ঢাকা, বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫
৩ বৈশাখ ১৪৩২, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫
৩ বৈশাখ ১৪৩২, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৬

মায়ার বাক্স, ঘুমাও

  • ধ্রুব এষ
শেয়ার
মায়ার বাক্স, ঘুমাও
অঙ্কন : শামীম আহমেদ

তৈয়ব আল আজাদের গলায় সুর নাই। আফসোস। কাল রাত থেকে ‘হলুদিয়া পাখি’ বাদ্য-বাজনাসহ বাজছে তাঁর মাথায়। পশ্চিম বাজারের মেসার্স মালা মাইক হাউসের মাইকে বাজছে।

হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ/পাখিটি ছাড়িল কে? ষোলো-সতেরো ঘণ্টা হয়ে গেছে, সেই পাখি যায় নাই। থেকে থেকে মাথার ভেতরে বাজছে। গলায় সুর থাকলে তৈয়ব আল আজাদ একবার গুনগুন করে দেখতেন। কিন্তু শশাঙ্ক চক্রবর্তী উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁকে নারদ মুনির গল্প শুনিয়ে রেখেছেন।
ভালো করেন নাই। বাজে গল্প : দেবরাজ ইন্দ্র একদিন ঘুরতে বেরিয়েছেন সপারিষদ, রাস্তার ধারে দেখলেন অপরূপ সুন্দর ছয় যুবক এবং ছয়ত্রিশ যুবতি আছাড়িপিছাড়ি করে কাতরাচ্ছে। এরা কারা? পারিষদদের একজন বললেন, এরা ভাই-বোন, ছয় রাগ, ছয়ত্রিশ রাগিণী। দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, এরা এ রকম কাতরাচ্ছে কেন? পারিষদ বলে দিলেন, নারদ মুনি গান ধরেছেন কিনা।
—কথা হলো? শশাঙ্ক চক্রবর্তীর এই অপতৎপরতার নিন্দা জানিয়েছিলেন তৈয়ব আল আজাদ। আর কী করবেন?

তাঁরা বন্ধু। বাষট্টি বছর আগে টাউনের মাতৃমঙ্গলে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। ছয় ঘণ্টা আগে-পরে। এক স্কুল, এক কলেজে পড়ে সিনিয়র শশাঙ্ক চক্রবর্তী শিক্ষক হয়েছেন, তৈয়ব আল আজাদ কবি হয়েছেন।

যাঁর যাঁর ঘর-সংসার হয়েছে। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞাপনের ঢেউটিনের মতো অটুট মজবুত তাঁদের বন্ধুত্ব। পারিবারিক সম্পর্ক মধুর। হলুদিয়া পাখি...। কী মুশকিল!

রুবি কী করেন?

বই পড়ছেন?

বিকেল খারিজ করে দিয়েছে দুপুরকে, তৈয়ব আল আজাদ এই সময় তাঁর বৈঠকখানাঘরে বসে থাকেন। বসে আছেন। এই ঘরে বসে তিনি লেখেন, বইপত্র পড়েন, শশাঙ্ক চক্রবর্তীর সঙ্গে বািচত করেন।

টাউনে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ট্রাফিক পুলিশ, সাংবাদিক এবং অনলাইন মিডিয়ার সংখ্যা বেড়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া বিলুপ্ত হয়ে যাবে—এ রকম রব উঠে গেছে যেখানে, সেখানে টাউন থেকে নিয়মিত তিনটা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ভালো কথা। ট্যাবলয়েড সাইজ তিনটা পত্রিকাই ঝকঝকে সাদা সত্তর গ্রাম অফসেট কাগজে ছাপা হয়। শুক্রবারে সাহিত্য পাতা থাকে দুইটায়। শনিবারে একটায়। স্থানীয় কবি-লেখকরা লেখেন।

তৈয়ব আল আজাদ তিনটা পত্রিকাই সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে পান। কমন পিয়ন ফজর আলি সকালে দিয়ে যায়। জাতীয় দৈনিক টাউনে আসে দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটায়। সকালে এ জন্য কিছু কদর থাকে লোকাল দৈনিকের। নানা উৎপাতে তৈয়ব আল আজাদ আজকের পত্রিকা সকালে দেখতে পারেন নাই। এখন দেখবেন বলে মনস্থ করলেন। আজ জাতীয় দৈনিক আসে নাই টাউনে। সড়ক পরিবহন ধর্মঘট চলছে। হলুদিয়া পাখি...। ওরে!

তৈয়ব আল আজাদ কল দিলেন শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে, ‘কী করো তুমি? ঘুমাও?’

‘না, গরুর দুধ দোয়াই।’

‘রাখো তো! তুমি আসো!’

‘আসতেছি। দোয়ানো এই শেষ।’

‘কী শেষ! আসো তুমি!’

‘তুমি ফোন রাখো। আসতেছি। ফোন রাখো।’

তৈয়ব আল আজাদ একটা পত্রিকা নিলেন। টাউনের জলাবদ্ধতা নিয়ে এরা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বড় লেখা। জাম্প পৃষ্ঠা ৭ কলাম ৩। পড়ে দেখতে হবে। পত্রিকার ৬ পৃষ্ঠায় কিছু ছোট বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। কবিতার বইয়ের বিজ্ঞাপন বলে চোখ আটকাল বিশেষ একটায়। এই প্রজন্মের কবি সুলতান সুলেমানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, ‘তোরে রডে বসিয়ে করব আদর’ প্রকাশিত হচ্ছে।

তোরে রডে বসিয়ে করব আদর! কাব্যগ্রন্থের নাম!

হচ্ছে কী এসব? নবনির্মাণ?

নিজের কথা নিজে বলতে নাই, দশ বছর আগে তৈয়ব আল আজাদ বাংলা একাডেমি পদক পেয়েছেন কবিতায়। ঢাকার এক বড় প্রকাশনা সংস্থা তাঁর কবিতাসমগ্র প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করেছে। তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। টাউনের সাবেক পৌর চেয়ারম্যান শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক দেওয়ান মশহুদ তাঁকে টাউনকবি উপাধি দিয়েছিলেন। তা-ও কবিতা কে কী রকম লিখবে, কে কী শব্দ ব্যবহার করবে, তিনি নিশ্চয় ঠিক করে দিতে যাবেন না। নির্দেশনা দিয়ে কবিতা হয় না। সৃজনশীল কোনো কর্মই হয় না। কিন্তু এসব কী হচ্ছে হালে? সুলতান সুলেমান। কবিতা ভালো লেখে ছেলেটা। সে এমন একটা নাম দিল বইয়ের! কেন? সে কি তার বই ভাইরাল করতে চায়? শান্ত-সভ্য ছেলে। লোলুপতায় মজেছে?

রুবির অ্যাসিস্ট্যান্ট আনতারা দৃশ্যমান হলো দরজায়, ‘চা দিমু নানা?’

‘দে।’

‘ফাওর দিমু?’

ফাওর—পাপড়।

‘দে। দুইজনের দিস।’

‘দুইজনির? ও আল্লাহ গো! আর কেউরি তো দেয়ি না নানা। নানি কয় আমনে জিন পালেন। হেই জিনে কি চা ফাওর খায়? হেয় খাইব?’

‘তোর নানি কী করে?’

