গ্রামবাংলায় খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড

  • আব্দুল বায়েস
শেয়ার
গ্রামবাংলায় খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড

...সে কাল আর নাই। কালের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। মাঠের বুক চিড়িয়া রেল লাইন পড়িয়াছে। তাহার পাশে টেলিগ্রাফ তারের খুঁটির সারি।

বিদ্যুৎ-শক্তিবহ তারের লাইন। মেঠোপথ পাকা হইয়াছে। তাহার উপর দিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে মোটর বাস ছুটিতেছে। নদী বাঁধিয়া খাল কাটা হইয়াছে।
লোকে হুঁক্কা ছাড়িয়া বিড়ি-সিগারেট ধরিয়াছে। কাঁধে গামছা, পরনে খাটো কাপড়ের বদলে বড় বড় ছোকরারা জামা, লম্বা কাপড় পরিয়া সভ্য হইয়াছে। ছ-আনা, দশ-আনা ফ্যাশনে চুল ছাঁটিয়াছে। ভদ্রগৃহস্থঘরের হাল-চাল বদলাইয়াছে।

(তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইকমল)

আসলে তো তাই। সব কিছুর পরিবর্তন ঘটছে, যেমনি গ্রামের, তেমনি গ্রামে বাস করা মানুষগুলোর জীবন-জীবিকার। যেমনএকসময় কৃষি ছিল গরিবের জীবিকার প্রধান উৎস। আর কৃষি বলতে অন্যের জমিতে ফসল উৎপাদনে শ্রম দেওয়া, তা-ও আবার একটি ফসলে। বছরের বাকি সময়ে জুতসই কর্মসংস্থানের অভাবে আধাপেটে কিংবা না খেয়ে থাকা।

কিন্তু এখন মাঠের বুক চিড়ে ট্রেন চলা কিংবা মেঠোপথ পাকা হওয়ার ফলে ঊর্ধ্বশ্বাসে যন্ত্রশকটের ছুটে চলা ও বিদ্যুত্শক্তির কল্যাণে আধুনিক জ্বালানিতে প্রবেশ ইত্যাদি প্রমাণ করে যে গ্রাম কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। পণ্য ও উপকরণ বাণিজ্যে বিনিময় এবং তা দ্রুততর হচ্ছে, গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও কাজের সন্ধানে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। পুরো অবকাঠামোগত সুবিধা কৃষি থেকে অ-কৃষি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলছে। ইদানীং দেখা যায়, কৃষি কাজের বা খামারের বাইরে ঘটা অ-কৃষিজ কর্মকাণ্ড জীবিকার প্রধান উৎস হিসেবে গরিবের সামনে উপস্থিত। শুধু পুরুষ নয়, এমনকি গরিব মহিলারাও এসব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে আয় বৃদ্ধিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। তবে স্বীকার করতেই হবে যে গরিববান্ধব অ-কৃষিজ কর্মকাণ্ড বিস্তৃতির পেছনে বড় অবদান রেখেছে একদিকে সবুজ বিপ্লব এবং গড়ে ওঠা গ্রামীণ অবকাঠামো। এর ফলে গ্রামীণ সমাজে আয় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভোগ ও পরিধানে পরিবর্তন ঘটছে, যা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

দুই.

এরই মধ্যে অনেক পণ্ডিত গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনকুশলতায় খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ভূমিকা নিয়ে বেশ চমকপ্রদ বিশ্লেষণ করেছেন। অতি সম্প্রতি সমাপ্ত গবেষণাগুলোতে এসব কর্মকাণ্ডকে পল্লী উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে গ্রামীণ খানার মোট আয়ের প্রায় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ এই খাত থেকে উৎসারিত হয় এবং এই খাতেই আবার গ্রামের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ সংঘটিত হয়। এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অ-কৃষিতে নিয়োজিত কর্মকাণ্ড গ্রামের মহিলা ও ভূমিহীন দরিদ্রের জন্য জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস এবং সেহেতু এ দেশ বিস্তৃত আশীর্বাদস্বরূপ। এক গবেষণা প্রবন্ধে খুব সুন্দরভাবে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে এবং আমরা তা পাঠকের জন্য তুলে ধরতে পারি : অর্থনৈতিক রূপান্তরের সময় গ্রামাঞ্চলে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের আবির্ভাব এবং দ্রুত বিস্তৃতি আর্থ ও কর্মসংস্থানের একটি প্রধান উৎস হিসেবে দাঁড়ায়। উন্নয়নের প্রথম দিকে একটি ছোট খাত থেকে, যা প্রায়ই প্রধানত খণ্ডকালীন এবং জীবন নির্বাহমুখী, ধীরে ধীরে অ-কৃষি অর্থনীতি শুধু গ্রামাঞ্চলের জন্য নয়, বরং পুরো অর্থনীতির জন্যও হয়ে ওঠে প্রবৃদ্ধির চালকযন্ত্র। মহিলা ও দরিদ্রদের কল্যাণের পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং কখনো কখনো কৃষি খাত থেকে জন্ম নেওয়া বৈষম্য পরিস্থিতিতে সমতা বিধান করে।

গ্রামবাংলায় খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডবাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে কৃষির চেয়ে কৃষিবহির্ভূত বা অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ড থেকে উৎসারিত আয়ের প্রবৃদ্ধির হার ছিল বেশি, যার ফলে গ্রামের দরিদ্র শ্রেণি অ-কৃষি কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে গড়পড়তা আয় বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে গরিব শ্রমিক শ্রেণি গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার ফলে কৃষিতে মজুরির হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে বিস্তৃত অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ডকে দরিদ্রবান্ধব বা দরিদ্রমুখী বলে চিহ্নিত করা চলে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সামনেও ক্রমবর্ধিষ্ণু শ্রমশক্তির জন্য উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এক দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ। দ্রুত গ্রাম-নগর অভিবাসন সত্ত্বেও কর্মোপযোগী বয়সের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ শ্রম বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে এবং তাদের বেশির ভাগ গ্রামেই অবস্থান করছে। তবে গ্রামে বাস করলেও এই বর্ধিষ্ণু শ্রমশক্তিকে কৃষি খাতে নিয়োজিত রাখার বেশ কিছু সমস্যা আছে। এর প্রধান কারণ হতে পারে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার কোনো সুযোগ তো নেই, বরং প্রতিবছরই নানা চাহিদার বাহানায় চাষযোগ্য জমি কমছে। দ্বিতীয়ত, বেশির ভাগ অঞ্চলেই শস্য নিবিড়তা সূচক প্রায় ২০০ শতাংশের বেশি এবং তা প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। তৃতীয়ত, শস্য উৎপাদন এখন প্রযুক্তিনির্ভর, যার ফলে যে মাত্রায় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, ঠিক সেই মাত্রায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় না (কর্মসংস্থানে উৎপাদনের স্থিতিস্থাপকতা অপেক্ষাকৃত কম। অর্থাৎ জমির উৎপাদনশক্তি যত বাড়ছে, ততই শ্রমিক কম লাগছে। সব শেষে অতীতের সব উন্নয়ন সত্ত্বেও শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অবকাশ এখনো আছে, যেমন আছে যান্ত্রিক চাষাবাদ গ্রহণ করে একরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির।

 

তিন.

