<p>পূর্ণ ৩৭ সপ্তাহ গর্ভকালের আগে জন্ম নেওয়া শিশুকে বলা হয় অকালজাত বা প্রি-ম্যাচিউর। প্রিম্যাচিউর বেবি সাধারণত স্বল্প জন্ম ওজনের (২৫০০ গ্রাম বা আড়াই কেজির কম) হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি তিন নবজাতক শিশুর মধ্যে একজন স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মায়।</p> <p><img alt=" কিভাবে অপরিণত শিশুর যত্ন নিতে হয়" height="627" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/16-11-2024/899900.jpg" style="float:right" width="300" /></p> <p><strong>শিশু অপরিণত হয়ে জন্ম নেয় কেন</strong></p> <p>► মায়ের অল্প বয়সে গর্ভধারণ। তিন বছরের কম বিরতিতে বারবার সন্তান ধারণ। একসঙ্গে একাধিক সন্তান প্রসব।</p> <p>► মায়ের দীর্ঘমেয়াদি নানা অসুখ, বিশেষত উচ্চ রক্তচাপ (প্রি-একলাম্পশিয়া), কিডনি রোগ, হৃদরোগ, ইউটিআই এবং অপুষ্টি।</p> <p>► গর্ভকালীন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান, অ্যালকোহল ও অন্যান্য মাদকাসক্তি।</p> <p>► গর্ভভ্রূণের ক্রমোজোম ত্রুটি-বিচ্যুতি, সংক্রমণ।</p> <p>► গর্ভফুলের বিবিধ জটিল অবস্থা—প্রিভিয়া, ইনফেকশনস, স্বল্প ওজন প্রভৃতি।</p> <p> </p> <p><strong>শারীরিক বৈশিষ্ট্য</strong></p> <p>পূর্ণ গর্ভকালের আগেই জন্ম নেওয়া শিশুর শারীরিক বৈশিষ্ট্য আলাদা রকমের।</p> <p>► জন্ম ওজনের ওপর ভর করে প্রি-ম্যাচিউর বেবির নানা অবস্থা লক্ষ করা যায়। যেসব অকালপ্রজ নবজাতক ১০০০ থেকে ১৫০০ গ্রাম ওজন নিয়ে জন্মায়, জন্মমুহূর্ত থেকে সে খুব নেতানো থাকে। ঘাড় এক পাশে পড়ে থাকে, হাত-পা নড়াচড়া করে না বললেই চলে, কান্না খুব ক্ষীণ আওয়াজের হয়। ততোধিক দুর্বল থাকে তার রিফ্লেক্স কর্মকাণ্ড। তার ঘুম বা জাগরণ ভাবের মধ্যে তেমন পার্থক্য থাকে না। খিদের কান্না থাকে না বললেই চলে। একই সঙ্গে খাওয়ার সামর্থ্যও থাকে বেশ কম।</p> <p>► সে তুলনায় ১৫০০ থেকে ২০০০ গ্রাম ওজনের মধ্যে জন্মানো নবজাতক শিশুর মাংসপেশির চালনা বেশি সক্রিয় থাকে। মরোস, গ্র্যাসপ ইত্যাদি রিফ্লেক্স অটুট থাকে। সতর্কভাবে তাকাতেও সে সক্ষম।</p> <p>► প্রি-ম্যাচিউর, কিন্তু জন্ম ওজন ২০০০ থেকে ২৫০০ গ্রাম নিয়ে জন্মানো নবজাতক শিশুর নড়াচড়া, মাংসপেশির সঞ্চালন যথেষ্ট ভালো। এরা সুস্থ স্বাভাবিক নবজাতকের মতো কাঁদে, সতর্কভাবে তাকায়, বুকের দুধ বেশ ভালোভাবে খেতে পারে।</p> <p> </p> <p><strong>অপরিণত শিশুর প্রধান অসুবিধা</strong></p> <p>জন্ম-পরবর্তী নানা প্রতিকূল সমস্যায় পড়তে পারে এরা। যেমন—বিভিন্ন ধরনের এনজাইমের অপরিণত অবস্থা, শ্বাসতন্ত্র, কিডনি ও বিপাকক্রিয়াগুলোর দুর্বলতা, রক্ত উপাদানে নানা অসুবিধা, রোগ প্রতিরোধক সিস্টেমের গলদ, অত্যধিক হারে নানা রকমের জন্মত্রুটি প্রভৃতি। কখনো শারীরিক সক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তির দৌড়েও পিছিয়ে থাকে এরার। প্রধান অসুবিধাগুলো হলো—</p> <p>► শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে না পারা</p> <p>► খাবার গ্রহণে অসুবিধা</p> <p>► ইনফেকশনের ঝুঁকি, যেমন—আন্ত্রিক সংক্রমণ এনইসি</p> <p>► আরডিএস, নিউমোথোরাক্স, এপনিয়া প্রভৃতির কারণে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা</p> <p>► খাদ্যপ্রাণ, খনিজ পদার্থসহ বাড়তি কিছু বিশেষ পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা</p> <p>► ব্রেইনের বিকাশঘটিত কিছু কিছু জটিলতা</p> <p> </p> <p><strong>চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা</strong></p> <p>অপরিণত শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিয়ে হয়। এ ধরনের শিশুদের প্রয়োজনে ইনকিউবেটরে রাখতে হয়।