‘অ্যাঁ! নানি ফাওর ভাজে মিশিং চুলায়। কন না নানা।’

‘কী? হ্যাঁ। কুফুলুস কুলু খুবই ক্ষুধার্ত।’

‘কুলুকু তার নামনি নানা?’

‘কুফুলুস কুলু।’

‘ও আল্লাহ গো!’

‘হ্যাঁ। মিষ্টি আছে ঘরে? মিষ্টি নিয়া আয়। কুফুলুস কুলু মিষ্টি পছন্দ করে। জিন জাতি মিষ্টি পছন্দ করে।’

‘নানিরে কই মিষ্টি দিতে?’

‘বল।’

‘আমার আর একখান কথা নানা। কুলুকু কি ব্যাডা জিন নি? বিয়াশাদি করসেনি হেয়?’

‘সেইটা তোর নানি তোরে বলবে। জলদি যা। জিনজাতি ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না।’

আনতারা অন্তর্হিত হলো। সরল সিধা এই মেয়েটা। বাইশ-তেইশ বছর হবে বয়স। আট-নয় বছর ধরে আছে তাদের সঙ্গে। রুবি ঠিক করেছেন বিয়ে দিয়ে দেবেন। পাত্রের সন্ধানে আছেন। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, নাবালিকা তখন আনতারা, সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছিল। সেই সন্তান পৃথিবীতে দুই মাস থাকে নাই।

শশাঙ্ক চক্রবর্তী আবির্ভূত হলেন। ক্ষুব্ধচিত্ত সংযত করে তৈয়ব আল আজাদ বললেন, ‘দুধ খাইসো?’

‘দুধ!’

‘দুয়াইতেসো বললা! আচ্ছা দেখো, এইটা আগে দেখো!’

‘কী?’

‘এই যে বিজ্ঞাপন, দেখো।’

শশাঙ্ক চক্রবর্তী সেই বিজ্ঞাপন দেখলেন। বললেন, ‘কী হইসে?’

তৈয়ব আল আজাদ খেপলেন, ‘পড়ো নাই? কবিতার বইয়ের নাম কী রাখসে? তোরে রডে বসিয়ে করব আদর! বাকি থাকল আর কিসু বলো?’

‘কী বললা? কী নাম রাখসে? তোরে রডে বসিয়ে করব আদর। কে? কারে আদর করবে? তুই-তোকারি করে বলতেসে। গৃহকর্মীরে বলতেসে নাকি? রডে বসায়ে আদর করবে, ছয় ইঞ্চি না আট ইঞ্চি রড?’

তৈয়ব আল আজাদ আরো খেপলেন, ‘এই বিকালে গরুর দুধ দোয়ায়ে তোমার মস্তিষ্ক বিকলন হইসে। তুমি অশালীন কথা বলতেসো। এই দেখো, পড়ো। আর অশালীন কথা না বলে পড়ো।’

শশাঙ্ক চক্রবর্তী বাইফোকাল পরেন। বিজ্ঞাপন পড়ে কবিবন্ধুকে দেখলেন। বললেন, ‘চশমা পরো তৈয়ব।’

কী? চশমা পরেন নাই নাকি তিনি?

চশমা ছাড়া কাছের জিনিস ভালো দেখেন না।

চশমা পরলেন।

‘কী হইসে?’

‘বিজ্ঞাপনখান আবার পড়ো।’

পড়ে বোকা হলেন তৈয়ব আল আজাদ। কী সর্বনাশ! ‘তোরে রডে বসিয়ে করব আদর’ না, সুলতান সুলেমানের কবিতার বইয়ের নাম, ‘ভোরের রোদ চরিয়ে কবর আবাদ’। চশমা ছাড়া আগে উল্টাপাল্টা দেখেছেন। কী কাণ্ড! আধা বিব্রত তৈয়ব আল আজাদ আনতারাকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

আনতারা বলল, ‘নানা।’

তৈয়ব আল আজাদ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ‘রেখে যা আনতারা। চা আর পাপড় তো? রেখে যা। তোর নানি আর কিসু বানায় নাই? রেখে যা। রেখে যা।’

আনতারা রেখে গেল।

‘ধর্মনগরের পাপড়। খাও। সলিল এনে দিসে।’ তৈয়ব আল আজাদ বললেন।

শশাঙ্ক চক্রবর্তী পাপড় নিলেন। কামড় দিয়ে জিভে টাকরায় স্বাদ নিয়ে বললেন, ‘চশমা ছাড়া আমরা এখন কানা বুঝসো তো?’

‘হ্যাঁ। চোখে চশমা নাই, বুঝতে পারি নাই। বিজ্ঞাপন পড়ে মগজ শিনশিন করে উঠসিল। এইসব কী হইতেসে? সুলতান সুলেমান। এই ছেলে বড় কবি হবে বুঝসো। দেওয়ান মশহুদ কাকা থাকলে এরে নুতন টাউনকবি ঘোষণা করতেন।’

তৈয়ব আল আজাদের এই বদান্যতা শশাঙ্ক চক্রবর্তীর পছন্দ হলো না। বললেন, ‘সুলতান সুলেমান? এ কি তুরুক?’

‘তুরুক কী? তুমি এই রকম অসংযত ভাষা বলো কেমনে? হাওয়াপাড়ার মনসুর উকিলের ছেলে সুলতান সুলেমান। বিরাট প্রতিভাধর কবি বুঝসো?’

‘বুঝছি। তুমি মনে করো দেওয়ান মশহুদ কাকা তারে নুতন টাউনকবি ঘোষণা করতেন?’

‘অবশ্যই। সে যোগ্য।’

‘সেইটা তুমি একা মনে করলে তো হবে না। মানুষ মনে করো টাউনকবি হিসাবে মেনে নিব আর কেউরে? নো, না, নেভার। এই টাউনের একমাত্র এবং আদি টাউনকবি হলে তুমি। স্বর্ণাক্ষরে এই কথা লেখা হয়ে গেছে। টাউনকবি সুলতান সুলেমান! মানায়, নাকি শুনতে ভালো লাগে? টাউনকবি তৈয়ব আল আজাদের মতো ওজনদার মনে হয়? তোমার উচ্চতা আর তার উচ্চতা এক? মাঝেমধ্যে তোমার বিবেচনা দেখে তোমারে আমার কবি মনে হয় না। মনে হয় তুমি নূরজাহান টকিজের টিকিট ব্ল্যাকার ঘাউড়া মেলাদ।’    

‘ভাই?’

তৈয়ব আল আজাদ তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন এই শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে। হলুদিয়া...। এই রে। মেসার্স মালা মাইক হাউসের মাইক আবার বেজে উঠল তৈয়ব আল আজাদের মাথায়—

হলুদিয়া পাখি সোনারই বরন

পাখিটি ছাড়িল কে...