বর্তমান লেখায় আমরা অ-কৃষি খাতের একটি সীমিত সংজ্ঞা ব্যবহার করেছি, যেখানে কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের মধ্যে গবাদি পশু, মাছ চাষ ও বন কার্যক্রমও অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে পুঁজি লগ্নির প্রকৃতির নিরিখে আমরা তিন ধরনের কাজ চিহ্নিত করতে পারি যথা : (ক) স্ব-নিয়োজিত জীবননির্বাহমুখী কুটির শিল্প, গ্রামীণ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মজুরি কর্মসংস্থান, পরিবহন পরিচালন, নির্মাণ শ্রম ইত্যাদি। স্মর্তব্য, এগুলো মূলত দৈহিক শ্রমনির্ভর কর্মকাণ্ড; (খ) বেতনভুক্ত শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় কর্মচারী, ডাক্তার, ইমাম এবং অন্যান্য সেবাকাজে নিয়োজিত শ্রমিক, যাদের প্রদত্ত শ্রমকে এ ক্ষেত্রে মানবপুঁজি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় এবং (গ) বাণিজ্যভিত্তিক গ্রামীণ শিল্প খাতে অন্তর্ভুক্ত থাকছে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, দোকান, ছোটখাটো ব্যবসা, বড় ও মাঝারি ব্যবসা, ঠিকাদারি ইত্যাদি বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই কাজগুলো সাধারণত দৈহিক ও মানব পুঁজি নির্ভর।

প্রথমেই খানাগুলোর প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পেশা এবং খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার তথ্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, অধুনা খানাগুলোর বেশির ভাগ উপার্জনকারী সদস্য খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে প্রাথমিক পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং আরো কিছুসংখ্যক উল্লেখ করেছে দ্বিতীয় পেশা হিসেবে। অতীতের তুলনায় এ অনুপাত নিঃসন্দেহে বেশি। সুতরাং পরিসংখ্যান বলে দেয় যে জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনকারীদের একটি বড় অংশ অ-কৃষিজ কর্মকাণ্ড বেছে নিচ্ছে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ উপার্জনকারীর প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পেশা হিসেবে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ভূমিকা রাখছে। শুধু তা-ই নয়, পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে যেমন এদের গুরুত্ব বাড়ছে, তেমনি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাড়ছে এদের অবদান।

জানা যায়, সময়ের বিবর্তনে গ্রামীণ খানার আয় বেড়েছে  সন্তোষজনকভাবে, তবে বর্ধিষ্ণু আয়ের বেশির ভাগ এসেছে অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ড থেকে। অথচ একই সময়ে কৃষি থেকে পাওয়া আয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে খুব কম মাত্রায়। বুঝতে কষ্ট হয় না যে খানার আয় সংঘটনে কৃষির অবদান ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে এবং অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ডের অংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের এই পর্যবেক্ষণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক পরিচালিত এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ খামারবহির্ভূত অর্থনীতি এশিয়ার গ্রামীণ আয়ের ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ অবদান রাখে এবং বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে খানার মোট আয়ের একটি বড় অংশের উৎস খামারবহির্ভূত কাজ। এমনকি গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ মানুষ তাদের আয়ের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অর্জন করে অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ড থেকে। যদি মোট জিডিপিতে অংশ হিসাব করা যায়, তাহলে দেখা যায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অবদান নিয়ে কৃষির চেয়ে খামারবহির্ভূত খাত এগিয়ে আছে। তা ছাড়া এটি খুবই স্বাভাবিক যে বর্ধিত গ্রামীণ আয় বৃদ্ধির কারণে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে ফসলবহির্ভূত খাবার ও সেবামূলক পণ্যের চাহিদা। যেহেতু এসব খাদ্য ও সেবা দ্রব্যের আয় স্থিতিস্থাপকতা বেশি (এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে গ্রামাঞ্চলের স্থিতিস্থাপকতা শহরের চেয়ে বেশি), তাই অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ড থেকে উৎসারিত আয়ের সংযোগ প্রতিক্রিয়ার মাত্রা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

চার.

শুধু আয় সংঘটনে নয়, গ্রামাঞ্চলের খানাগুলোর পুঁজি সঞ্চয়নেও খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা আজ সুবিদিত এবং এ প্রবণতা গরিব বা সচ্ছল সবার ক্ষেত্রেই মাত্রাভেদে প্রযোজ্য। যেমনঅতীতে গ্রামীণ গৃহস্থালিতে পুঁজি বলতে লাঙল, নৌকা, মই, জাল ইত্যাদি অর্থাৎ পুঁজির বেশির ভাগ ছিল কৃষিকেন্দ্রিক। ইদানীং কৃষি পুঁজির অংশ হ্রাস পায়, কিন্তু খামারবহির্ভূত বা অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ড দাবি করে মোট পুঁজির প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, অতীতে যেখানে খানাপ্রতি পুঁজি লগ্নির পরিমাণ ছিল ২৫০ ডলার, এখন তা দাঁড়ায় এক হাজার ৩০০ ডলারে। উপস্থাপিত তথ্য বোধ হয় বলে দেয় যে খানা উৎসারিত পুঁজির সর্বাধিক ব্যবহার ঘটেছে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে। এর কারণ সম্ভবত এই যে খানার মোট আয়ের বেশির ভাগ আসে অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ড থেকে এবং এই আয় সংঘটন খানাগুলোকে বর্ধিত হারে পুঁজি বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে।

