিয়েছিলেন। মিডিয়ায় দেখেছি, তাঁকে নিয়ে অনেক কথাই লেখা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি হবেন দলের তুরুপের তাস ভারতের বিপক্ষে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাঁকে নিয়ে দারুণভাবে মেতেছে। সৌদিতে ক্যাম্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে না এসে ইতালিতে ফিরে গেছেন। এই বিষয়টি নিয়েও প্রচুর আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন ষড়যন্ত্র। সিন্ডিকেটের খেলা। মিছিল বের করা হয়েছে। বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে। অমুকের পদত্যাগ, তমুকের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। অবিবেচকের মতো ফুটবলে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। তিনি জানেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। সরকারের হস্তক্ষেপ ফিফা কখনো বরদাশত করে না। পাবলিককে খুশি করার জন্য বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় ক্রীড়া উপদেষ্টা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির সঙ্গে বসেছেন। শেষ পর্যন্ত জানা গেছে, ফাহমিদুল বাংলাদেশের দলের জন্য এখনো তৈরি নন। ভবিষ্যতে অবশ্যই সুযোগ আছে।

হামজা চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের ফুটবলে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এটি জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি এবং বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসানের কাছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে ভক্তদের অভিযোগের অন্ত নেই। শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গন নয়, বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল নিয়েও রয়েছে মানুষের বিস্তর অভিযোগ। ফুটবলের মান পড়ে গেছে কিংবা ঘরোয়া ফুটবলে দর্শক নেই, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অন্যতম শীর্ষকর্তা হিসেবে অভিযোগটি আমাকেও শুনতে হয় প্রায়ই। বরাবরের মতো আমার উত্তর, বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে দর্শকশূন্যতার জন্য ক্লাবগুলোও অনেকাংশে দায়ী। মাঠে দর্শক আসে ক্লাবের টানে। প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে। বাংলাদেশের ক্লাবগুলো নিজেদের সমর্থক ধরে রাখা বা মাঠে আনতে ব্যর্থ। একই সঙ্গে দর্শকদের সামনে হাজির করতে পারেনি কোনো ফুটবল আইকন, যাদের খেলা দেখতে ভক্তরা মাঠে আসতে উৎসাহ বোধ করবে। খেলোয়াড় বা তারকা তৈরির মূল কাজটি তো ক্লাবেরই কাজ। বাংলাদেশের ফুটবলে তারকা খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। কাজী সালাউদ্দিন, চুন্নু, এনায়েত, কায়সার হামিদ, মুন্না, আসলাম আর সাব্বিরদের খেলা দেখার জন্য আলাদা দর্শক ছিল। তারা মাঠে যেত প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে। বর্তমানে কোনো বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে আলাদাভাবে কোনো দর্শক মাঠে আসে কি না আমার জানা নেই। ফুটবলে প্রিয় ক্লাব তো থাকবেই, কিন্তু বিশেষ খেলোয়াড়দের ভক্তরাও কম গুরুত্বপূর্ণ না। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালডোরা ইউরোপ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সৌদি আরবে পাড়ি জমালে সেই সব দেশের ফুটবল ক্লাব আর লীগ জাতে উঠে যায়। দর্শক বেড়ে যায় রাতারাতি। আসলে ক্লাব ফুটবল বলেন কিংবা জাতীয় দল, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে আসার জন্য প্রয়োজন তারকা খেলোয়াড়ের উপস্থিতি, যিনি নিজ দেশ কিংবা ক্লাবের জন্য বড় বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের জন্য কাজটি করতে পারেন হামজা চৌধুরী।