 

অঙ্কন : শামীম আহমেদ

দুই

জুনুন আজাদ লন্ডনে থাকে। স্কুল মাস্টার। সাদাকালো বাচ্চাদের পড়ায়। পদ্ম পড়ে টাউনের মহিলা কলেজে। তৈয়ব আল আজাদের ছেলেমেয়ে এরা। পদ্মর নাম শশাঙ্ক চক্রবর্তী রেখেছেন। জুনুন পদ্মর জননী সর্বংসহা দিলরুবা সুলতানা রুবি। উরফে জুনুনের আম্মা, উরফে পদ্মর আম্মা। কবি তৈয়ব আল আজাদের সঙ্গে বিগত তেত্রিশ বছর ধরে সংসার করছেন ইনি। তেত্রিশ বছর আগে টাউনে মহিলা কলেজ, সাইবার ক্যাফে ইত্যাদি ছিল না। শশাঙ্ক চক্রবর্তী মাস্টার হন নাই, তৈয়ব আল আজাদ টাউনকবি হন নাই—কবি হয়েছেন। টাউনের পত্রিকার সাহিত্য পাতায় নিয়মিত কবিতা ছাপা হয়। স্কুল-কলেজের প্রচুর মেয়ে তাঁর কবিতা পড়ে উদ্বেল। কেউ কেউ প্রেমাতুর। তরুণ কবি প্রেমাতুর হয় না, দিনশেষে হলো। ধানক্ষেতের আলপাড়ে বসে উত্তরালি হাওয়ার এক দুপুরে চোখমুখ লাল করে তার মনোভাব এবং বাসনা ব্যক্ত করল সে, ‘এই তোমারে বলে রাখলাম শশাঙ্ক, আকুল ফকির মগন ফকিরের কসম, তারে ছাড়া আমি বাঁচব না।’

‘সে কে তৈয়ব? কারে ছাড়া বাঁচবা না তুমি?’

‘রহমান ডাক্তারের মেয়ে।’

‘কী বললা? কে? রহমান ডাক্তারের মেয়ে? কানিজ আপা? কী বলো তুমি? কানিজ আপা আমাদের সিনিয়র তৈয়ব। তুমি কেন তার প্রেমে পড়সো? দুই বছর আগে তার বিয়া খাইসো মনে নাই? তার বর এই বছরই তারে আমেরিকা নিয়া যাবে, জানো না? এ ছাড়া তুমি জানো যে ফাল্গুনে সেজদির বিয়া। কানিজ আপা বউ সাজাবে সেজদিরে। এর মধ্যে তুমি যদি এই রকম করো—’

‘শশাঙ্ক! ঘণ্টায় বেয়াল্লিশ মাইল গতিতে কথা বলো। এতো কথা বলো, কী করে পারো? আমি তোমারে কানিজ আপার কথা বলসি? কানিজ আপা ছাড়া আর মেয়ে নাই রহমান ডাক্তারের?’

‘আরো মেয়ে? ও-ওহ্ রুবি! রুবি তো গত শীতে জন্মালো! তুমি তারে ছাড়া বাঁচবা না?’

‘তোমার গত শীত একুশ বছর আগে পগারের পাড়ে চলে গেছে শশাঙ্ক। কলেজে পড়ে, সাবু, রিপন, শিমুল, নিতুদের ইয়ারমেট রুবি।’

‘হুম্।’

‘হুম্ কী? হুম্ কী? আমার এক কথা এক দফা। এক দফা এক দাবি, আমি তারে ছাড়া বাঁচব না।’

‘পাগলামি কোরো না তৈয়ব।’

‘পাগলামি না। আমার আর কোনো কথা নাই। আমি তারে ছাড়া বাঁচব না। কথার মধ্যে হপ স্টেপ অ্যান্ড জাম্প দিয়া পোড়ো না শশাঙ্ক। রুবির সঙ্গে কথা বলবা তুমি।’

‘আমি? কেমনে? আমি কি ঘটক নিয়োগী কাকা?’

‘এত কিছু আমি জানি না।’

রুবি! রুবিকে ছাড়া তার কবি বন্ধু বাঁচবে না। কথা হলো? এই সেদিনের তিড়িংবিড়িং রুবি। প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়ে তার নাক ফুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেজদি। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কী কান্না রে তার! ফটোগ্রাফার বিজন কাকা ছবি তুলে রেখেছিলেন।

‘তোর সঙ্গে কথা আছে রে রুবি?’

‘কী কথা বলো?’

‘এখন বলব?’

‘বলো।’

তরুণ শশাঙ্ক চক্রবর্তী একনিঃশ্বাসে তার কবিবন্ধুর দুর্দশা এবং পরিত্রাণের উপায় রুবিকে বলল। রুবির ডাগর চোখ ডিমগোল হলো।

‘এমা! শশাঙ্কদা, এইসব কী বলো তুমি? ছি! ছি! আব্বা এইসব কথা শুনলে আমারে খুন করে ফেলবে, জানো তুমি। ইয়া মাবুদ! আবার তোমার বন্ধু কবি।’

‘পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়।’

‘অ। কোন পত্রিকায়?’

‘সাপ্তাহিক মফসসল আর সাপ্তাহিক চলতি দুইটাতেই।’

‘এইসব কী? লোকাল পত্রিকা? লোকাল পত্রিকা আমি পড়ি না জানো? বাসায় সংবাদ আর অবজারভার রাখে। আমি অবজারভার পড়ে শোনাই আব্বারে। সংবাদের সাহিত্য পাতায় যদি তার কবিতা ছাপা হতো বুঝতাম।’

শশাঙ্ক চক্রবর্তী মারফত অবগত হয়ে কবিপ্রবর কবিতা পাঠাল দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায়। সংবাদ-এর সাহিত্য পাতা বিষ্যুদবারে ছাপা হয়, পাঠানোর পরের ষষ্ঠ বিষ্যুদবারে মফসসলের কবি তৈয়ব আল আজাদের কবিতা ছাপা হলো অলংকরণসমেত।

রুবি পড়ল।

‘পড়সি। ভালো কবিতা। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কবিতা দিতে বলো তোমার বন্ধুরে।’

বন্ধু দিল। ‘বিচিত্রা’ ছাপল।

পরীক্ষা পাস?

না। শেষ হয় নাই।

সেই পরীক্ষা আট মাসব্যাপী চলল। দিনশেষে পাস বন্ধু।

ভরা বর্ষার এক শুক্রবারে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো। কবি ও রুবি।

দুই বছর পর জন্ম জুনুনের। পাক্কা দশ বছর পর পদ্মর। ছেলেমেয়ে কেউ কবি হয় নাই। তৈয়ব আল আজাদের আফসোস নাই তাতে। পুত্র-কন্যার জননী রুবি কবিতা পড়েন, অবসর কাটান গল্পের বই পড়ে। মায়ের সুঅভ্যাস ছেলেমেয়ে পেয়েছে। গল্পের বই খুব পড়ে তারাও। মেয়ের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। ছেলের একেক দিন একেকজন প্রিয়। কাল রাতে ইসরায়েলের এক লেখকের কথা বলেছে। এডগার কেরেত। পদ্ম বলেছে, এডগার কেরেতের গল্প বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।

ভিডিও কলে কথা বলছিল তারা। বোনের জবান শুনে ভাই তবদা, ‘কী বলিস? কেরেত বাংলায় অনুবাদ হইসে?’

‘আমি পড়সি। ফ্রিজের উপর মেয়েটি।’

‘কী আশ্চর্য। আমারে বলিস নাই। এডগার কেরেত তুই পড়ছিস! তুই দারুণ! দারুণ না বল?’

‘কে? আমি না কেরেত?’