সময়ের বিবর্তনে লক্ষ করা যাচ্ছে যে খামার ও খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের মধ্যে চলিষ্ণুতা বা গতিময়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ শ্রমিক মূলত খামার থেকে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে যাচ্ছে বেশি, উল্টো দিক থেকে যাচ্ছে কম। দেখা গেছে, যারা জমি চাষ করে, তাদের অনুপাত ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং সময়ের বিবর্তনে কৃষি শ্রমিকের অনুপাত প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে। অন্যদিকে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে রিকশা/ভ্যান চালনা এবং স্ব-নিয়োজিত কারিগরি কর্মকাণ্ড। এই পর্যবেক্ষণ দেখায় যে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটের বিস্তৃতি, শ্যালো মেশিন ও পাওয়ার টিলারের আবির্ভাব ইত্যাদি গ্রামীণ অঞ্চলে বর্ধিতহারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। তা ছাড়া সেবামূলক কাজে (যেমনচাকরি) নিয়োজিত ছিল মোট উপার্জনকারীর এক-পঞ্চমাংশ, অতীতের ১৩ শতাংশের তুলনায়। মোটামুটিভাবে তুলনীয় সময়ে বেকারত্বের হার কমেছে এবং বলা বাহুল্য, খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তার বেকারত্ব ঘোচাতে সাহায্য করেছে।

পাঁচ.

গ্রামীণ খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড আরো বেগবান করে দারিদ্র্য হ্রাস তথা গ্রাম উন্নয়ন ঘটাতে হলে চাই গ্রামীণ খুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সম্প্রসারণ। এর জন্য দরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাঝে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এর আগে চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন, যা এখন প্রধান প্রতিবন্ধক।

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

নতুন নতুন শহরে ডেঙ্গুর বিস্তার : নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

    অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার
শেয়ার
নতুন নতুন শহরে ডেঙ্গুর বিস্তার : নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জনসচেতনতার অভাবের ফলে এডিস মশাবাহিত এই রোগের প্রকোপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। আগাম ব্যবস্থা না নিলে এ বছরও ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

 

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ২০০০ সালে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ ও ২০২৩ সালে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয় এবং মৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। বর্তমানে ডেঙ্গু শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসাব্যবস্থাও চাপে পড়েছে।

ডেঙ্গুর জন্য দায়ী মূলত এডিস এজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিক্টাস প্রজাতির মশা। এগুলো সাধারণত দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যায় মানুষকে কামড়ায়। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশারের গবেষণায় দেখা গেছে, এটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাতের বেলায়ও কামড়ায়।

 

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/30-03-2025/2/kalerkantho-ed-1a.jpgএডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার ও জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে। যেমনফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র, ফ্রিজের ট্রে, এসির পানি জমানো স্থান ইত্যাদি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ছোট শহরে অধিক জনসংখ্যার কারণে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাত্র তৈরি হয়, যার মধ্যে পানি জমা হয়ে মশার বংশবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করছে। প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের প্লাস্টিকের পাত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্লাস্টিকের বোতল, কাপ, ব্যাগ ইত্যাদি।

এসব পাত্রে বৃষ্টি হলেই কমবেশি পানি জমা হয়ে এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ জায়গা তৈরি করে। বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরে প্রায় সব জায়গায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অভাবে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে, যা মশার বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি করে।  শহরে উঁচু ভবন ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আলো-বাতাস চলাচল কম হওয়ায় মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য অত্যন্ত সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, উষ্ণ আবহাওয়ায় মশার ডিম থেকে পূর্ণবয়স্ক মশা হয়ে উঠতে কম সময় লাগে। ফলে মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আগে শুধু বর্ষাকালে ডেঙ্গু দেখা যেত, এখন গ্রীষ্মকালেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনিয়মিত ও অতিবর্ষণের ফলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে, যা মশার জন্মের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রধান ধরন বা সেরোটাইপ (DENV-1, DENV-2, DENV-3DENV-4) রয়েছে। একবার একটি সেরোটাইপ দিয়ে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে শরীরে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি গড়ে ওঠে। ওই একই সেরোটাইপ দিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত না হলেও অন্য সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

ভাইরাস খুব দ্রুত মিউটেডেট বা পরিবর্তিত হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তিত হলে সংক্রমণ আরো মারাত্মক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, DENV-2DENV-3 ধরনের সংক্রমণ সাধারণত বেশি মারাত্মক রূপ নেয় এবং এগুলো ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের ঝুঁকি বাড়ায়। একবার একটি ধরন বা সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর যদি অন্য ধরন দ্বারা সংক্রমিত হয়, তাহলে অ্যান্টিবডি-ডিপেনডেন্ট এনহান্সমেন্ট (ADE) নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংক্রমণ আরো গুরুতর হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগী রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। পরিবর্তিত পরিবেশে ভাইরাস খুব দ্রুত অভিযোচিত হয়। ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তনের ফলে এটি আরো সংক্রামক হতে পারে এবং ভ্যাকসিন বা চিকিৎসাপদ্ধতিও কম কার্যকর হয়ে যেতে পারে। তাই এন্টোমলজিক্যাল সার্ভিলেন্সের পাশাপাশি সেরো সার্ভিলেন্স বা ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে নিয়মিত জেনেটিক সার্ভেইল্যান্স করা প্রয়োজন। ডেঙ্গুর প্রতিটি সেরোটাইপ ও তার সংক্রমণের ধরন নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা উচিত। সাধারণ জনগণ, চিকিৎসক ও নার্সদের ডেঙ্গুর নতুন ধরন ও ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।

বর্তমানে ঢাকার বাইরে অনেক শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং হাসপাতালের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশালসহ অন্যান্য শহরে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে ডেঙ্গুর বিস্তার সহজ হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাবদ্ধতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব নতুন শহরগুলোতে মশার বংশবৃদ্ধি বাড়িয়ে দিচ্ছে। শহরের বাইরে মানুষ বেশি ঘরের বাইরে কাজ করে। ফলে মশার কামড়ের ঝুঁকিও বেশি। এ বছর ঢাকার বাইরে বেশ কিছু জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জেলা শহরগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষিত জনবল ও বাজেট না থাকায় নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য। প্রতিটি জেলা ও শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু করা দরকার। ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের আবর্জনায় বৃষ্টির পানি জমা হয়ে যেহেতু মশা প্রজনন হয়, তাই পানির জমাট বাঁধা রোধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন। নতুন এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে নিয়মিত সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গু রোগে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রোগী উপজেলা বা জেলা শহরগুলো থেকে ঢাকায় স্থানান্তরে সময়ক্ষেপণের কারণে বেশি মারা গেছে। ডেঙ্গুর মৃত্যু কমাতে প্রতিটি জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই, শুধু সাপোর্টিভ কেয়ার দেওয়া হয়। কিন্তু রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে হাসপাতালগুলোর ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে। প্রতিবছর বর্ষা-পরবর্তী সময়ে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। স্যালাইন, প্যারাসিটামল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট তৈরি হয়। এ বছরের ডেঙ্গু মোকাবেলায় তাই পূর্বপ্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।

