হামজাকে জায়গামতো বল দেওয়া, হামজা কখন কোথায় বল ছাড়বে, সেটি যেন সঙ্গের খেলোয়াড়রা বুঝতে পারে, ভুল যেন না হয়।’
হামজা চৌধুরী ইতিবাচক খেলোয়াড়। তিনি জানেন দেশের জাতীয় দলে তাঁর কী ভূমিকা হওয়া উচিত। তাঁর বড় প্রয়োজন সতীর্থ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সহযোগিতা এবং তাঁদের বোঝা। একা খেলে তো হামজা দলকে জেতাতে পারবেন না—অন্যদের সহযোগিতা লাগবে।
হামজার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ দলের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। খেলোয়াড়রা অনুপ্রাণিত এবং উজ্জীবিত। তাঁরা মাঠে সামর্থ্য উজাড় করে লড়বেন দেশের জন্য। ভারতের বিপক্ষে যদি দল জেতে, তাহলে কি ফুটবলের গতিপথ বদলে যাবে রাতারাতি? তা নয়। ফুটবল আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে, উজ্জীবিত হবে। গতিপথ বদলাতে হলে নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন রূপরেখা নির্ণয় করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন ফুটবলে ফিফা অনুমোদিত সংস্কার সাধন। ফুটবলে প্রয়োজন দ্রুত সমস্যার সমাধান এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, ঐকমত্য পোষণের ভিত্তিতে। প্রবাসী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং নাগরিকত্ব নিয়ে খেলোয়াড়দের খেলা নিয়ে কিছু কথা উঠেছে। এটি যাঁরা বলছেন, তাঁরা অজ্ঞতা এবং সচেতনতার অভাবের জন্য এটি বলছেন। শুধু বলব, দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশের ফুটবলে এই প্র্যাকটিস আছে। আর এটি ফিফা কর্তৃক অনুমোদিত। এই প্র্যাকটিস দেশের ফুটবলকে ধ্বংস করে না বরং সমৃদ্ধ করে, জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
ইতালি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ খেলোয়াড় ফাহমিদুল সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশ স্কোয়াডে যোগ দিয়েছিলেন। মিডিয়ায় দেখেছি, তাঁকে নিয়ে অনেক কথাই লেখা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি হবেন দলের তুরুপের তাস ভারতের বিপক্ষে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাঁকে নিয়ে দারুণভাবে মেতেছে। সৌদিতে ক্যাম্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে না এসে ইতালিতে ফিরে গেছেন। এই বিষয়টি নিয়েও প্রচুর আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন ষড়যন্ত্র। সিন্ডিকেটের খেলা। মিছিল বের করা হয়েছে। বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে। অমুকের পদত্যাগ, তমুকের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। অবিবেচকের মতো ফুটবলে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। তিনি জানেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। সরকারের হস্তক্ষেপ ফিফা কখনো বরদাশত করে না। পাবলিককে খুশি করার জন্য বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় ক্রীড়া উপদেষ্টা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির সঙ্গে বসেছেন। শেষ পর্যন্ত জানা গেছে, ফাহমিদুল বাংলাদেশের দলের জন্য এখনো তৈরি নন। ভবিষ্যতে অবশ্যই সুযোগ আছে।
হামজা চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের ফুটবলে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এটি জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি এবং বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসানের কাছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে ভক্তদের অভিযোগের অন্ত নেই। শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গন নয়, বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল নিয়েও রয়েছে মানুষের বিস্তর অভিযোগ। ফুটবলের মান পড়ে গেছে কিংবা ঘরোয়া ফুটবলে দর্শক নেই, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অন্যতম