‘তুই আর কেরেত।’

ভাই-বোন কথা বললেই এ রকম। কথা কাটাকুটি। মিষ্টি কাটাকুটি। মায়ার অধরা মাধুরীতে ভরা। রুবি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এডগার কেরেতের বই পড়বেন। তৈয়ব আল আজাদ কি পড়বেন? পড়বেন। তবে পরে। এখন ‘পথের পাঁচালী’ আবার পড়ছেন। আটাশবার হবে এ নিয়ে। মনে করেন, ‘পথের পাঁচালী’ দীর্ঘ কবিতা। বারবার পড়েন। রোজ পড়েন ‘গীতবিতান’। ঘুম থেকে উঠে সকালে একবার। মনে করেন, তাতে মন প্রসন্ন থাকে।

শশাঙ্ক চক্রবর্তী ‘দেবদাস’ ছাড়া আর কোনো আউট বই জীবনে পড়েন নাই। বন্ধুর মুখে গীতবিতানের চরণ শুনে সেই তিনিও বিমোহিত হন, ‘কর্তামশাই কী লিখে গেসেন আহা!’

ভক্তি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কর্তামশাই ডাকেন শশাঙ্ক চক্রবর্তী। তৈয়ব আল আজাদ আপ্লুত এতে। অভ্যাস নাই বলে গল্পের বই পড়েন না, কিন্তু শশাঙ্ক চক্রবর্তীর বেজায় পছন্দ কবি-লেখকদের। বলেন, এঁরা সাক্ষাৎ সরস্বতীর সন্তান। মানুষটার দোষ বলতে একটাই, বন্ধুপ্রীতি। মাত্রাতিরিক্ত সেটা। তার কর্তামশাইয়ের দূর সম্পর্কের পুতি মনে করেন তিনি তৈয়ব আল আজাদকে।

‘তুমি এই টাউনের শ্রেষ্ঠ কবি। আমার আর কোনো কথা নাই।’

কবিবন্ধুর প্রকাশিত সকল কাব্যগ্রন্থ শশাঙ্ক চক্রবর্তীর সংগ্রহে আছে। কবিতাসমগ্র প্রথম খণ্ড প্রকাশের সময় কবি স্বয়ং একটা বই ধার চেয়েছিলেন, ‘ভূমিজাত উই ও জলৌকা’, শশাঙ্ক চক্রবর্তী মূল কপি দেন নাই, ফটোকপি করিয়ে বাজারের ‘ইসলামিয়া লাইব্রেরী এন্ড বুক বাইন্ডার্স’ থেকে বাঁধাই করিয়ে এনে দিয়েছিলেন। কবি মনে মনে হেসে কূল পান না, বাইরে মুখ শক্ত করে বলেছিলেন, ‘মূল কপি দিলে আমি রেখে দিতাম না।’

শশাঙ্ক চক্রবর্তী বিচলিত হন নাই। আরো শক্ত মুখ করে বলেছিলেন, ‘তোমার বইয়ের ব্যাপারে আমি কেউরে বিশ্বাস করতে পারি না।’

‘ভালো কথা। কিন্তু আমি এই বইয়ের কবি।’

‘সবচেয়ে বিপজ্জনক কথা তো এইটাই। তোমার বইয়ের কপি তুমি হারাইসো, এখন নজর দিসো আমার বইয়ের দিকে! আবদুর রহমান স্যারের সময় আমাদের স্কুলে এক পালাকার আসছিলেন মনে আছে? মুরগি শিয়ালের পালা গাইসিলেন? সাধন পালাকার?’

অপমানজনক প্রসঙ্গ উত্থাপন। শশাঙ্ক চক্রবর্তী কী মনে করেন? তৈয়ব আল আজাদ সেই শিয়াল?—সাধন পালাকারের পালা মনে আছে। হাসতে হাসতে জুবিলি স্কুলের সহস্রাধিক ছাত্র, তেইশজন শিক্ষক, একজন লাইব্রেরিয়ান, ছয়জন আরদালি, একজন ঘণ্টাবাদক, দুইজন পাঙ্খা পুলার—সকলে বিষম খেয়েছিল। হাসেন নাই কেবল পালাকার।

আশ্চর্য সেই সাধন পালাকার। তৈয়ব আল আজাদ তাঁর দেখা প্রথম কবি মনে করেন সাধন পালাকারকে। আট বছর আগে একবার ছয়হারা গিয়েছিলেন পালাকারকে দেখতে। পালাকারের বয়স তখন নব্বই। টনটনে ভেদজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। পালাগানের দিন আর নাই মনে করেন কি না—প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়েছিলেন, ‘দিনের লগে কে চুক্তি করসে বাবা? দিনের থাকন না থাকন ঠিক করে! দিন কি যায়, না দিন থাকে? কে ঠিক করে?’

ফাল্গুনের পূর্ণিমার রাতে পালাকার মরেছেন। ছয় বছর আগে। ফাল্গুনের পূর্ণিমায় এখন সারা রাত পালাগান হয় পালাকারের ঘরের উঠানে। ইন্ডিয়ার অসম প্রদেশের রাতাবাড়ি থেকে পালাকার আসেন, বীরভূম থেকে আসেন। দেশপ্রসিদ্ধ পালাকার আসেন কয়েকজন। নতুন প্রজন্মের তকি পালাকার আসেন—সাধন পালাকারের জীবন ও কর্ম নিয়ে পালা আছে এর—‘জীবন সাধন পালা’।

তৈয়ব আল আজাদের অষ্টাদশ কাব্যগ্রন্থ—‘সাধন পালাকারের খড়ম এবং অন্যান্য কবিতা’, পালাকারের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল। পালাকার বই দেখেছিলেন। তকি পালাকার লতায়-পাতায় আত্মীয় হন তৈয়ব আল আজাদের। তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তকি পালাকার বর্তমানে বামনসুরে থাকেন। ঘর-সংসার বউ-বালবাচ্চা আছে। বিচিত্র সমাচার এই যে তকি পালাকারের একমাত্র কন্যার নামও পদ্ম। তকি পালাকারের পত্নী রুশনি জাহান এই নাম রেখেছেন মেয়ের। বাউল সাধক আকিলউদ্দিনের কন্যা রুশনি জাহান তত্ত্বজ্ঞানী বাউল সাধিকা। বাংলায় মাস্টার্স করেছেন।

—মন ভরে যায় এসব শুনলে।

শশাঙ্ক চক্রবর্তীর দুই কন্যা। সোনালি, রুপালি। সোনালি থাকে যুক্তরাজ্যে, রুপালি থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। দুই কন্যাই ভালো চাকরি করে। সোনালি বিয়ে করেছে। রুপালিকে নিয়ে সামান্য সামাজিক অস্বস্তি আছে। রুপালির পার্টনার আরেকটা মেয়ে।

‘তারা কি বিয়া করসে?’

‘ভগবান জানে। একসঙ্গে থাকে।’

‘তোমার কী মনে হয়?’