 

লেখক : কীটতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

professorkabirul@gmail.com

মন্তব্য

দেশ কারো একার নয়, দেশ সবার

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
দেশ কারো একার নয়, দেশ সবার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের পূর্বপুরুষদের অর্থাৎ এই অঞ্চলের মানুষের হাজার বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে অবিভক্ত বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম হিসেবে আবির্ভূত হলেও এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে একটি কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত মেলমন্ধন গড়ে উঠেছিল, যা তাদের এই উপমহাদেশের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় একটি ভিন্নতর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং জীবনাচরণ, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রসরতা এনে দিয়েছিল। নদীমাতৃক বাংলার ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থান, কৃষি-শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ এই অঞ্চলের মানুষের মন-মানসিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং জীবন দর্শনের ক্ষেত্রেও নিজেদের সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মতো একটি প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণের ছোট কয়েকটি পার্বত্য অঞ্চল বাদ দিলে বাংলাদেশ একটি সুবিস্তীর্ণ ও বিশাল সমতল ভূমি।

ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারাকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত করেছে। অসংখ্য নদ-নদী এই সমতল ভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এতে পলিমাটির সঞ্চার ও বিস্তার ঘটিয়ে বাংলাদেশের ভূমিকে অসামান্য উর্বরাশক্তি দান করেছে। সে জন্য প্রাচীন কাল থেকেই এই দেশ কৃষি ও শিল্পের জন্য খ্যাতি লাভ করেছে। এবং এই অঞ্চলের ওপর শ্যেনদৃষ্টি ছিল বহিঃশক্তির।
এই উপমহাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক পরাশক্তি কিংবা আধিপত্যবাদী শাসককুল ও ক্ষমতাধরদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বলয় থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার এক বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যা সব সময় তাদের দিয়েছে এক মুক্ত ও স্বাধীন জীবন-জীবিকার বলিষ্ঠ অভীপ্সা।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার দরুন উত্তর ভারতীয় শাসকদের অনেকেই নানাভাবে চেষ্টা করেও বাংলাদেশের ওপর তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কখনো কখনো কোনো কোনো সম্রাট বা শাসক যদিও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল দখল করতেন, তবু তাঁদের কর্তৃত্ব এখানে বেশিদিন স্থায়ী হতো না। বাংলার শাসকরা বারবার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।

এ জন্য বাংলার আরেক নাম ছিল বিদ্রোহের দেশ। মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে কয়েক বছর এবং গুপ্ত বংশীয় সম্রাটদের শাসনের কিছুকাল ছাড়া বাংলায় প্রাচীন কালে উত্তর ভারতীয় সম্রাটদের প্রভুত্ব স্থাপনের আর কোনো নজির নেই। মুসলিম আমলে আড়াই শ বছরেরও অধিককাল বাংলা স্বাধীন ছিল। তবে প্রাচীন যুগে বাংলাদেশে কোনো অখণ্ড কিংবা একক রাষ্ট্র বা রাজ্য ছিল না। বাংলাদেশ হিন্দু যুগের শেষ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত ছিল।
মুসলিম আমলে বাংলার সেসব খণ্ড নামের অবসান ঘটে এবং বাংলাভাষী পুরো অঞ্চল এক বাঙ্গালা বা বাংলা নামে অভিহিত হয়েছিল। ইলিয়াস শাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার খণ্ড খণ্ড অঞ্চলের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে এক বাঙ্গালা বা বাংলা নামে একটি রাজত্ব বা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতানি আমলের বাঙ্গালা নাম আর মোগল যুগের সুবা-ই-বাংলা ও ব্রিটিশ আমলের বেঙ্গল একই নাম। মোগল সম্রাট আকবরের দরবারের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবুল ফজল বলেছেন, বাংলার প্রাচীন নাম ছিল বঙ্গ। তবে বঙ্গ ও বাঙ্গালা থেকেই যে বাংলা নামটি এসেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, ইলিয়াস শাহি শাসনামল থেকে মোগল যুগ পর্যন্ত বাংলার মানুষ জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ছিল অত্যন্ত ঐক্যবদ্ধ, পরমতসহিষ্ণু এবং স্বাধীনতাপ্রিয়। কিন্তু ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী ভারতীয়দের ঐক্য ও স্বার্থ বিনষ্ট করে রাজনৈতিক কৌশলগতভাবে জনগণের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে শুরু করে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/30-03-2025/2/kalerkantho-ed-1a.jpgওপরে উল্লেখিত বিভাজন কিংবা বিভক্তির রাজনীতি চালু করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত লাভবান হয়নি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি। শেষ পর্যন্ত ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তারা। তবে পেছনে ফেলে গেছে এক বহুধাবিভক্ত কূটকৌশলগত বিশাল জনপদ, যেখানে পদে পদে আজও অসামান্য খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলার প্রকৃত স্বাধীনতাকামী মানুষকে। বাংলার সংগ্রামী জনগণের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, সেদিন তাঁদের বেশির ভাগই প্রস্তাবিত বিভক্ত উপমহাদেশের না ভারত, না পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত অংশে যেতে প্রস্তুত ছিল। তারা চেয়েছিল একটি অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গভূমি, যা তাদের পূর্বপুরুষরাও অতীতে চেয়েছিলেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থ ও ষড়যন্ত্রের কারণে সেদিন তাদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। সেদিন শুধু ব্রিটিশশাসিত এই উপমহাদেশই নয়, বিভক্ত হয়েছিল অখণ্ড বঙ্গভূমিও। সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতিগত স্বার্থের কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলার অগ্রসর মানুষের অতীতের চিন্তা-ভাবনা।