হামজা চৌধুরী সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। খেলাধুলা বা ফুটবল নিয়ে সামান্য খোঁজখবর রাখেন এমন সবাই এখন হামজাকে চেনেন। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া হামজা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তাঁর নানাবাড়ি সিলেটে। ফুটবল খেলছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের বড় দল লেস্টার সিটিতে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আর জনপ্রিয় ফুটবল প্রতিযোগিতা। সেই আসরের পরিচিত মুখ হামজা। তাই বিশ্বব্যাপী ফুটবল অনুরাগীরা হামজাকে কমবেশি চেনেন। সেই হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য ফিফার ছাড়পত্র পেয়েছেন। কাজটি সহজ ছিল না। হামজার লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলা। তিনি ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। এ ছাড়া গ্রানাডার হয়ে খেলার সুযোগও তাঁর ছিল। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ধন্যবাদ হামজাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেললে কী হবে? বাংলাদেশের ফুটবল কি রাতারাতি বদলে যাবে? উত্তর হচ্ছে, না। ফুটবল দলীয় খেলা। হামজা একা বাংলাদেশের ফুটবলকে এশিয়া কিংবা বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে যাবেনএমন আশা করলে ভুল হবে। তবে হ্যাঁ, হামজা অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ পাবে বিশ্ব মিডিয়ার ফোকাস। এতে হামজার সতীর্থরাও আলোকিত হবেন। তাঁদের জন্য খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। হয়তো হামজার কল্যাণে বাংলাদেশের কেউ কেউ পেয়ে যেতে পারেন বিদেশি কোনো বড় লীগে খেলার সুযোগ। তবে শর্ত একটাই, নিজেদের সেরাটা দিতে হবে। এ ছাড়া ইউরোপের ফুটবল সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার। ফিটনেস কিংবা ব্যক্তিগত ট্রেনিং নানা টিপস দিয়ে তিনি সহযোগিতা করতে পারেন বাংলাদেশি সতীর্থদের। বাফুফে তো জাতীয় দলের জন্য উন্নতমানের বিদেশি কোচ আর ট্রেনারের ব্যবস্থা করেছে। ক্লাব ফুটবলেও ফুটবলাররা বিদেশি কোচের সান্নিধ্য পান নিয়মিত। তবু দলের মহাতারকার সঙ্গে সতীর্থ খেলোয়াড়দের তথ্য আদান-প্রদানের ভূমিকা অনেক। তাঁরা অনেক কিছু শেখেন। রোনালদিনিওর কাছ থেকে তরুণ মেসি, মেসির কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন বলে জানিয়েছেন খোদ নেইমার। আমিও মনে করি বাংলাদেশ দলের রাকিব, মোরসালিনদের অনেক কিছু শেখা হবে হামজাকে সতীর্থ হিসেবে পাশে পেলে। অন্তত তাঁদের ম্যাচ টেম্পারামেন্ট বা মানসিক শক্তি বিকাশে হামজা ভূমিকা রাখবেন, সন্দেহ নেই।

ফিরে আসি বাংলাদেশ দল প্রসঙ্গে। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ দলে বড় কোনো তারকা নেই। সুইডেনপ্রবাসী অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকেই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা ধরা যায়। তবে হামজার অ্যাডভান্টেজ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে খেলা। তিনি বাংলাদেশে আসছেন মহাতারকা হিসেবেই। হামজাকে বাংলাদেশের পরিচিত করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বরং হামজার জন্যই বাংলাদেশ ফুটবল বিশ্বে পরিচিতি পাবে নিঃসন্দেহে। বিষয়টি হামজার জন্য চ্যালেঞ্জিংও বটে। বাংলাদেশ দলের পক্ষে ভরাডুবি হলে তাঁর মোহভঙ্গ হতে পারে। তিনি উৎসাহ হারাতে পারেন। নিজেদের সেরাটা নিয়ে হামজাকে ধরে রাখার দায়িত্বটা বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা ফুটবলারদের ওপর বর্তাবে। এটা তাঁদের জন্যও চ্যালেঞ্জ। তাঁরা হামজার যোগ্য সতীর্থ হিসেবে নিজেদের প্রমাণের চ্যালেঞ্জটা নেবেন, চ্যালেঞ্জে জয়ী হবেন আশা করছি।

বাংলাদেশ দলে হামজার অন্তর্ভুক্তি বড় ঘটনা। তাঁর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া কোনো ফুটবলার বাংলাদেশ দলে কখনো খেলেননি। তাই এখন থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি পারফরম্যান্স দেশ তো বটেই, দেশের বাইরের মিডিয়ায় থাকবে আতশ কাচের নিচে। অন্তত ইংলিশ মিডিয়া যে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে কিছুটা হলেও মাতবে, সেটা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তাদের এই আগ্রহ ধরে রাখতে হবে। হামজার পথ ধরে বাংলাদেশে অনেক প্রবাসী ফুটবলার আসুন। এরই মধ্যে জামাল ভূঁইয়া আর তারিক কাজীরা লাল-সবুজের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। এলিটা কিংসলে প্রথম ভিনদেশি খেলোয়াড় হিসেবে নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন। তবে তিনি বাংলাদেশ দলে যোগ দিয়েছিলেন বড্ড দেরিতে। তাই বাংলাদেশ কিংসলের কাছ থেকে আশানুরূপও সার্ভিস পায়নি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড়, যাঁদের অন্তত পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ফুটবলে দাপটের সঙ্গে খেলার সম্ভাবনা আছে, তাঁদের নাগরিকত্ব দিয়ে চেষ্টা চালাতে পারে। আমি রক্ষণশীল নই। বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য যা যা দরকার আমি করতে রাজি। স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সের জাতীয় দলে বহু প্রবাসী আর ভিনদেশি ফুটবলার খেলেছেন। খেলছেন। হ্যাঁ, নাগরিকত্ব নিয়ে ফিফার অনুমতি পাওয়াটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। তবে সব প্রক্রিয়া সহজভাবে সম্পন্ন করতে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। আর অবশ্যই দেশি ফুটবলারদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে। আমরাও হামজার মতো সতীর্থের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলার যোগ্যতা রাখি, বিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এতে বাংলাদেশ দল উপকৃত হবে। সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশ আর হামজা চৌধুরীর জন্য শুভ কামনা।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