‘তাদের মা ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্দে।’

বারো দিনের শিশু মফিদুল কাউন্সিলর ড্যানা ঝেড়ে হুমকি দিয়ে রেখেছে, ‘স্যার আপনের ছোট মেয়ে রুপালি, সে য্যান্ আর টাউনে না আসে, বুঝছেন? টাউনের মনে করেন একটা সমাজ আছে তো, কিছু নিয়ম-কানুন আছে সমাজের।’

পশ্চিম বাজারে নরপিশাচ বগা সুদখোরের ছেলে মফিদুল ‘সুদখোর’ কাউন্সিলর। তার মতো ব্যক্তিরা এখন সমাজের নিয়ম-সিয়ম বানায়।

সোনালি দুই বছর আগে দেশে এসেছিল জামাই নিয়ে। চমৎকার ছেলে মজরুহ। দীর্ঘকায় এক দীর্ঘনাসা পারসিক। বাংলা ভাষা ও বাংলা কেতা শিখেছে। তৈয়ব আল আজাদের কবিতা পড়েছে, বই নিয়ে গেছে।

 

অঙ্কন : শামীম আহমেদ

তিন

পরাধীন দেশে জন্মেছেন, এই অভিশাপ, এই গ্লানি বোঝার মতো বয়স তাঁদের হয় নাই, স্বাধীন একটা দেশ পেয়ে গেছেন। তৈয়ব আল আজাদের দুই চাচা ও এক মামা মুক্তিযোদ্ধা। ভোলাভালা কবি মানুষ মমিন আল আজাদকে তাঁর ভাই-বেরাদররা বুঝিয়েসুজিয়ে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন একাত্তরে। ইনি তৈয়ব আল আজাদের পিতা—যুদ্ধের সময় দেশের বাড়ি থেকে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন ‘স্বাধীন জন্মভূমির হে প্রথম সকাল’। ষোলো পৃষ্ঠার বই। কোন লেটার প্রেসে ছাপা নাম নাই। দাম এক টাকা আট আনা। তাঁদের দেশের বাড়ি গোলোকপুর। পারিবারিক গ্রন্থাগারে সেখানে দশ কপি বই সংরক্ষিত আছে, ‘স্বাধীন জন্মভূমির হে প্রথম সকাল’। তিন ভাষার বইটা প্রকাশের একটা প্রজেক্ট নিয়েছে জুনুন। ফান্ড পেয়েছে গ্যেটে ইনস্টিটিউট থেকে। বাংলা, ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় বই হবে। জুনুন নিজে ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় অনুবাদ করবে।

পদ্ম ছাত্রী হিসেবে মেধাবী। লক্ষ্মী মেয়ে। শশাঙ্ক মাস্টারের জ্ঞাতী সতীশ গণক, মাটিতে দাগ কেটে গণনা করে বলেছে, ‘কবিসাবের মেয়ে রাজরানি হবে। আমি এই সতীশ চ্যালেঞ্জ রাখলাম।’

গণকের কথা, ধরতে নাই, তবে শান্তি। মোটকথা, তার জীবন নিয়ে তৈয়ব আল আজাদের অসন্তুষ্ট থাকার কোনো কারণ নাই। তিনি সন্তুষ্ট। সভ্যতা-অসভ্যতার সংকটে পড়ে জেরবার হয়েছেন যদিও বহুবার, তা-ও সন্তুষ্ট।

মমিন আল আজাদ ইন্তেকাল করেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। তদীয় পত্নী পরের বছর একই তারিখে, ২৭শে অক্টোবর। গোলোকপুরে তাদের কবর হয়েছে। কর্তব্য মনে করে ফিবছর ২৭শে অক্টোবর গোলোকপুরে যান তৈয়ব আল আজাদ। বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করেন।

পর্যাপ্ত শান্ত সমাহিত দিন।

অসন্তোষ হবে কী নিয়ে?

কিছু নিয়ে না।

তবে?

বয়সকালে মানুষ ভাবে এ রকম? কত কী ভাবে! বয়স মানুষের কোন বয়সে হয়? চার-ছয় বছর আগে এ রকম কিছু কি ভাবতেন তৈয়ব আল আজাদ? নাকি সম্প্রতি ভাববেন বলে ভাবতেন? বয়সে মানুষের শারীরিক-মানসিক নানাবিধ পরিবর্তন ঘটে যেতে থাকে, গুপ্তহত্যার মতো। দিনযাপনের পাপ ক্ষয় করার ঘোরে সেই পরিবর্তন প্রায় ধরা পড়ে না।

তবে তৈয়ব আল আজাদের না, বয়স হয়েছে শশাঙ্ক চক্রবর্তীর। সাদা চুল, সাদা দাড়িঅলা হয়েছেন। বয়স মনে হয় সাড়ে চুয়াত্তর বছর।

‘পণ্ডিতরে আর পয়সা দিবা না তুমি?’

‘পণ্ডিত! কিসের? কোন পণ্ডিতের কথা বলো তৈয়ব?’

‘দেখো অবস্থা! আরে আমাদের গোবিন্দ পণ্ডিত। ক্ষৌরকার গোবিন্দ। তার একটা হক আছে না, বলো? বেচারার উপার্জন ক্ষৌরকর্ম করে, কটা টাকা পায়, বউ ঝি পুতের মুখে অন্ন জোগান দেয়।’

‘তুমি তৈয়ব সব সময় বড়ো সুন্দর করে কথা বলো। মনে হইতেসে এই বেলাই গোবিন্দর সেলুনে যাই।’

‘যাও। পণ্ডিতের বিশ-পঞ্চাশ টাকা আয় হোক।’

‘এই বেলা যাওয়া হবে না। ঘুম থেকে উঠসি দেবী করালবদনীর বিকট হুংকারে। পূজার উপচার আনে দিতে হবে তার।’

‘শশাঙ্ক! আমার বইনের লগে সব সময় এই রকম মেকুড়ের মতো আচরণ করো কেন তুমি? সে কি মেকুড় নি? করালবদনী বলো, মুখে আটকায় না? রূপে দুর্গা, রান্নায় অন্নপূর্ণা পাইসো।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন, বুঝসো না, ব্যথিত-বেদন বুঝিতে কি পারে, বুঝসো? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে, বুঝসো?’

‘বুঝসি। তবে আমি চিরসুখীজন না বুঝসো? তুমিও ব্যথিত না বুঝসো? আজ না পারো কাল একবার যাও। কৃতার্থ করো পণ্ডিতকে।’

চার-ছয় বছর আগে তৈয়ব আল আজাদ কি এ রকম দায়িত্বপ্রবণ কথা বলতেন?—বলতেন। আরেক ঢঙে। বয়সে ঢঙ বদলে গেছে বাচনভঙ্গি ও শরীরের। শরীর তাঁর উতরায়? এখনো উতরায়। অস্বীকার কেন করবেন? গত বর্ষায় কেলেঙ্কারি করেছেন। বৃষ্টি-বাদলার দিন, পদ্ম কলেজে। রুবিও আউলা হয়েছিলেন। ঘরের দরজা তাঁদের আটকাতে মনে নাই, মিমো ঘরে ঢুকে পড়েছিল। পড়শি শিপার-নূরুনের মেয়ে মিমো। আগের দিন সন্ধ্যায় মাত্র তার পঞ্চম জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছে। সম্পর্কে নাতনি কবি ও রুবির। সে কেলেঙ্কারি ধরতে পারে নাই।

জগৎ-সংসারের সব কথা একমাত্র শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে বলেন তৈয়ব আল আজাদ। তদ্রূপ শশাঙ্ক চক্রবর্তীও। জন্মের পর থেকে তাঁরা একপেট। সেই দুপুরের কেলেঙ্কারি সেই সন্ধ্যায়ই অবগত হয়েছিলেন শশাঙ্ক চক্রবর্তী। তাজ্জব হয়েছিলেন, ‘তুমি তো বিশ্বচ্যাম্পিয়ান তৈয়ব। এই বয়সে? কী বলো? আমি তো চিন্তাই করতে পারি না। রাধামাধব দিলে এত দিনে আমার নাতি-নাতকুরের মুখ দেখার কথা।’

‘সে কি আমারও দেখার কথা না? এই আফসোসের কথা আর বোলো না। আমাদের পোলাপানরা কি পোলাপান নিব না? না নিলে বলে দে।’

‘বলে দিলে তুমি কী করবা? পোলাপান উৎপাদনে আবার আত্মনিয়োগ করবা? সেইটা তুমি পারবা। তুমি চ্যাম্পিয়ান। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান। বুড়া না রণের ঘোড়া প্রবাদ শোনো নাই, সেই রণের ঘোড়া তুমি। ওয়ার হর্স!’

