বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘নয়াদিল্লির মনে রাখা উচিত তাদের দেশে মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে।’
ভারতের পাক্ষিক ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) ম্যাগাজিনটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
ফ্রন্টলাইনের এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা গণনার একাধিক উপায় আছে।
কেউ অস্বীকার করে না যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। পুলিশ বাহিনী বিপর্যস্ত ছিল। কিছু সময়ের জন্য নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর হাতে চলে গিয়েছিল, তবে পরিস্থিতি অস্থির ছিল।’
উপরন্তু বাংলাদেশের অনেক ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঐতিহাসিকভাবে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে।
সুতরাং কিছু ক্ষেত্রে কোনো হিন্দু ব্যক্তির ওপর হামলা তার ধর্মের কারণে ছিল নাকি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমর্থক হওয়ার কারণে ছিল, তা আলাদা করা কঠিন। তবে আরেকটি দিক বিবেচনা করার আছে। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা—যেমন হিন্দু ও বৌদ্ধরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। একইভাবে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা—যেমন মুসলমানরা বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
সুতরাং ভারত যখন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে হওয়া আচরণ নিয়ে মন্তব্য করে, তখন দেশটিকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তার নিজের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কী আচরণ হচ্ছে, সেটাও অন্যরা খতিয়ে দেখছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন সদস্য হয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশে নিরাপদ কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি হয়তো এ প্রশ্নের জন্য সেরা উদাহরণ নই। আমি দুইবার ভারতে শরণার্থী হয়েছিলাম। প্রথমবার, ১৯৬০-এর দশকের দাঙ্গার পর—১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়বার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। কিন্তু আমার মা-বাবা কখনোই বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি।
আমি ফিরে এসেছি, আমার মাতৃভূমিতে বিনিয়োগ করেছি এবং এখানেই আমার জীবন গড়েছি। আমি আমার দেশের জন্য অবদান রাখতে গিয়ে মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পদ ছেড়ে দিয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার পরিবারের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমার মা আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য ছিলেন এবং আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। কিন্তু এই ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো আমার পেশাদারি এবং তথ্যভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে না।’
ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশে থাকার ঝুঁকিগুলো মেনে নিয়েছি। তবে আমি বিশ্বাস করি যে পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি যেখানে একটি ভূমিকা রাখে, এমন যেকোনো দেশের যেকোনো নাগরিকের জন্যই এ ধরনের ঝুঁকি বিদ্যমান। আমি আরো বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার এবং সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের—হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘু এবং সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর—সুরক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্তর্ভুক্তির প্রতি এই অঙ্গীকারই জাতি গঠনের মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে বহুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘বিষয়টি এখনো আলোচনার টেবিলে। এই পর্যায়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো অপরিণত কাজ হবে, কারণ এটি এখনো পর্যালোচনাধীন।’