মন্তব্য

তুম উধার হাম ইধার

    সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
তুম উধার হাম ইধার

প্রকৃত বিপদ ঘটল ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরে। ওই যুদ্ধ কোনো গৌরব আনল না। এদিকে শেখ মুজিব ছয় দফা দিলেন। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা ষড়যন্ত্র করছেন বলে জানা গেল।

ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুজিবকে জড়ানো হলো। সেনাকর্তারা হিসাব করেছিলেন যে ঢাকায় প্রকাশ্য বিচার করে মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রতিপন্ন করে তাঁর প্রতি জনগণের ধিক্কার ফেনিয়ে তুলবেন এবং নির্বিঘ্নে তাঁকে এমনকি ফাঁসি দিয়ে দিতেও পারবেন। ফলটা হলো কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। শেখ মুজিব পাকিস্তানি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস রাখেন দেখে এবং তিনি বাঙালিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এই কারণে তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে ধারণা করে বাঙালি জনমত তাঁর পক্ষে চলে গেল এবং তিনি গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করলেন।
এই ফাঁকে চতুর ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য রুটি, কাপড় ও আবাসের সমাজতান্ত্রিক দাবি তুলে তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দিলেন।

জনবিক্ষোভের মুখে ইয়াহিয়া খানের পক্ষে সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিট ওই দুয়ের কোনোটিই টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। জনমতকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য নির্বাচনও দিতে হলো। সংখ্যাসাম্য ভেঙে তার জায়গায় প্রাপ্তবয়স্ক ভোট চালু করার ফলে নির্বাচনের জন্য পরিকল্পিত ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬২টি পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে, ১৩৮টি পেল পশ্চিম পাকিস্তান।

ওদিকে এক ইউনিট ভেঙে দেওয়ার দরুন পশ্চিম পাকিস্তানে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে স্বীকৃতিকে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল, সেটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পেল। সত্তর সালের নির্বাচনের ফল যা দাঁড়াল, তা ছিল সেনাশাসকদের জন্য আতঙ্কজনক এবং পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জন্য বিপর্যয়সূচক। দেখা গেল, সামরিক কর্তাদের সমস্ত হিসাব-নিকাশ নাকচ করে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থক আওয়ামী লীগ দুটি আসন বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি আসনে জয়ী হয়েছে : তবে পশ্চিম পাকিস্তানে তারা একটিও আসন পায়নি। ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩২টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর দল সব আসন পাবে কি, বেলুচিস্তানে কোনো আসনই পায়নি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পেয়েছে মাত্র একটি আসন, পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশেও একেবারে যে একচ্ছত্র হয়েছে তা-ও নয়; সব মিলিয়ে তাদের আসন ৮১টি।

তুম উধার হাম ইধারব্যাপারটি দাঁড়াল এই রকমের যে ভোটের ফল অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় রইল না।

পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জন্য যেমন-তেমন, সেনাশাসকদের জন্য সেটি ছিল অশনিসংকেত। একাত্তরের যুদ্ধের পর তাঁদের কেউ কেউ যুদ্ধকালের কাহিনি লিখেছেন; সেসব কাহিনিতে বিপন্নদশার নানা কারণ দেখা যায়। যেমনভয় ছিল শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে দেবেন এবং সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের ভর্তি করতে চাইবেন। তাহলে সেনাকর্তারা তো বটেই, সেনা সদস্যরাও যেসব সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা নির্বিঘ্নে ভোগ করছিলেন, সেগুলোর কোনোটিই অক্ষত থাকবে না। বাঙালিদের শান্ত করার জন্য ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে; তদনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়াও শুরু হয়েছিল, কিন্তু দ্বিগুণ হয়েও যে বাঙালিরা সন্তুষ্ট হবে এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না, বরং এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে বাঙালিরা জনসংখ্যার অনুপাতে সেনাবাহিনীতে অংশ চাইবে; সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে ৭.৫ শতাংশকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ করলে চলবে না, বহুগুণে বাড়িয়ে ৫৬ শতাংশ করতে হবে। এবং তখন এমন অবস্থা দাঁড়াবে যে বাঙালি সেনারা আর পাঞ্জাবি কর্মকর্তাদের জুতা পালিশ করবে না, পাঞ্জাবিরাই বাঙালিদের জুতা পালিশ করা শুরু করবে।