নতুন পর্যায়ে ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে যোগ দিয়েও শেষ পর্যন্ত টিকতে পারল না সেদিনের খণ্ডিত পূর্ব বাংলা। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন বিরোধ, ব্যবধান ও বৈষম্যের কারণে নবগঠিত পাকিস্তান নামক সেই রাষ্ট্রটি ভেঙে গেল। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ তার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনীতি এবং আর্থ-সামাজিক স্বার্থ, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত অধিকার ও স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার জন্য লড়েছিল ৯ মাসের এক সশস্ত্র সংগ্রাম। অনেক রক্ত বিসর্জন ও চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরে অর্জিত হয়েছিল এ দেশের মানুষের জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, যার নাম বাংলাদেশ। সাতচল্লিশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান নামক মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে এই অঞ্চলের বাঙালিরা যেমন পায়নি তাদের ন্যায্য অধিকার, মর্যাদা ও গৌরব, তেমনি একাত্তরের রক্তাক্ত সংগ্রামের পরও নিজেদের তথাকথিত স্বজাতির কাছ থেকে তারা পায়নি তাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। ফ্যাসিবাদ বা আধিপত্যবাদ, রাজনৈতিক নির্যাতন কিংবা অর্থনৈতিক লুটপাট ও শোষণ-বঞ্চনার কাছে পদদলিত হয়েছে তাদের অধিকার ও মুক্তির স্বপ্ন দেড় দশকেরও অধিক সময় ধরে। বাংলাদেশটিকে বিদায়ি শাসকগোষ্ঠী তাদের পারিবারিক সম্পত্তি কিংবা জমিদারি বলে মনে করেছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিসচেতন মানুষ যেমন ধর্মের নামে পাকিস্তানি শাসকদের ২৪ বছরের অগণতান্ত্রিক ও সামরিক স্বৈরশাসন মেনে নেয়নি, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে যারা বিগত দেড় দশকের বেশি সময় এ দেশের মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনা চালিয়েছে, তাদেরও মেনে নেয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আপসহীন সংগ্রামের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তথাকথিত ধর্ম কিংবা বাঙালি জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে অন্যায়, অবিচার, শোষণ-শাসন ও নৈরাজ্য চালিয়ে এ দেশে কেউ রেহাই পায়নি। এ দেশের মানুষ অধিকারসচেতন এবং আপসহীনভাবে সংগ্রামী। সে কারণেই প্রাচীন কাল থেকেই এ দেশকে উল্লেখ করা হয়েছে বিদ্রোহের দেশ হিসেবে।

সাতচল্লিশপূর্ব ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন-বিদ্রোহ কম হয়নি। ১৭৬০ সালে এবং তা ১৮০০ সাল পর্যন্ত এ দেশে ইংরেজ প্রশাসন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে ফকির ও সন্ন্যাসীরা একসঙ্গে সংগ্রাম করেছে। তারপর শুরু হয় নীল বিদ্রোহ। ১৮৫৯-৬০ সালের নীল বিদ্রোহের প্রচণ্ড আঘাতে বাংলায় নীল চাষ বিলুপ্ত হয়। বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের সূত্রপাত হয়েছিল এই বাংলায়ই। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তিতুমীর। বাংলার অধঃপতিত সমাজকে আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ করা এবং হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে এক ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন ফরায়েজি আন্দোলনের প্রবর্তক হাজি শরীয়তুল্লাহ। পলাশী যুদ্ধের পর পরাধীনতার যুগে বাংলার মানুষের অবস্থার চরম অবনতির কথা উপলব্ধি করেই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মাঠে নামেন। তার পর থেকে এ দেশের জনগণের অধিকার আদায় ও মুক্তির প্রশ্নে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু সে আন্দোলন-সংগ্রাম বা বিদ্রোহ চূড়ান্ত পর্যায়ে কোনো বিশেষ সাফল্যের মুখ দেখেনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আন্দোলনকারী কিংবা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব। সে আন্দোলন, অভ্যুত্থান কিংবা বিদ্রোহের সঙ্গে যদি ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার মহান অভ্যুত্থানের তুলনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যুগের অগ্রগতি ও উন্নত তথ্য-প্রযুক্তির কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অনেক সাফল্য পেয়েছে। মূলত রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সে অভ্যুত্থানে তারা একটি শক্তিশালী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে, যা অতীতের আন্দোলনকারী কিংবা বিদ্রোহীরা পারেনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নন। তবু তাঁদেরই লাগাতার জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা তখন তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের হাতে ক্ষমতা তুলে নিতে পারেনি। তাদের শরণাপন্ন হতে হয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ দেশের কিছু প্রতিষ্ঠিত অরাজনৈতিক মানুষের। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য। সে কারণেই ছাত্র-জনতার সেই গণ-অভ্যুত্থানকে জনগণের বিপ্লব বলা যায় না। কারণ বিপ্লব সংগঠিত করতে হলে একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক দল থাকতে হয়, যারা বিপ্লবোত্তরকালে দেশ পরিচালনা করবে। যত প্রয়োজনীয় সংস্কার কিংবা পরিবর্তন, সেটি সেই বিপ্লবী দলই করবে। গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র-জনতা সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রশ্নে এখন বিএনপিসহ দেশের বিভিন্ন দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা যখন বলছেন রাষ্ট্র মেরামতের সুযোগ হারানো ঠিক হবে না, তখন বিএনপিসহ অনেকে বলছে, নির্বাচনসংশ্লিষ্টতার বাইরে আপাতত কোনো সংস্কারের প্রয়োজন নেই। এর পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নেতারা বলছেন, আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার, তারপর নির্বাচন। এই পরিস্থিতিতে অনেকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগেই এসব বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত ছিল। তাদের নির্দিষ্ট করে বলা উচিত ছিল, তারা কত দিন ক্ষমতায় থাকবে এবং সে সময়ে তাদের কোন কোন দায়িত্ব সম্পাদন করতে হবে। সে অন্তর্বর্তী সময়ে অর্থাৎ একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত দেশে জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকবে কি না।

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বা অর্জনকে আখ্যায়িত করছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বা নতুন বাংলাদেশ হিসেবে। তারা এটিকে সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) হিসেবে ঘোষণা করতে চায়। এ ব্যাপারে আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বিমতও রয়েছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, একাত্তর ও চব্বিশ আলাদা কিছু নয়, বরং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই একাত্তরের স্পিরিট পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীন বাংলাদেশ বাঙালি জাতির জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। একাত্তরে বাঙালি জাতি ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে যে স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে, তাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, তার পরবর্তী সময়ে ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান কিংবা জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে একটি মহান গণ-অভ্যুত্থান। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে পরবর্তী পরিবর্তনগুলো সংঘটিত হতো না। সে কারণেই ২০২৪-এ সংঘটিত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান একাত্তরের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এ ক্ষেত্রে যারা একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কম গুরুত্ব দিতে চায়, তারা আসলে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিভিন্ন বিতর্কিত প্রশ্নের সম্মুখীন করে আমাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করতে চায়। একাত্তরে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা একটি বহুতল সুউচ্চ ভবনের মতো। আমাদের জাতির ইতিহাসে যতই দিন যাচ্ছে, ততই সেই ভবনটি আরো উচ্চতর হচ্ছে, তার ভিত্তি আরো মজবুত হচ্ছে। প্রাচীন কাল থেকেই এই উপমহাদেশের বাংলাভাষী জাতিগোষ্ঠীর স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