‘রণের ঘোড়া আমি না তুমি? সানাই কি সন্দেহ পোষণ করসিল মনে নাই?’

‘তোমার মুখে কিছু আটকায় না তৈয়ব। এইসব আগের জন্মের ঘটনা। আমি আর মনে করি না।’

ঘাটের বেটি সানাই। লঞ্চঘাটে থাকত। ঘাটের হোটেলে। দুই বন্ধুর প্রথম অভিজ্ঞতার ঘর, টাউনের আরো অনেক পোলাপানের মতো।

গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সানাই মধ্যপ্রাচ্যে চলে গিয়েছিল। টাউনে আর ফিরে নাই। কোথাও কি ফিরেছে? গান পারত সানাই, মায়াদয়া ছিল অন্তরে। সেই সানাই গতজন্মের ঘটনা? আচ্ছা। তৈয়ব আল আজাদের কোনো গতজন্ম নাই। সানাইকে তিনি এই জন্মে দেখেছেন, এই জন্মে একাধিক কবিতা লিখেছেন সানাইকে নিয়ে। তবে রুবিকে কোনো দিনই সানাই সম্পর্কে কিছু বলেন নাই—দিনযাপনের অধিকাংশ ঘটনাই যেখানে নিয়ত অসহ্য লাগে আমাদের, প্রিয়তম বন্ধুর সঙ্গেও কিছু না-বলা কথা থাকা ভালো। কিন্তু শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে বলেন নাই এমন কোনো গোপন কথা কি আছে তৈয়ব আল আজাদের?

আছে।

 

চার

মৃত্যু সন্ধ্যা নামিয়ে আনে। উদলা সকালে বা ঝিমঝিম দুপুরে। জনসংখ্যার ডিম বিস্ফোরিত হয়েছে, রোজ কেউ না কেউ মরে টাউনের। আজ কে মরল? মাইকের রিকশা বড় সড়ক দিয়ে যাচ্ছে।

: একটি শোকসংবাদ। একটি শোকসংবাদ। হাসননগর নিবাসী ইসহাক মিয়া সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র গোলাম মুস্তফা কাউন্সিলর ভাই...গোলাম মুস্তফা কাউন্সিলর ভাই...অদ্য সকাল আট ঘটিকায় নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেসেন। মরহুমের নামাজে জানাজা...মরহুমের নামাজে জানাজা...।

গোলাম মুস্তফা। কাউন্সিলর ভাই। মরে গেল। ইসহাক মিয়া আছেন, নবতিপর। মুস্তফার বয়স কত হয়েছিল? আলেমের ঘরে জালেম জন্মেছিল সে।

ভালো মানুষ টাউনে তিনজন

ইসহাক মিয়া

সুরেশবাবু

শেখ মিরন।

সুরেশবাবুর একমাত্র ছেলে দীপেনের মতো বা শেখ মিরনের দুই ছেলে অহিদ-নভিদের মতো ভালো মানুষ ইসহাক মিয়ার আর দুই ছেলে মনসুর ও সেলিম হয়েছে, মুস্তফা হয় নাই। বেধারা সে। প্রাইমারি স্কুল লাইফেই মার্কামারা হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস টুর ছাত্র, হাফশার্ট হাফপ্যান্ট, গোলাম মুস্তফা, রোল নং ৪৮, কাঁচি বিড়ি পানরত অবস্থায় ধরা পড়েছিল রাজগোবিন্দ স্কুলের কমন বাথরুম থেকে। কমন বলতে স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক সকলের। কাঁচি বিড়ি হলো সিজর্স সিগারেট। সেই এক যুগ। ফিল্টার ছাড়া স্টার, ব্রিস্টল, ক্যাপস্টেন, কাঁচি, থ্রিএ, বগা সিগারেটের রমরমা বাজারে। বগা সিগারেট হলো কিংস্টর্ক সিগারেট। থ্রিএ সিগারেট ছিল সস্তা। স্টার এক শলা বিশ পয়সা, ব্রিস্টল পঁয়ত্রিশ পয়সা, ক্যাপস্টেন চল্লিশ পয়সা। দেদার বিকাত। থ্রিএ শলা দশ পয়সা। দেদার বিকাত। সিগারেটের প্যাকেটে তখনো সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ছাপা হতে শুরু করে নাই : ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তৈয়ব আল আজাদ বা শশাঙ্ক চক্রবর্তীর স্বাস্থ্যের কোনো প্রকার ক্ষতি অবশ্য হয় নাই। ধূমপান, মদ্যপান, জর্দাসহ পান, কোনো ধরনের নেশা ভাং তাঁরা কখনো করেন নাই। সিগারেটে টান দিয়ে দেখেছেন, জর্দাসহ পান খেয়ে দেখেছেন, সহ্য হয় নাই দুই বন্ধুর। সহিদুল এই উপলক্ষে বিরাট বিরক্ত হয়েছিল, ‘তোরা কি বাপি? ক্লাসের ফার্স্ট বয়? রোল নম্বর বিশের কোঠায় থাকে না, তারা টানে না বিড়ি-সিগারেট। জ্ঞানী জৈল সিং আসছেন। কতজনের কত ভঙ্গি দেখলাম।’

সহিদুল এখন পৌর কাউন্সিলর। টাউনের একাংশের নেতা। বাজে নেতা না, ভালো নেতা হয়েছে। উপকার করে মানুষের। সামনে মেয়র পদে নির্বাচন করবে। দুই মেয়াদ আগে মুস্তফা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছিল। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে হেরেছে। তবে সেই থেকে সে কাউন্সিলর ভাই। বিয়ে করেছিল কাউন্সিলর ভাই। তার স্ত্রী করোনা হয়ে মরেছেন। সন্তান-সন্ততি তাদের হয় নাই। ভালো হয়েছে। অকূলপাথারে পড়ত পোলাপান। দুর! একটা মানুষ মারা গেছে, এখন এসব কী ভাবছেন, কেন ভাবছেন তৈয়ব আল আজাদ? ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।

এখন সকাল, না সন্ধ্যা? আকাশ এত ধূসর হয়ে গেল কখন? কাকের গলার পালকের মতো ধূসর। তরুণ কাকের। শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন, ‘নেশা ভাং করলেও মুস্তফা খারাপ মানুষ ছিল না।’

তৈয়ব আল আজাদ বন্ধুকে দেখলেন। নৈর্ব্যক্তিক এতটা উদাসীনতা কোন দিন অর্জন করলেন শশাঙ্ক চক্রবর্তী? তিনি কি ঋষি হয়ে যাচ্ছেন? ঋষি শশাঙ্ক। ঋষি দুর্বাসা, ঋষি ঔতরেয়র মতো। ঋষিদের কি কমণ্ডলু থাকে? ঋষি শশাঙ্ক কৌপীন পরবেন?