</p> <p> </p> <p><strong>ইনকিউবেটরে যত্ন-আত্তি</strong></p> <p>এসব শিশুর যত্নে ইনকিউবেটর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনেকখানি, বিশেষত শিশুর ওজন ২০০০ গ্রামের কম হলে। এই বিশেষ ব্যবস্থায় শিশুর তাপমাত্রা সঠিক পর্যায়ে সুরক্ষা করে, ৪০ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে আর্দ্রতা বজায় রেখে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। ইনকিউবেটরের ব্যবস্থা করা না গেলে শিশুর তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যেমন— রেডিয়েন্ট হিটার, ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখার চেষ্টা করা যায়। তবে তুষের আগুন জ্বালিয়ে যেন তা না করা হয়। বদ্ধ ঘরে তুষের ধোঁয়া শিশুর জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। সব সময় জানালা যেন খোলা থাকে, যেন বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের উপযোগী হয় শিশুর থাকার ঘর, সেই খেয়াল রাখতে হবে। সেই সঙ্গে শিশুর মাথায় টুপি পরিয়ে, তার জন্য হাত-পায়ের মোজা ব্যবহার করে, কম্বল কিংবা তুলার বান্ডেলে ঢেকে, শিশুর শরীর থেকে নিরাপদ দূরত্বে গরম জলের ব্যাগ রেখে শিশুটির জন্য কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রা বজায় রাখা যায়। এসবের পাশাপাশি অন্যান্য বিধি-ব্যবস্থা শিশু বিশেষজ্ঞ নির্ধারণ করে দেবেন।</p> <p><strong>খাওয়ানোর পদ্ধতি</strong></p> <p>সাধারণভাবে ৩৪ সপ্তাহ গর্ভকালের কম নবজাতক শিশুটির মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া, চোষা ও গিলতে পারা—এই তিনের সমন্বয় গড়ে ওঠে না। সে ক্ষেত্রে এবং অত্যধিক স্বল্প ওজনের নবজাতক, যার জন্মকালীন ওজন ১৫০০ গ্রামের কম, তাদের নাকে নল দিয়ে বুকের গলানো দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্য বুকের গলানো দুধই শ্রেষ্ঠ। শিশুর ওজন ও বয়স হিসাব করে শিশু বিশেষজ্ঞ তা নির্দিষ্ট করে দেন। শিশুর চুষে খেতে পারা নিয়ে সামান্যতম সংশয় থাকলে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।</p> <p> </p> <p><strong>সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে করণীয়</strong></p> <p>এ সময় শিশুর জন্য বিপজ্জনক একটি ইস্যু হলো ইনফেকশনস। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যধিক কম থাকে। এসব সন্তানকে, বিশেষ করে জন্মের প্রথম মাস, মা ছাড়া অন্য কারো সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা এবং মায়ের উচিত একমাত্র তাঁরই নবজাতক পরিচর্যার ভার নেওয়া। শিশুকে ধরাছোঁয়ার আগে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। শিশুকে পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত  কাপড়চোপড় পরানো উচিত। ঘরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখা অবশ্যকর্তব্য।</p> <p> </p> <p><strong>বাড়তি ভিটামিন</strong></p> <p>দুই সপ্তাহ বয়সে পৌঁছলে প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্য বাড়তি কিছু ভিটামিনের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-সি। ১৫০০ গ্রামের কম ওজনের নবজাতক শিশুর জন্য ভিটামিন-ই, কখনো তা শিশুর ওজন দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত তা চালিয়ে যাওয়া হয়। এবং আয়রন সিরাপ।</p> <p> </p> <p><strong>ফলোআপ যত্ন</strong></p> <p>প্রি-ম্যাচিউর নবজাতক শিশুর বেঁচে থাকা, মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশজনিত ঝুঁকি নির্ভর করে গর্ভকালের ওপর, যা গর্ভকালীন আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার সাহায্যে সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। বিশেষত ২৩ থেকে ২৫ সপ্তাহ গর্ভকাল নিয়ে ভূমিষ্ঠ নবজাতক শিশুকে বহু সপ্তাহের জন্য নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন পড়ে। পরে এসব শিশুসন্তানকে শিশু বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রেখে তার বেড়ে ওঠা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না লক্ষ রাখা দরকার।</p> <p>প্রি-ম্যাচিউর শিশুর যেসব বিশেষ যত্ন-পরিচর্যার কথা মনে রাখতে হবে—</p> <p>► ক্যাঙারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে তাপমাত্রার সুরক্ষা</p> <p>► পূর্ণ ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ পান করানো</p> <p>► স্বাভাবিক নিয়ম মেনে টিকাদান</p> <p>► দুই বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত নিয়মিতভাবে শিশুর বিকাশ-বৃদ্ধি (সেরিব্যেল পোলসি), দৃষ্টিশক্তি (রেটিনোপ্যাথি অব প্রি-ম্যাচিউরিটি), শ্রবণশক্তি, আচার-আচরণ প্রভৃতির মনিটরিং।</p> <p>লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান</p> <p>শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল</p> <p> </p>