এ কথা ঠিক যে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে অতীতে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, অনেক জাতীয় স্বার্থবিরোধী মানুষও দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল, কিন্তু দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে তাদের সব অপচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং একাত্তর কিংবা চব্বিশ নিয়ে মনগড়া বিতর্ক সৃষ্টির ফল হবে জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থ বিনষ্ট করা। নিজেদের মধ্যে অহেতুক মতবিরোধ কিংবা বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করা। এতে আমাদের দেশপ্রেম এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে পারে। জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দল বা মতের মানুষের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। আমাদের জাতীয় জীবনে সেটি একটি অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত বিষয়। এ দেশ আমাদের সবার। এ দেশ আমাদের পূর্বপুরুষেরও। কারণ প্রাচীন কাল থেকে তাঁরাও স্বাধীন বাংলাদেশ নামে একটি ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই আমাদের সব বিতর্কের উর্ধ্বে থাকতে হবে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নগুলোকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশ প্রকৃত অর্থেই হবে এক মহান বাংলাদেশ

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

মন্তব্য

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের শাটল ডিপ্লোমেসি

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের শাটল ডিপ্লোমেসি

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’ বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। দুই পক্ষের মধ্যে যখন সংঘাত চলে এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সংঘাত নিরসনের কোনো সম্ভাবনা থাকে না কিংবা দুই পক্ষের কেউ কাউকে একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়, এমন অবস্থায় তৃতীয় এবং শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় এই সংঘাত বন্ধের জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, সংক্ষেপে একেই শাটল ডিপ্লোমেসি বলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে শাটল ডিপ্লোমেসির উদ্যোক্তা বলা হয়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত এবং পরবর্তী সময়ে একে কেন্দ্র করে আরব রাষ্ট্রগুলোর তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাকে নিয়ে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

সে সময়কার দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সংঘাত নিরসনের উদ্যোগের কথা ভাবছিল, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বিষয়টি আগে থেকেই অনুধাবন করে নিজে উদ্যোগী হন। তিনি সে সময়কার দ্বন্দ্বগুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে বিদ্যমান সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে অসংখ্যবার তেল আবিব, কায়রোসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজধানী সফর করে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যকার বার্তাগুলো আদান-প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যার ফলে সে সময় মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যকার ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যদিও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে সংকটের একটি আপাত সমাধানে এই উদ্যোগের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ব্যাডমিন্টন খেলায় শাটল যেমন দ্রুত স্থান বদল করে, এই শাটল ডিপ্লোমেসিতেও মধ্যস্থতাকারী দ্রুত এক পক্ষের বার্তা অন্য পক্ষের কাছে পৌঁছে দিয়ে সংকটের ‘নিরপেক্ষ’ সমাধানে প্রয়াসী হন। তবে এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় যে এই মধ্যস্থতাকারীকে অবশ্যই হতে হবে একটি শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের শাটল ডিপ্লোমেসিওপরের এই ভূমিকাটি দেওয়ার কারণ হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় দুটি সংকটের মধ্যে একটি হচ্ছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এবং অপরটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর মধ্যে তিন বছরাধিক কাল ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ১০ লক্ষাধিক মানুষ শরণার্থী হিসেবে অন্যত্র চলে গেছে এবং অসংখ্য মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হয়েছে। এরই মধ্যে শক্তিশালী রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইউক্রেন তার ২০ শতাংশ ভূমির দখল হারিয়েছে এবং যেকোনো সময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে। পশ্চিমাদের সুস্পষ্ট সমর্থন থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এ নিয়ে খোদ পশ্চিমাদের মধ্যেই বিভাজিত অবস্থা তৈরি হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধে সামরিক ও আর্থিকভাবে সমর্থনের জন্য তার পূর্ববর্তী বাইডেন প্রশাসনের ভুল নীতিকে দায়ী করে তাঁর প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আর কোনো ধরনের সহযোগিতা চালিয়ে যেতে অপারগতা প্রকাশের পর ইউক্রেনের বিপক্ষে রাশিয়া সুস্পষ্টভাবে বিজয়ী অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনসহ গোটা ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাজনিত হুমকির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবং এই সংকটের একটি যৌক্তিক সমাধানের জন্য তিনি নিজ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে সৌদি আরবের রিয়াদকে বেছে নিয়েছেন এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিজের প্রতিনিধি পাঠিয়ে আলোচনা করছেন। কয়েক দফা এই আলোচনার এক পর্যায়ে গত ১৮ মার্চ তিনি সরাসরি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী টেলিফোনে কথা বলেন। এর ঠিক পরদিনই তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা ফোনালাপ করেন।
উভয় নেতার সঙ্গে ফোনালাপ শেষে তিনি তাঁর সন্তুষ্টি ব্যক্ত করে বলেন, ‘আলোচনা ভালোভাবেই এগোচ্ছে এবং শিগগির এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি ভালো সংবাদ আসতে যাচ্ছে।’ এর সুফল হিসেবে এরই মধ্যে রাশিয়ার তরফ থেকে ইউক্রেনের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না চালাতে ট্রাম্পের অনুরোধে সম্মতি দিয়েছেন পুতিন। এরপর রিয়াদের পরবর্তী ধাপের আলোচনায় দুই পক্ষের মধ্যে আরো কিছু সমঝোতা হয়েছে, যা দ্রুতই একটি যুদ্ধবিরতির জোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