তৈয়ব আল আজাদ কোর্ট মসজিদ প্রাঙ্গণে গোলাম মুস্তফা কাউন্সিলর ভাইয়ের নামাজে জানাজায় উপস্থিত থাকলেন।

পাঁচ

ফেসবুকে আছেন তৈয়ব আল আজাদ। কম ঢোকেন, মাথা ধরে যায়। ঢাকার এক তরুণ কবি দুই দিন পর পর আত্মহত্যার ঘোষণা দেয় ফেসবুক লাইভে, দুই দিন পর পর এর-তার ব্যক্তিগত গোপন দৃশ্য ভাইরাল হয়। এত সামাজিক হয়ে গেছে মানুষ!

টাউনের সব কবি ফেসবুকে আছে। প্রায় সবাই ফেসবুকে কবিতা পোস্ট দেয়। এক লাইন, দুই লাইন, আড়াই লাইনের কবিতা। আধ লাইন, দেড় লাইনের কবিতাও হয়তো হচ্ছে। খারিজ করে দিচ্ছেন পুরনো বোয়ালরা। সে তাঁদের ব্যাপার। তৈয়ব আল আজাদ এসবে নাই, ফেসবুকে কবিতা দেন না, তবে খারিজবাদীও না। কে কাকে খারিজ করে দেয়? আলু পটোলকে, পটোল আলুকে? কাঁচা মরিচ সাতকড়াকে, সাতকড়া কাঁচা মরিচকে? ফেসবুকে অ-বাস্তব কাঁচাবাজার বসে সাহিত্যের। চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, ডেওয়া ফল, পাটশাক, লম্বা বেগুন, গোল বেগুন, টমেটো ইত্যাদি মেলে।

পদ্ম কলেজ থেকে ফিরল। বাপের ধ্যান ভঙ্গ করল না। ঘরে ঢুকে গেল। তাঁর মেয়ে তাঁর বর্ণ পেয়েছে। কালো। নাক-চোখ পেয়েছে মায়ের। নাক বোঁচা, চোখে পৃথিবীর মায়া। তার মা পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি, সে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা হয়েছে। তৈয়ব আল আজাদের দূরসম্পর্কের ফুফু মুমতারিন বেগম সাবেক সাংসদ, আফসোসের অন্ত নাই তাঁর, ‘তোর মেয়েটা অইত্যাধিক লম্বা রে তৈয়ব। বিয়া দিবি কেম্নে?’

মুমতারিন বেগমের কথায় কিছু মনে করেন না তৈয়ব আল আজাদ। সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সাংসদ। মোটাদাগের মানুষ মহিলা। টাকা আছে। চিন্তা করে কিছু বলেন না এঁরা—দরকার পড়ে না বলে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে এখনো চিন্তা করেন না তৈয়ব আল আজাদ। গয়নাপাতি গড়িয়ে রাখেন নাই। যখন সময় হবে দেখবেন।—মা মেয়ে একপেট তারা। পদ্ম সব বলে রুবিকে। রুবি সব বলেন পদ্মকে। ছেলে আরেক তরিকার হয়েছে। সালাম দেয়, মান্যিগন্যি করে, আবার কথা বলে কিভাবে—

‘আসসালামআলিকুম আব্বা।’

‘ওয়ালিকুম সালাম।’

‘আপনার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো আব্বা? মন-দিল ভালো?’

মন-দিল আবার কী ধরনের কথা? তবু—

‘ভালো। তোমার শরীর ভালো?’

‘জি, শরীর মাশাআল্লাহ ভালো আব্বা। আরো দুই কেজি গেইন করসি। ব্যাপার না। মন-দিল ভালো নাই। আপনের বয়স হইসে, শশাঙ্ক কাকার বয়স হইসে, আম্মার কি বয়স হয় নাই বলেন? এই বয়সে ফেসবুকে এইসব কী ছবি দেন আম্মা? কী লেখেন? হতাশ লাগে আব্বা!’

কী ছবি দেন, কী লেখেন রুবি? হতাশ লাগে ছেলের। তৈয়ব আল আজাদ ফেসবুকে তদন্ত করে কিছু পেলেন না। কী পাবেন? ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নাই রুবির। তবে?

‘এপ্রিলফুল, আব্বা।’

এপ্রিলফুল! তৈয়ব আল আজাদ কি মমিন আল আজাদকে এপ্রিলফুল বানানোর চিন্তা করেছেন কখনো? কাকে বলে সুদূরপরাহত চিন্তা?

শশাঙ্ক চক্রবর্তীর মেয়ে দুটাও এ রকম পেরেশান করে ছাড়ে বাপকে। রুপালি কি আর দেশে ফিরতে পারবে না? কেন? এই দেশে এই টাউনে এই পাড়ায় জন্মেছে সে।

‘আব্বা।’

পদ্ম।

‘কী?’

‘ভাই কল দিসে।’

‘হ্যাঁ।’

‘ভাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায় আব্বা। আপনি কি এখন কথা বলবেন?’

একি কাণ্ড! বোনকে দিয়ে সুপারিশ করাচ্ছে কেন ছেলে?

‘আমি কি কল দিব তোমার ভাইরে?’

‘জি না আব্বা। জি না, জি না। ভাই লাইনে আছে, নেন, এই নেন কথা বলেন।’

পদ্মর ফোন নিলেন তৈয়ব আল আজাদ।

পদ্ম বলল, ‘আব্বা।’

তৈয়ব আল আজাদ তাকালেন।

পদ্ম বলল, ‘ভাই ডর পায়।’

ডর পায়? কেন?

তৈয়ব আল আজাদ বললেন, ‘হ্যালো।’

জুনুন বলল, ‘আসসালামআলিকুম আব্বা।’

শুকনা গলা ছেলের।

‘ওয়ালিকুম সালাম। কী হইসে তোমার?’

‘আব্বা!’

‘বলো।’

কেঁদে দিল জুনুন। হাউমাউ করে কান্না। তৈয়ব আল আজাদ বিচলিত হলেন না। ছেলে আগে জবানবন্দি দিক। কী হয়েছে? জুনুন বেয়াল্লিশ সেকেন্ড কাঁদল। প্লাস একুশ সেকেন্ড ধরে ফুঁপিয়ে যা বলল তার সারমর্ম হলো, দুপুরে সে বিয়ে করেছে টেসাকে।

অ। টেসা কে?

ভাইয়ের হয়ে বোন ওকালতি করল।

‘টেসা কেরালার মেয়ে আব্বা। মালয়ালাম হিন্দি উর্দু ইংলিশ বাংলা উড়িয়া অসমিয়া ভাষায় কথা বলতে পারে।’

‘তারা কোন ভাষায় কথা বলে? তোমার ভাই আর টেসা?’

‘বাংলা ভাষায় আব্বা। ইংলিশেও বলে। ভাই বলসে মালয়ালাম শিখবে। আমি তারে কী বলব আব্বা?’