শীর্ষকর্তা হিসেবে অভিযোগটি আমাকেও শুনতে হয় প্রায়ই। বরাবরের মতো আমার উত্তর, বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে দর্শকশূন্যতার জন্য ক্লাবগুলোও অনেকাংশে দায়ী। মাঠে দর্শক আসে ক্লাবের টানে। প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে। বাংলাদেশের ক্লাবগুলো নিজেদের সমর্থক ধরে রাখা বা মাঠে আনতে ব্যর্থ। একই সঙ্গে দর্শকদের সামনে হাজির করতে পারেনি কোনো ফুটবল ‘আইকন’, যাদের খেলা দেখতে ভক্তরা মাঠে আসতে উৎসাহ বোধ করবে। খেলোয়াড় বা তারকা তৈরির মূল কাজটি তো ক্লাবেরই কাজ। বাংলাদেশের ফুটবলে তারকা খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। কাজী সালাউদ্দিন, চুন্নু, এনায়েত, কায়সার হামিদ, মুন্না, আসলাম আর সাব্বিরদের খেলা দেখার জন্য আলাদা দর্শক ছিল। তারা মাঠে যেত প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে। বর্তমানে কোনো বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে আলাদাভাবে কোনো দর্শক মাঠে আসে কি না আমার জানা নেই। ফুটবলে প্রিয় ক্লাব তো থাকবেই, কিন্তু বিশেষ খেলোয়াড়দের ভক্তরাও কম গুরুত্বপূর্ণ না। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালডোরা ইউরোপ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সৌদি আরবে পাড়ি জমালে সেই সব দেশের ফুটবল ক্লাব আর লীগ জাতে উঠে যায়। দর্শক বেড়ে যায় রাতারাতি। আসলে ক্লাব ফুটবল বলেন কিংবা জাতীয় দল, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে আসার জন্য প্রয়োজন তারকা খেলোয়াড়ের উপস্থিতি, যিনি নিজ দেশ কিংবা ক্লাবের জন্য বড় ‘বিজ্ঞাপন’ হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের জন্য কাজটি করতে পারেন হামজা চৌধুরী।
হামজা চৌধুরী সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। খেলাধুলা বা ফুটবল নিয়ে সামান্য খোঁজখবর রাখেন এমন সবাই এখন হামজাকে চেনেন। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া হামজা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তাঁর নানাবাড়ি সিলেটে। ফুটবল খেলছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের বড় দল লেস্টার সিটিতে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আর জনপ্রিয় ফুটবল প্রতিযোগিতা। সেই আসরের পরিচিত মুখ হামজা। তাই বিশ্বব্যাপী ফুটবল অনুরাগীরা হামজাকে কমবেশি চেনেন। সেই হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য ফিফার ছাড়পত্র পেয়েছেন। কাজটি সহজ ছিল না। হামজার লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলা। তিনি ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। এ ছাড়া গ্রানাডার হয়ে খেলার সুযোগও তাঁর ছিল। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ধন্যবাদ হামজাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেললে কী হবে? বাংলাদেশের ফুটবল কি রাতারাতি বদলে যাবে? উত্তর হচ্ছে, না। ফুটবল দলীয় খেলা। হামজা একা বাংলাদেশের ফুটবলকে এশিয়া কিংবা বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে যাবেন—এমন আশা করলে ভুল হবে। তবে হ্যাঁ, হামজা অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ পাবে বিশ্ব মিডিয়ার ফোকাস। এতে হামজার সতীর্থরাও আলোকিত হবেন। তাঁদের জন্য খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। হয়তো হামজার কল্যাণে বাংলাদেশের কেউ কেউ পেয়ে যেতে পারেন বিদেশি কোনো বড় লীগে খেলার সুযোগ। তবে শর্ত একটাই, নিজেদের সেরাটা দিতে হবে। এ ছাড়া ইউরোপের ফুটবল সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার। ফিটনেস কিংবা ব্যক্তিগত ট্রেনিং নানা টিপস দিয়ে তিনি সহযোগিতা করতে পারেন বাংলাদেশি সতীর্থদের। বাফুফে তো জাতীয় দলের জন্য উন্নতমানের বিদেশি কোচ আর ট্রেনারের ব্যবস্থা করেছে। ক্লাব ফুটবলেও ফুটবলাররা বিদেশি কোচের সান্নিধ্য পান নিয়মিত। তবু দলের মহাতারকার সঙ্গে সতীর্থ খেলোয়াড়দের তথ্য আদান-প্রদানের ভূমিকা অনেক। তাঁরা অনেক কিছু শেখেন। রোনালদিনিওর কাছ থেকে তরুণ মেসি, মেসির কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন বলে জানিয়েছেন খোদ নেইমার। আমিও মনে করি বাংলাদেশ দলের রাকিব, মোরসালিনদের অনেক কিছু শেখা হবে হামজাকে সতীর্থ হিসেবে পাশে পেলে। অন্তত তাঁদের ম্যাচ টেম্পারামেন্ট বা মানসিক শক্তি বিকাশে হামজা ভূমিকা রাখবেন, সন্দেহ নেই।