 

পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তাদের জন্য এসব কী ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন! তা ছাড়া বাঙালিরা যদি আনুপাতিক হারে অংশ চায়, তাহলে সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, মোহাজেররাই বা চুপ করে থাকবে কেন? তারাও ন্যায়বিচার চাইবে। ফলে পাঞ্জাবি আধিপত্যের সর্বনাশ ঘটবে, সেনাবাহিনী তার বিশ্ববিখ্যাত শক্তি ও সংগঠন হারাবে। আর ওই বাহিনীই যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে পাকিস্তানের আর রইল কী?

ছোটখাটো আশঙ্কা আরো ছিল। যেমনকর্নেল ওসমানী যদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন, তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে, এই দুশ্চিন্তা! তিনি তো যারা তাঁর ওপর অসদাচরণ করেছে, তাদের ছেড়ে কথা বলবেন না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যারা শেখ মুজিবকে জড়িয়েছিল, সেসব কর্মকর্তাই বা কী করে পার পাবেন? ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা বাঙালিদের হাতে চলে যাওয়া শুরু করবে। শেষ পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডি থেকে রাজধানীকে ঢাকায় সরিয়ে নেওয়ার দাবি যে উঠবে না, তা-ই বা কে নিশ্চিত করতে পারে?

নির্বাচনের পরে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন, ফেরার পথে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে শেখ মুজিবই প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তখন তিনি (ইয়াহিয়া খান) আর থাকবেন না। বলেই হয়তো খেয়াল হয়েছে যে ওই ভয়ংকর সম্ভাবনাকে ঠেকানো দরকার। সে জন্য তিনি করাচিতে নেমেই ভুট্টোর শরণাপন্ন হয়েছেন। সমস্বার্থের চাপে দুই পক্ষ তখন এক পক্ষ হয়ে গেছে। ভুট্টোও তখন বুঝতে শুরু করেছিলেন যে খোদা না করুন শেখ মুজিব যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তাঁকে হয় তাঁর অধীনে মন্ত্রিত্ব নিতে হবে, নয়তো বসতে হবে বিরোধী দলের নেতার অস্বস্তিকর আসনে; যে দুটি সম্ভাবনার কোনোটিই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ভুট্টো তাই মুজিবকে শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। বিপদগ্রস্ত ভুট্টো নানা রকমের উল্টাপাল্টা আওয়াজ তোলা শুরু করলেন। এমনও বলছিলেন, পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক দল রয়েছে, আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সামরিক বাহিনী; তাদের মধ্যে মীমাংসা না ঘটার আগে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটানো যাবে না। আর মীমাংসা হবে গণপরিষদের বাইরে, ভেতরে নয়। শেষ পর্যন্ত এমন কথাও তিনি বলেছেন যে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে দুই পাকিস্তানে দুই মেজরিটি পার্টির কাছে। এসব কথা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল, কিন্তু এগুলো তিনি বলেছেন সামরিক বাহিনীর প্রশ্রয়েই। সেনাকর্তাদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে আওয়ামী লীগ একটি বুর্জোয়া দল, এদের পক্ষে কোনো জনবিদ্রোহ করা সম্ভব নয়। সেনাকর্তারা শুনেছেন, কারণ তাঁদের জন্য আশ্বাসের খুব দরকার ছিল। তবে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কটা যে ভালোবাসার ছিল না, সেটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই জানা গেছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ভুট্টো যখন প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াহিয়া খানকে গৃহবন্দি করে ফেলেছেন। এবং সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই ইয়াহিয়া ও তাঁর সহকর্মীদের ব্যর্থতার তদন্তের জন্য একটি কমিশন বসিয়ে দিয়েছেন।

যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন ভুট্টো একটি বই লেখেন দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি নাম দিয়ে, সেই বইয়ে মহাবিজ্ঞের মতো তিনি বলেন যে তিনি আশা করেন সেনাবাহিনীর লোকেরা আওয়ামী লীগের শহুরে সদস্যদের নিরস্ত্র করার মধ্যেই নিজেদের কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ রেখেছে, গ্রামের মানুষকে ঘাঁটায়নি; কেননা ঘাঁটালে সত্যিকারের বিপদ ঘটবে। তিনি জানতেন না যে সামরিক বাহিনীর পক্ষে গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচার না করে উপায় ছিল না। কারণ শহর-গ্রাম-নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ তখন হানাদারদের বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হানাদাররা অবশ্য কোনো তত্ত্বের পরোয়া করেনি, তারা সরাসরি গণহত্যায় নেমে পড়েছিল।

ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে প্রহসনের সংলাপ যখন চলছিল, তখন ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবের একবার দেখা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনেই। মুজিব তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, এরা কিন্তু আগে আমাকে মারবে, তারপর তোমাকে। ভুট্টো নাকি নাটকীয়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন, আমি সেনাবাহিনীর হাতে মরব, তবু ইতিহাসের হাতে মরব না। এ খবর তিনি জানিয়েছেন আমাদের, তাঁর ওই বইয়ের মারফত। তা ইতিহাসের জন্য অপেক্ষা করার দরকার পড়েনি, সেনাবাহিনীর হাতেই তো তিনি প্রাণ দিলেন। সেনাবাহিনী কিন্তু শেখ মুজিবের গায়ে হাত দিতে পারেনি। তারা মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল দেখে আশ্বস্ত হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান নিজেই তো তত দিনে ভেঙে গেছে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের মৃত্যু দিবস বৈকি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২৬ মার্চ করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। সেদিন ভুট্টো কি সত্যি সত্যি ভেবেছিলেন যে গণহত্যা পাকিস্তানকে বাঁচাবে, নাকি তিনি সেনাবাহিনীর তৎপরতা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন? ভেবেছিলেন কি যে ওই রকমের একটি আওয়াজ না দিলে তাঁকেও ওই ভগ্নস্তূপে নিক্ষেপ করা হবে, নাকি তিনি ইতিহাসজ্ঞান ও বাস্তববুদ্ধি দুটিই হারিয়ে ফেলেছিলেন ক্ষমতার লোভে? তবে তিনি যে অস্থিরচিত্ত এক জুয়াড়ি ছিলেন, তা মোটেই মিথ্যা নয়। অপরিণামদর্শী ও ক্ষমতাভোগী সেনাকর্তাদের অভিসন্ধির বিরুদ্ধে তিনি যদি শেখ মুজিবের সঙ্গে হাত মেলাতেন, তবে ইতিহাস কোন গতিপথ বেছে নিত আমরা জানি না, তবে যে গতিপথে এগোচ্ছিল, সেটি ধরে হয়তো এগোত না।

ইয়াহিয়া তখন সর্বশক্তিমান, কিন্তু তিনিও যে স্বাধীন ছিলেন এমন নয়। তাঁর চারপাশে যেসব বাজপাখি ওত পেতে বসে ছিল, তাদের সম্মতির বাইরে পদক্ষেপ নেবেন এমন ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কোনো কোনো জেনারেলের সঙ্গে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টোর যে ঘনিষ্ঠতা ছিল, এ খবরও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। ক্ষমতার লিপ্সায় জাতীয়তাবাদী ভুট্টো তখন চরমপন্থী। এক পর্যায়ে তো শেখ মুজিবকে বলেই ছিলেন যে তুম উধার হাম ইধার। ভাবটা অনেকটা ১৯৪৬-৪৭-এ অখণ্ড বাংলার হিন্দু মহাসভাপন্থীদের মতো, ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় যাঁরা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। ক্ষমতাই যদি না থাকল, তাহলে তাতে দেশ থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী। মহাসভাপন্থীরাও জাতীয়তাবাদীই ছিলেনহিন্দু জাতীয়তাবাদী।

 লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য
স্মরণ

আলী হাবিব ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মী

    নিরঞ্জন রায়
শেয়ার
আলী হাবিব ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মী

যে মানুষটি মাত্র গত মঙ্গলবারও আমার একটি লেখা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন, লেখাটি সম্পাদনা করলেন এবং সেই লেখা যথারীতি প্রকাশিত হলো, অথচ আজ তাঁকে স্মরণ করেই  কলম ধরতে হবেএমনটি আমার কোনো রকম কল্পনার মধ্যেও ছিল না। এটিই হয়তো বাস্তবতা, এটিই হয়তো নিয়তি। এভাবেই হয়তো মানুষকে একদিন চলে যেতে হয়। কালের কণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আলী হাবিবও এভাবেই চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।

গত মঙ্গলবার আলী হাবিব যথারীতি অফিসে এসে কাজ শুরু করেন, শেষ করেন সম্পাদকীয় বিভাগের কাজ। বাসায় ফিরে যাবেন, এ সময় হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন। সহকর্মীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ করে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। আমার সঙ্গে যত দিন তাঁর পরিচয়, তাতে কোনো দিন তাঁর অসুস্থ হওয়ার কথা বা হাসপাতাল তো দূরের কথা, কোনো দিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা শুনিনি।

অথচ একদিন এমন অসুস্থ বোধ করলেন যে সেটিই হলো জীবনের শেষ অসুস্থতা।

আলী হাবিব ছিলেন প্রকৃত কাগজ-কলমের মানুষ। পড়া ছিল তাঁর সাধনা এবং লেখা ছিল তাঁর পেশা ও নেশা। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, আবৃত্তিকার এবং লেখক।

লিখেছেন বেশ কিছু কবিতার বই এবং রম্যরচনা। জীবনের শুরু থেকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নিজকে নিয়োজিত রেখেছেন। কাজ করেছেন একাধিক পত্রিকায়, বিশেষ করে কালের কণ্ঠ ও জনকণ্ঠের মতো জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। পেশায় সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও তিনি না ছিলেন নিছক একজন সাংবাদিক বা সম্পাদক, ছিলেন এসবের ঊর্ধ্বে একজন নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মী। এর বাইরে তাঁর একটি বিশেষ গুণ ছিল, তা হচ্ছে তিনি খুব সুন্দর উপস্থাপনা করতে পারতেন।
সীমিত পরিসরে বেশ কিছু অনুষ্ঠান যথেষ্ট সুনামের সঙ্গেই সঞ্চালনা করেছেন।

তাঁর সঞ্চালনায় পরিচালিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েই আলী হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেখানে তাঁকে পেয়ে আমি কালের কণ্ঠে আমার লেখা প্রকাশের অনুরোধ করি। কেননা আমি বাংলাদেশে বাংলা-ইংরেজি মিলে একাধিক পত্রিকায় কলাম লিখলেও কালের কণ্ঠে লেখার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। কিন্তু কোনোভাবেই লেখা পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কারণ কালের কণ্ঠে এত প্রথিতযশা লেখকরা লিখে থাকেন, সেখানে আমার মতো সাধারণের লেখা স্থান করে নেওয়া কঠিন। আলী হাবিব ভাইকে সাহস করে কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে তাঁর ই-মেইল অ্যাড্রেস এবং ফোন নম্বর দিয়ে লেখা পাঠাতে বললেন। আমি একটি লেখা পাঠালাম এবং লেখাটি যথারীতি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হলো। এর পর থেকে আলী হাবিব ভাই এবং কালের কণ্ঠের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।

আলী হাবিব ভাই নিজেও অনেক কলাম লিখেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতির অনেক বিষয় এবং এমনকি কূটনৈতিক বা বিদেশনীতির অনেক বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কলাম লিখেছেন। তাঁর লেখা অনেক কলাম পড়ে আমি নিজেও সমৃদ্ধ হয়েছি। তাঁর লেখার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তিনি খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারতেন। সাধারণত আমাদের মতো লোক লিখতে গেলে লেখার কলেবর অনেক দীর্ঘ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে একদিন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল এবং তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে এখন পাঠক আর দীর্ঘ লেখা পড়তে চায় না। তা ছাড়া যে নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ করে লেখা, তাঁরাও এত ব্যস্ত যে তাঁদের হাতে দীর্ঘ লেখা পড়ার মতো সময় থাকে না। তাঁর এই কথাগুলো আমি লেখার সময় মেনে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু তার পরও লেখা মাঝেমধ্যে একটু দীর্ঘ হয়ে যায়। কেননা অর্থনীতির কিছু বিষয় এতই জটিল যে একটু ব্যাখ্যা করে না লিখলে সাধারণ পাঠকদের জন্য বুঝে ওঠা কষ্টকর।