‘মালয়ালাম শিখতে বলো। ভাষা শেখা ভালো।’

‘এই কথা না আব্বা। ভাই টেসারে বিয়া করসে, আপনে রাগ হন নাই বলেন?’

‘রাগ হই নাই।’

‘কসম বলেন।’

হেসে দিলেন তৈয়ব আল আজাদ। ছেলের মা কোথায়? টেসার শাশুড়ি? মাস্টার আসছে না কেন এখনো? এত দেরি করে!

রুবির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোকা হলেন তৈয়ব আল আজাদ। বউ-শাশুড়ির এর মধ্যে একপ্রস্ত কথা হয়ে গেছে। শাশুড়ি মুগ্ধ, ‘কী মিষ্টি একটা মেয়ে। চশমা পরে। আমি বললাম, এই মেয়ে, তুমি আমার ছেলেরে বিয়া করসো কেন? বলে কি, জুনুন ছেলে ভালো পাত্র আম্মা। কী মিষ্টি! কী মিষ্টি!’

এই বউ ঘরে থাকলে তো ঘরদোরে মৌমাছি পড়বে। অস্থির তৈয়ব আল আজাদ কল দিলেন শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে, ‘আশ্চর্য! কই তুমি?’

‘গেইটে।’

বলে শশাঙ্ক চক্রবর্তী লাইন কেটে দিলেন। আশ্চর্য! এই বয়সেও তার কাণ্ডজ্ঞান হয় নাই। সে কোন গেইটে? এই বাসার না তার বাসার, সেটা বলবে না? আবার কল দিতে মনস্থ করেই মূর্তিমানের মূর্তি দেখলেন দরজায়, স্বস্তি বোধ করলেন তৈয়ব আল আজাদ।

আবার ডজ। কাক্কাকে কল দিয়েছিল জুনুন। বউমার সঙ্গেও কথা হয়েছে কাক্কার। ভারি মিষ্টি মেয়ে। জুনুন পদ্মর মতো মেয়ে ‘কাক্কা’ সম্বোধন করেছে কাক্কাকে। মহাখুশি শশাঙ্ক চক্রবর্তী। মনে শান্তি পেলেন তৈয়ব আল আজাদ। পদ্মর সঙ্গে কথা হয় নাই ভাইবউয়ের?

‘আপনার ছেলের বউ কথা বলে বলে আমার কান লক করে দিসে আব্বা। এতো কথা বলে! এতো কথা বলে! উফ!’

মালয়ালাম কন্যার ননদিনী তাঁর কন্যাকে দেখলেন তৈয়ব আল আজাদ। আনন্দিত সে। ফোনে কথা বলেই একটা ভিনদেশি মেয়ে এতটা আপন করে নিয়েছে সকলকে। শান্তি।

পদ্ম ভিডিও কল দিল ভাইকে। তৈয়ব আল আজাদ পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে কথা বলবেন।

‘আসসালামআলিকুম আব্বা। আমি পদ্মর বোন টেসা।’

চোখ ভিজে এলো তৈয়ব আল আজাদের।

পদ্ম বলল, ‘একি! ওয়ালিকুম বলেন আব্বা।’

‘ওয়ালিকুম সালাম, বেটি।’

‘আপনি কি রাগত হইসেন আব্বা?’

‘না বেটি, রাগত হই নাই।’

শীতকালে দেশে আসবে তারা। টেসা ও জুনুন। কবি ও রুবি ঠিক করে রাখলেন, জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করবেন।

 

ছয়

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কথা ফলে না। এইবার ফলেছে। তারা বলেছিল, তুমুল বৃষ্টি হবে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। দুপুর থেকে শুরু হয়েছে বর্ষণ। মনে হচ্ছে, টাউন ভেসে যাবে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বৃষ্টির কাটাকুটির মধ্যে। কারেন্ট নাই। হারিকেন ধরিয়ে রেখে গেছে আনতারা। মোম রেখে গেছে। শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে কল দিয়ে হতাশ হলেন তৈয়ব আল আজাদ। শশাঙ্ক চক্রবর্তীর ছাতার স্পোক ভেঙে গেছে, মায়ালতার ছাতার ডাঁটি ভেঙে গেছে। মুশকিল। কিছু একটা উপায় চিন্তা করতে করতে যখন নিরাশ হয়ে পড়েছেন, তৈয়ব আল আজাদ পদ্মকে দেখলেন, উঠান পার হয়ে যাচ্ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে। এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যায় মেয়ে? আস্তে কথা বললে শোনা যাবে না, পদ্ম চিৎকার করে বলল, ‘পিসির ঘরে যাই আব্বা।’

তৈয়ব আল আজাদ হাঁপ ছাড়লেন, শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে আবার কল দিলেন, ‘পদ্ম তার পিসির ঘরে আসতেছে। তুমি পদ্মর ছাতা নিয়া আসো।’

‘বৃষ্টির কনা

যদি যায় গোনা

বৃষ্টির কনা

বৃষ্টির পোনা’

বাকী বিল্লাহ বিরচিত কবিতা। রেঞ্জারের ছেলে বাকী বিল্লাহ। সিক্স সেভেন এইট তিন বছর জুবিলি স্কুলে তৈয়ব আল আজাদদের সঙ্গে পড়েছিলেন। তাঁর রচিত আর কোনো কবিতার হদিস পাওয়া যায় না। একটা কবিতাই লিখেছিলেন। বৃষ্টির পোনা কেন? বৃষ্টি কি মাছ?

কবি ভাবলে মাছ। কবি ভাবলে বেতফল। তৈয়ব আল আজাদ কিছুক্ষণ মাছ দেখলেন। কিছুক্ষণ বেতফল দেখলেন। অন্ধকার শূন্য থেকে ঝরছে। অযুত নিযুত মাছ, অযুত নিযুত খোসা ছাড়ানো বেতফল। যদি যায় গোনা...গুনে দেখবেন?

পদ্মর ছাতা মাথায় দিয়ে শশাঙ্ক চক্রবর্তী উপস্থিত হলেন। ভিজে গেছেন অর্ধেক। বললেন, ‘এই কি বৃষ্টি, বন্যা হয়ে যাবে।’

তৈয়ব আল আজাদ বললেন, ‘হ্যাঁ। এই বছর বন্যা হয় নাই। আষাঢ়-শ্রাবণে সেই রকম বৃষ্টি হলো কই?’

‘এতো বৃষ্টি কি কার্তিকে হয়?’

‘বাদ দেও। বৃষ্টির কণা দেখে কি তোমার মাছের পোনা মনে হয় কখনো?’

‘মাছের পোনা?’

‘বা ধরো খোসা ছাড়ানো বেতফল?’

‘সেটা তোমার মনে হতে পারে, তুমি কবি। আমার মনে হবে কেন?’

‘বাকী বিল্লাহর কথা মনে আছে?’

‘রেঞ্জারের ছেলে? মনে থাকবে না?’

‘তার হদিস জানো?’

‘না। না তো। কী হইসে তার? তোমারে ফোন করসিল নাকি?’

‘আরে না। তার কথা মনে পড়ল।’

‘অ।’

‘জীবনটা মন্দ কাটল না বলো।’

‘তা ঠিক। কত কী দেখলাম। মিলেনিয়াম, নাইন-ইলেভেন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, করোনা মহামারি। জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো।’

‘হ্যাঁ। এক জন্ম ