আজ ২৯ চৈত্র, শনিবার। আর এক দিন পর (সোমবার) পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। বাঙালির আবেগের, আনন্দের, নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার দিন পহেলা বৈশাখ। হ্যাঁ, বর্ষ শুরুর প্রথম দিনটির পর আমরা আর মনে রাখি না, মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করি না বাংলা বর্ষপঞ্জিকে।
রাজভাষা ছিল ফারসি। প্রাধান্য ছিল ইসলামী তাহজিব-তমদ্দুনের। আর বাংলা? বাংলা সাল-তারিখ চালু ছিল, হ্যাঁ একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়েই ছিল, বাংলার গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে, তাদের দলিল-দস্তাবেজে, তাদের কৃষিনির্ভর জীবনযাপনে। তাদের জানতে হতো বাংলা কোন মাসের কত তারিখে হাল-জোয়াল নিয়ে মাঠে নামতে হবে, রবিশস্য ফলাতে হবে কবে, গোয়ালঘর থেকে গরুগুলোকে বের করে বাথানে দিয়ে আসতে হবে কবে ইত্যাদি। বাংলার কৃষকের জীবনের রুটিন আজও বাঁধা আছে বাংলা মাসের সঙ্গে। সেখানে বাদশাহি আমলের আরবি-ফারসি কিংবা ইংরেজ শাসনামলের রাজভাষা ইংরেজি প্রবেশাধিকার লাভ করেনি। গ্রামীণ জীবনের ভাষা-সংস্কৃতি তাই কয়েক শতাব্দীর সহাবস্থানের পরও স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছিল।
তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তারের ফলে সেই স্বকীয়তা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। এখন যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হওয়ায়, প্রায় সব ধরনের যানবাহন সহজলভ্য হওয়ায়, সর্বোপরি আধুনিক জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ মুঠোফোন কৃষকের মুঠোর ভেতর ঢুকে পড়ায় গ্রামীণ কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে সূচিত হয়েছে বড় পরিবর্তন। এখন গ্রামীণ জীবনে বলা যেতে পারে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এতে রাস্তাঘাটের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বড় একটি ভূমিকা রেখেছে পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় মানুষের ঘরে ঘরে এখন টিভি-ফ্রিজ। কেবল প্রান্তিক গ্রামবাসীরা এখনো এসব বিলাসিতার মুখ দেখেনি।
অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সাংস্কৃতিক জীবন। এখন আর সন্ধ্যা হলেই পুথিপাঠ, জারিগান-সারিগানের আসর বসে না বর্ধিষ্ণু গৃহস্থের বাড়ির বৈঠকখানায়, কিংবা সযত্নে নিকোনো ঝকঝকে আঙিনায় হাতে হাতে ফেরে না ডাবা হুঁকো। আগে যেখানে গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ছিল ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’, সেখানে এখন পায়-পরবে উৎসব হয় নিতান্ত দায়সারা গোছের। মেলা হয়, কিন্তু সেই মেলায় আর আগের জৌলুস নেই। বর্ষশেষে চৈত্রসংক্রান্তির মেলার আয়োজন করতেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তাতে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে দেশবাসী সবাই অংশগ্রহণ করতেন পরম উৎসাহে। মনে পড়ে, ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরও আমরা আমাদের শৈশবে ওই সব মেলায় গেছি বড়দের হাত ধরে, আর মেলা থেকে ফিরেছি দুহাত ভরে মণ্ডা-মিঠাই, মাটির পুতুল, হাতি-ঘোড়া-নৌকা ইত্যাদি নিয়ে। কোথায় গেল সেই সব গ্রামীণ আনন্দ-উৎসবের দিন।
এখানে একটি কথা না বললে সত্য গোপনের অভিযোগ উঠতে পারে। বাঙালি জীবনে পায়-পরবে একটি বড় ভূমিকা ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে যাত্রা-থিয়েটার, সংগীতানুষ্ঠান এবং মেলা ইত্যাদির মুখ্য আয়োজক ছিলেন তাঁরাই। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রতিবেশীরা এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন কিংবা পালন করতেন নীরব দর্শকের ভূমিকা। এরূপ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল অপূর্ব। দেশভাগের পর সংখ্যালঘু সনাতনধর্মীদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে বর্ণহিন্দুরা, দেশত্যাগ করে চলে গেলে গ্রামীণ জীবনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়। ফলে পূজা-পার্বণ উপলক্ষে যাত্রা-থিয়েটার বা গান-বাজনার আয়োজন বন্ধই হয়ে গেছে বলা চলে। এখন আর মেলা কিংবা হালখাতা অনুষ্ঠান আগের মতো জমে না। পহেলা বৈশাখ উদযাপনেও সেই আগের রমরমা নেই।
দেশভাগের অর্থাৎ ১৯৪৭-এর আগে আমার জীবনের শুরুতে বাংলাদেশের কুলাউড়া উপজেলা (জেলা মৌলভীবাজার) ও মৌলভীবাজার সদরে বসবাসের স্মৃতি থেকে বলছি, মোটামুটি মুসলমান অধ্যুষিত ওই অঞ্চলে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল, যা আজ এত বছর পরও মাশাল্লাহ অটুট আছে। তখন সারা দেশে পূজা-পার্বণ হতো আনন্দমুখর পরিবেশে, যেমনটি এখনো হয়। (আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু দেশের এক শ্রেণির ‘হলুদ সাংবাদিকরা’ যতই কুৎসা রটাক না কেন।) তবে কোনো কিছুতেই কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। আমি ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬—ছয় বছর আমার স্কুলজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ছিলাম বগুড়া (১৯৫০-৫৪) ও মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালীতে (১৯৫৪-৫৬)। ওই দুই জেলাতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল অতুলনীয়, যদিও দেশভাগের আগে আগে কলকাতার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নোয়াখালীতে কিছু খণ্ড খণ্ড দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
তবে যে ঘটনাটিকে জোর দিয়ে বলার জন্য এই নিবন্ধের অবতারণা তা হচ্ছে, ধর্মকর্ম পালনে বা আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকর্মে কোনো অহেতুক বাড়াবাড়ি ছিল না। পহেলা বৈশাখে সবখানেই ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ বলে আবাহনী সংগীত গীত হতো, নৃত্যগীতে ভরপুর অনুষ্ঠানাদি হতো, দোকানিরা হালখাতা অনুষ্ঠান করতেন, মিষ্টিমুখ করাতেন অভ্যাগতদের, এবাড়ি-ওবাড়ি সবাই মিষ্টি বিতরণ করতেন, প্রত্যেক গৃহে সাধ্যমতো ভালো-মন্দ খাবার-দাবারের আয়োজন হতো, কিন্তু কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না।
আর এখন যে কী একটা শোভাযাত্রা বের করা হয় তার নামনিশানাও ছিল বলে মনে পড়ে না। আর তাতে যে জাতীয় জীবনে কোনো ‘অমঙ্গল’ সূচিত হয়েছিল, তা-ও মনে হয় না। কেউ যদি বলেন, ওটা বাহুল্য এবং অনাবশ্যক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে, তাহলে কি খুব ভুল হবে।
এমনিতেই আমরা অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছি, পহেলা বৈশাখের মতো একটি সর্বজনীন উৎসবকে কোনো অনভিপ্রেত বিতর্কের মধ্যে ঠেলে ফেলে না দিলেই মঙ্গল। ওই মঙ্গলের জন্য ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামক বিতর্কিত কিম্ভূতকিমাকার কোনো আয়োজনের প্রয়োজন দেখি না। সবাইকে নববর্ষের (১৪৩২) আন্তরিক শুভেচ্ছা।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com