আলী হাবিব ভাই নিজে যত লিখেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি লিখিয়েছেন অন্যদের দিয়ে। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন যে কোন বিষয়টি কাকে দিয়ে লেখালে সবচেয়ে ভালো হবে এবং পাঠকরা পছন্দ করবে। এ কারণেই তিনি যে লেখকের বিশেষ কোনো বিষয়ের ওপর দক্ষতা আছে, তাঁদেরই সে বিষয়ে লিখতে বলতেন। এ কারণেই কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সম্পাদকীয় লেখাগুলোর একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। কেননা লেখাগুলো নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে এমন ব্যক্তিদের দ্বারা লেখা। আমি নিজে কিছু আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর লেখা লিখেছিলাম। লেখাগুলো পেয়ে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে লেখা বেশ ভালো, কিন্তু আপনার বিষয় হচ্ছে ব্যাংক, ফিন্যান্স এবং অর্থনীতি। আমি তাঁর উপদেশমতো সেখানে থাকতে চেষ্টা করেছি। তার পরও মাঝেমধ্যে সমসাময়িক অনেক বিষয় নিয়ে যে একেবারে লিখিনি, তেমন নয়।

আলী হাবিব ভাই অনেক লেখকও তৈরি করেছেন। লেখা তো লিখলেই হবে না। বিষয়বস্তু সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে যথাযথভাবে উপস্থাপনা করা এক ধরনের বিশেষ দক্ষতা, যা এক বিশেষ অনুশীলন ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে রপ্ত করতে হয়। আলী হাবিব ভাই লেখার এই বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে ধরিয়ে দিতেন। আমি নিজেও এ ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে বেশ উপকৃত হয়েছি। আজ আমি যেভাবে লিখে যাচ্ছি, এর বড় কৃতিত্ব আলী হাবিব ভাইয়ের। আলী হাবিব ভাই তাঁর এক লেখায় আমাকে এভাবে স্মরণ করেছিলেন যে কানাডার টরন্টোতে আছেন একজন ব্যাংকার, যিনি অর্থনীতির জটিল বিষয় সহজ করে লিখতে পারেন। বাস্তবে কতটা সহজ করে লিখতে পারছি, তা একমাত্র আলী হাবিব ভাই বুঝেছিলেন আর বুঝবেন সুহৃদ পাঠক।

আলী হাবিব ভাই এটিও বেশ ভালো করে জানতেন যে কখন কোন লেখাটি আগে বা গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে হবে। এমনও দেখা গেছে যে আমি একটি লেখা পাঠিয়েছি, কিন্তু তিনি সেটি ধরে রেখে আমাকে অন্য একটি বিষয়ের উল্লেখ করে জানাতেন যে পাঠানো লেখাটি পরে প্রকাশ করলে কোনো সমস্যা হবে না। দেখুন, আপনি এই বিষয়ে একটি লেখা দিতে পারেন কি না। আমি তাঁর উপদেশ অনুসারে সে বিষয়ের ওপর লেখা তৈরি করে সময়মতো পাঠিয়ে দিয়েছি এবং কালের কণ্ঠে তা যথারীতি প্রকাশিতও হয়েছে। এভাবেই একজন লেখক তৈরি হন এবং এই লেখক তৈরির ক্ষেত্রে আলী হাবীব ভাইয়ের অবদান অনেকের কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।      

লেখালেখি দিয়ে আলী হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়, কিন্তু হয়ে গিয়েছিলেন আপনের চেয়েও আপন। যেদিন তিনি মারা যান, সেদিনও সকালবেলায় আমার উচ্চ সুদহার বিষয়ে লেখার কিছু টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন এবং আমাকে বললেন, বর্তমান সময়ে অসাধারণ একটি লেখা বৃহস্পতিবার ছাপা হবে। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর আমি অফিসে গিয়ে তাঁর এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর কাছ থেকে ভয়ংকর দুঃসংবাদটি পেলাম যে আমাদের প্রিয় আলী হাবিব ভাই আর নেই। মাত্র ৬১ বছর বয়সে জীবনের অনেক কিছু অসমাপ্ত রেখেই আকস্মিক চলে গেলেন না-ফেরার দেশে, সেখানে তিনি ভালোই থাকবেন। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি এবং জানাই শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা।

 লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

nironjankumar_roy@yahoo.com

মন্তব্য

যক্ষ্মা নির্মূলে প্রধান বাধা লোকলজ্জা ও অসচেতনতা

    ডা. আয়েশা আক্তার
শেয়ার
যক্ষ্মা নির্মূলে প্রধান বাধা লোকলজ্জা ও অসচেতনতা

যক্ষ্মা (টিবি) বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এটি একটি প্রাচীন রোগ, যা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে হয়। মানুষ সাধারণত কাশির মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি বা থুতু ছিটানোর মাধ্যমে বাতাসে টিবির জীবাণু ছড়ায়।

এ রোগ নিয়ে বাংলাদেশ বহু বছর ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, কিন্তু রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হলো সব রোগী শনাক্ত করতে না পারা। যক্ষ্মা হলে মানুষ সহজে প্রকাশ করতে চায় না। এর মূলে রয়েছে লোকলজ্জা, রোগের ব্যাপারে অবহেলা, সচেতনতার অভাবের মতো বিষয়।
তা ছাড়া কর্মজীবীরা কাজ বাদ দিয়ে সহজে রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না।

সম্প্রতি যক্ষ্মা নিয়ে বাংলাদেশে কিছু নতুন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। উপসর্গ ছাড়াই অনেক রোগী শনাক্ত হচ্ছে। আক্রান্তরা বিষণ্নতায় ভুগলে তাদের মানসিক চিকিৎসা অনেকটাই উপেক্ষিত থাকছে।

অন্যদিকে শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, যক্ষ্মা রোগীদের বিষণ্নতা যক্ষ্মা না থাকা মানুষের চেয়ে ৩.৭ গুণ বেশি। বিষণ্নতার কারণে যক্ষ্মা রোগী ঠিকমতো ফলোআপ চিকিৎসা না করানোর কারণে যক্ষ্মা রোগীদের মৃত্যুহার কমছে না।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মার (টিবি) নতুন রোগী শনাক্ত বেড়েছে। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্বের মোট যক্ষ্মা সংক্রমণের অর্ধেকের বেশি হয়েছে পাঁচটি দেশে।

এগুলো হলো ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপিন্স ও পাকিস্তান। এর মধ্যে শুধু ভারতে চতুর্থাংশেরও বেশি সংক্রমণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে শীর্ষ দশে।

দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ রবার্ট কচ যক্ষ্মা রোগের জীবাণু মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস আবিষ্কার করেন। এর আরো ১০০ বছর পর ১৯৮২ সাল থেকে এই দিনে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিশ্রুতি, বিনিয়োগ ও সেবাদান দ্বারা সম্ভব হবে যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়া

যক্ষ্মা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে, তার হাঁচি, কাশি বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। কথা থেকেও বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। একজন মানুষের কফ ছায়াহীন জায়গায় ফেললে বহুদিন জীবাণু বেঁচে থাকে। অপরিচ্ছন্ন, বদ্ধ, আলো-বাতাসহীন ঘরে এটি বেশি ছড়ায়। এক ঘরে বেশি মানুষ থাকলে এটি দ্রুত ছড়ায়। বিভিন্ন রকমের যক্ষ্মা রয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্তের হার অনেক বেশি। গত বছর (২০২৪ সালে) বাংলাদেশে শনাক্ত করা রোগীর ৫.২ শতাংশ শিশু। এর আগের বছর (২০২৩ সালে) শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৪.৪ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ০.৮ শতাংশ বেড়েছে।

সাধারণত যক্ষ্মা হলে বড়দের যে উপসর্গগুলো দেখা যায়, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তার কিছু পার্থক্য রয়েছে। বড়দের ক্ষেত্রে ফুসফুসের যক্ষ্মা বেশি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ফুসফুসের বাইরে যে যক্ষ্মাগুলো রয়েছে সেগুলো শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, ফুসফুসের যক্ষ্মার তুলনায় যেগুলো শনাক্ত করা মুশকিল। তাই শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত হতে দেরি হয়।

শিশু এ রোগে আক্রান্ত হলে খাওয়াদাওয়ার পরও তার ওজন কমে যায় অথবা ওজন একই জায়গায় রয়ে গেছে, খাওয়ার রুচি চলে গেছে। অনেক সময় দেখা যায়, অন্য কোনো লক্ষণ নেই কিন্তু শিশু দুর্বল হয়ে পড়ছে, খেলছে না, সারা দিন ঝিমাচ্ছে, শুয়ে থাকতে চাইছে, খিটখিট করছে। যক্ষ্মার জ্বর সাধারণত ১০০ ডিগ্রির মতো থাকে। খুব উচ্চ তাপমাত্রা থাকে না। এই জ্বর সাধারণত সন্ধ্যার দিকে বা রাতে বেশি হয়ে থাকে এবং দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হালকা জ্বর থাকছে, খুসখুসে কাশি, কফ, ঠাণ্ডা, সর্দিএগুলোও বড় লক্ষণ। মনে রাখতে হবে, এগুলো যদি টানা দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে থাকে, তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

 

লেখক : উপপরিচালক, ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতাল

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