গত ২৫ মার্চ রাশিয়ার ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এক মাসের  জন্য (ট্রাম্প-পুতিন আলোচনার পর গত ১৮ মার্চ থেকে) ইউক্রেনের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে পারমাণবিক স্থাপনার বাইরেও রয়েছে তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র, বৈদ্যুতিক স্থাপনা এবং খাদ্য মজুদ ব্যবস্থায় হামলা না করা। মোটাদাগে দুই পক্ষই একে অপরের এনার্জি ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য মজুদ ব্যবস্থার ওপর হামলা থেকে বিরত থাকবে এবং কোনো এক পক্ষ এটি ভঙ্গ করলে অপর পক্ষও আর এটি মেনে চলতে বাধ্য নয়। এখানে উল্লেখ্য, রাশিয়ার তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে যে তারা এটি মেনে চললেও ইউক্রেন এরই মধ্যে রাশিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বেশ কিছু ক্যামিকাজ ড্রোন নিক্ষেপ করেছে, যা রাশিয়া ভূপাতিত করেছে। তারা বলছে, ইউক্রেনের তরফ থেকে ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে চলা হচ্ছে না। এর ফলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন পাল্টা হামলায় নতুন করে ইউক্রেনের কিছু বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে আশার কথা যে মার্কিন মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে রিয়াদ আলোচনা এখনো চলমান এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরের পথে অনেকটাই ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

রাশিয়ার এ ক্ষেত্রে দাবি স্পষ্ট। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার স্বপ্ন পরিত্যাগ করতে হবে, রুশ বাহিনী কর্তৃক দখলকৃত ইউক্রেনের ভূমি রাশিয়ার বলে স্বীকার করে নিতে হবে, ইউরোপীয় দেশগুলো কর্তৃক ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে এবং ২০২২ সালের বসন্তে ইস্তাম্বুল-রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তির বাস্তবায়ন করতে হবে। কী ছিল ইস্তাম্বুল-রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তিতে? ইউক্রেনের সামরিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, সেনাবাহিনীর আকার সীমিত করা এবং ইউক্রেনে বসবাসরত রুশ ভাষাভাষীদের সুরক্ষা দেওয়া। এসব বিষয়ও আলোচনা হয়েছে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে। এত কিছুর পর ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে এটিই স্পষ্ট যে ট্রাম্প যেকোনো শর্তেই এই যুদ্ধ বন্ধ করতে চান এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ নিশ্চিত করতে চান। এ ক্ষেত্রেও অবশ্য নিরপেক্ষতার একটি বড় ধরনের ব্যত্যয় থেকে যায়।

আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধের মধ্য দিয়ে নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও কূটনৈতিক বিবেচনায় কিন্তু রাশিয়াই শতভাগ এই যুদ্ধের ফলাফল নিজেদের করে নিতে যাচ্ছে। ২০০৮ সালের বুখারেস্ট সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করে নিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইউরোপীয় নেতাদের চাপ দেন। আজ ১৭ বছর পর এসে আনুষ্ঠানিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের দেওয়া চাপ থেকে সরে আসতে হচ্ছে। এটি এক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে রাশিয়ার এক বড় ধরনের বিজয় অর্জন।

ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যকার আলোচনায় পুতিনের পক্ষ থেকে উপরোক্ত দাবিগুলো মেনে না নিলে যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে অনীহা প্রকাশ করা হয়েছিল। দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপের আগে এবং পরে রিয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের কয়েক দফা আলোচনার মাঝেও দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল, যেখানে রাশিয়া একের পর এক ইউক্রেনের ওপর তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখছিল। এর বিপরীতে মার্কিন সমর্থন হারিয়ে ইউক্রেন ধুঁকছিল।

সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে রাশিয়া ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুসারে কেবল ইউক্রেনের জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে এবং এই সময়ের মধ্যে আলোচনার ফলাফল তাদের অনুকূলে গেলে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে তারা সম্মত হবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার হয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নিজ থেকেই। আর এর কারণ একটিই, দীর্ঘ মেয়াদে ইউক্রেনের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখা। তবে এর বিনিময়ে রাশিয়াকে ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য শঙ্কা হওয়া থেকে বিরত রাখতে হলে তাদের দাবিগুলো মেনে নিতেই হবে। একই সঙ্গে এটিও ধারণা করা হচ্ছে যে দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপে রাশিয়ার ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এটি প্রত্যাহারের বিষয়ে ট্রাম্পের সম্মতি থাকতে পারে। আর এমনটি হলে এটি ইউরোপের জন্যও একটি বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।

আপাতত যুদ্ধ বন্ধ এবং একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি কেবল ইউরোপ নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থের প্রতিকূলে যেতে পারে। একদা ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক উত্থানকে গ্রহণ না করে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের শক্তি দিয়ে তা মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে, যা থেকে রাশিয়া ক্রমেই নিজেদের নিরাপত্তা উদ্বেগ থেকে আগ্রাসী হয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় পুতিনের একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বে রাশিয়া কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বের শক্তির প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করেছে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com   

 

 

 

মন্তব্য
সেলাই করা খোলা মুখ

সবার আগে জাতীয় ঐক্য

    মোফাজ্জল করিম
শেয়ার
সবার আগে জাতীয় ঐক্য

জাতীয় পর্যায়ে ছোট-বড় যেকোনো আন্দোলন বা কর্মসূচির সাফল্যের জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ একাত্তরের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তখন আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ওই সময় মুষ্টিমেয় দু-একটি জনসমর্থনশূন্য রাজনৈতিক দল ব্যতীত বাকি সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। তবে হ্যাঁ, যে ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তখন সারা দেশ যাচ্ছিল, তাতে হয়তো মুখ ফুটে বেশির ভাগ মানুষই স্বাধীনতার সপক্ষে কথা বলতে পারত না।

২৫ মার্চের পর পাক বাহিনী যেভাবে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল, তাতে প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের আগে ১০ বার ভেবেচিন্তে নিজে নিজেই ওটাকে সেন্সর করতে হতো। তবে তখন যদি গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত জরিপ করা হতো, তাহলে শতকরা ৯৮টি ভোট যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে পড়ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাকি দুই ভোট ছিল পাকিদের নুন-নিমক মালাই-মাখনের উচ্ছিষ্টভোগীদের, যারা যুদ্ধের পুরো ৯ মাস মনে করত তাদের প্রভু পাকিরা জিতবে, তারা অজেয় অমর। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যখন গণেশ উল্টে গেল, তখন গুরু সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় বলা যায় : হায়রে বিধির লেখা, হায়রে কিসমত, জহর হইয়া গেল যা ছিল শরবত।

সবার আগে জাতীয় ঐক্যস্বাধীন বাংলাদেশের গত দেড় দশকের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে পাক আমলের সঙ্গে কোথায় যেন কিছুটা হলেও মিল পাওয়া যায়। এখানেও মানুষের মনে যতই কষ্ট, যতই প্রতিবাদ জমা হোক না কেন, তা প্রকাশ করতে গেলেই ছিল বিপদ। গুম খুন ক্রসফায়ার মামলা হামলা ইত্যাদির ডেমোক্লিসের তরবারি সব সময় মাথার ওপর ঝুলত। স্বৈরাচারী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হলেও সাহস করে কেউ প্রতিবাদ করতে পারত না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাবে কোনো আন্দোলন বা সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি।