ফিরে আসি বাংলাদেশ দল প্রসঙ্গে। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ দলে বড় কোনো তারকা নেই। সুইডেনপ্রবাসী অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকেই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা ধরা যায়। তবে হামজার অ্যাডভান্টেজ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে খেলা। তিনি বাংলাদেশে আসছেন মহাতারকা হিসেবেই। হামজাকে বাংলাদেশের পরিচিত করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বরং হামজার জন্যই বাংলাদেশ ফুটবল বিশ্বে পরিচিতি পাবে নিঃসন্দেহে। বিষয়টি হামজার জন্য চ্যালেঞ্জিংও বটে। বাংলাদেশ দলের পক্ষে ভরাডুবি হলে তাঁর মোহভঙ্গ হতে পারে। তিনি উৎসাহ হারাতে পারেন। নিজেদের সেরাটা নিয়ে হামজাকে ধরে রাখার দায়িত্বটা বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা ফুটবলারদের ওপর বর্তাবে। এটা তাঁদের জন্যও চ্যালেঞ্জ। তাঁরা হামজার যোগ্য সতীর্থ হিসেবে নিজেদের প্রমাণের চ্যালেঞ্জটা নেবেন, চ্যালেঞ্জে জয়ী হবেন আশা করছি।
বাংলাদেশ দলে হামজার অন্তর্ভুক্তি বড় ঘটনা। তাঁর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া কোনো ফুটবলার বাংলাদেশ দলে কখনো খেলেননি। তাই এখন থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি পারফরম্যান্স দেশ তো বটেই, দেশের বাইরের মিডিয়ায় থাকবে আতশ কাচের নিচে। অন্তত ইংলিশ মিডিয়া যে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে কিছুটা হলেও মাতবে, সেটা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তাদের এই আগ্রহ ধরে রাখতে হবে। হামজার পথ ধরে বাংলাদেশে অনেক প্রবাসী ফুটবলার আসুন। এরই মধ্যে জামাল ভূঁইয়া আর তারিক কাজীরা লাল-সবুজের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। এলিটা কিংসলে প্রথম ভিনদেশি খেলোয়াড় হিসেবে নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন। তবে তিনি বাংলাদেশ দলে যোগ দিয়েছিলেন বড্ড দেরিতে। তাই বাংলাদেশ কিংসলের কাছ থেকে আশানুরূপও সার্ভিস পায়নি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড়, যাঁদের অন্তত পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ফুটবলে দাপটের সঙ্গে খেলার সম্ভাবনা আছে, তাঁদের নাগরিকত্ব দিয়ে চেষ্টা চালাতে পারে। আমি রক্ষণশীল নই। বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য যা যা দরকার আমি করতে রাজি। স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সের জাতীয় দলে বহু প্রবাসী আর ভিনদেশি ফুটবলার খেলেছেন। খেলছেন। হ্যাঁ, নাগরিকত্ব নিয়ে ফিফার অনুমতি পাওয়াটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। তবে সব প্রক্রিয়া সহজভাবে সম্পন্ন করতে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। আর অবশ্যই দেশি ফুটবলারদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে। আমরাও হামজার মতো সতীর্থের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলার যোগ্যতা রাখি, বিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এতে বাংলাদেশ দল উপকৃত হবে। সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশ আর হামজা চৌধুরীর জন্য শুভ কামনা।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া