অবশেষে এলো জুলাই চব্বিশের তারুণ্যনির্ভর আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের কিছু অন্যায্য নীতিমালার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা গড়ে তুলল ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত একটি আন্দোলন, যাকে বলা হলো কোটাবিরোধী আন্দোলন। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য সমর্থন ছাড়াই রাজপথে নামল বিপুল জনসমর্থন নিয়ে। শিক্ষার্থীরা যখন একাত্মতা ঘোষণা করে ওই নাম-গোত্রহীন মানুষের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়াল, তখন ছাত্র-জনতার এই অভূতপূর্ব সম্মিলন শাসকগোষ্ঠীর ভিত দিল কাঁপিয়ে।

তারা ভাবল, এহিয়া-আইউব কিংবা তাঁদের পূর্বপুরুষ হিটলারের ফেলে যাওয়া বন্দুক মেরে এই গণ-আন্দোলন দমন করবে। ফলে চালাও গুলি, মারো নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। ব্যস, ওটাই ছিল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেলস ব্যাক। মনে হলো ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর গণজাগরণ দেখল বাংলার মানুষ। এখানে পাদটীকায় আমাদের বক্তব্য হচ্ছে : সবই সম্ভব হয়েছে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে। ছাত্ররা যদি তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে একা একাই অগ্রসর হতোশুরুতে যেমনটি তারা করেছিলকিংবা জনগণ তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন অন্য কোনো পক্ষকে সঙ্গে না নিয়ে চালিয়ে যেত, তাহলে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অভিধায় অভিহিত বিশাল গণজাগরণ আমরা দেখতে পেতাম না।

নিবন্ধের গোড়াতেই আমরা বলেছি, এই ভূখণ্ডে ঐক্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। শুরুতে যা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন, দাবিদাওয়া আদায়ের কৌশল, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিসংগ্রামে সারা দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তা-ই রূপ নেয় এক জাতি এক দেশ বাংলাদেশ-এর স্লোগানে, তথা মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৪৭ থেকে ২৪ বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার ইতিহাস বাঙালিকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, পাকিদের সঙ্গে আর এক দিনও থাকা চলবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমরা ছিলাম সুবিধাবঞ্চিত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পাকিরা মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাভোগীকে সঙ্গে নিয়ে রীতিমতো শাসন-শোষণ করছিল পূর্ব বাংলাকে। অনেক জেল-জুলুম, হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের পর একাত্তরে যখন একটি অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয় বাংলার মানুষের ওপর, তখন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, বাঙালি-পাহাড়ি, ধনী-গরিব সবাই উপলব্ধি করল, এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এবং তা হতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। একাত্তরে প্রকাশ্যে হয়তো সবাই মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা বলতে সাহস পেত না, কিন্তু এ দেশের সব মানুষের অন্তরে স্বাধীনতার দীপশিখাটি প্রজ্বলিত ছিল। ফলে রণক্ষেত্রে অস্ত্রহাতে হয়তো যুদ্ধ করেছে দুই লক্ষ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে গেছে তারা, আর সারা দেশের ঘরে ঘরে কোটি কোটি মানুষ ছিল তাদের সপক্ষে। এমন জাতীয় ঐক্য বিদ্যমান ছিল বলেই একটি সম্পূর্ণ অসম যুদ্ধে একটি দানবীয় শক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। সেই ঐক্য ছিল ইস্পাতকঠিন। কোনো লোভ-লালসা, কোনো প্রাপ্তির হাতছানি ফাটল ধরাতে পারেনি সেই ঐক্যে।

কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বিজয় অর্জনের পর যে কলুষিত অধ্যায় সূচিত হলো এ দেশের ইতিহাসে, তা-ই গ্রাস করতে লাগল সব স্বর্ণোজ্জ্বল অর্জনকে। কোথায় রইল জাতীয় ঐক্য, কোথায় উবে গেল একটি নির্যাতন-নিষ্পেষণমুক্ত সাম্য-সম্প্রীতির বাংলাদেশের স্বপ্ন। ক্ষুধার্ত শ্বাপদের মতো এক শ্রেণির ক্ষমতাশালী মানুষ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশটাকে খামচে-খুবলে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ছাড়ল। এই অন্যায় অবিচার নির্যাতনের মাশুল জাতিকে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী যাবৎ শোধ করতে হলো।

এর পরেই এলো ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের ঘুরে দাঁড়ানোর সফল আন্দোলন। স্বল্পমেয়াদি সেই আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখল ছাত্র-জনতার ঐক্যের কারণে। দীর্ঘদিনের অত্যাচারী স্বৈরশাসক য পলায়তি স জীবতি’—এই আপ্তবাক্য জপতে জপতে হেলিকপ্টারে চড়ে পালালেন। এই দেশেরই এক রাজা একদা খিড়কি দুয়ার দিয়ে প্রাণ নিয়ে যেভাবে পালিয়েছিলেন সেভাবে। আর দীর্ঘদিন চেপে থাকা এই সিন্দবাদের ভূতকে নামানো সম্ভব হয়েছে ওই জাতীয় ঐক্যের কারণে। জেল-জুলুম, খুন-গুম ও আয়নাঘরের ভয়ে মুখে না বললেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল এমন একটি পরিণতি দেখার জন্য।

এখন সবার একটাই প্রত্যাশা, সিন্দবাদের ভূতকে তো নামানো গেল, এরপর কী? নিশ্চয়ই স্বপ্নের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে পাওয়া, যার জন্য জাতি গত দেড় যুগ অনেক মূল্য দিয়েছে। আর সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নানাজনের নানা মত ও পথের ঠিকানা থাকতে পারে। তবে এক জায়গায় তো সংশ্লিষ্ট সবাইকে একমত হতে হবে : যে  করে হোক একটি সুন্দর সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এবং তা যত দ্রুত সম্ভব, ততই মঙ্গল। নইলে আবার সুযোগসন্ধানীরা জল ঘোলা করে ফেলবে। এত দিনের দুঃখ-কষ্টে, ত্যাগ-তিতিক্ষায় যা কিছু অর্জন, তা যাবে হারিয়ে। শেষ কথা তাই, জাতীয় স্বার্থে চাই জাতীয় ঐক্য, যার কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

mkarim06@yahoo.com

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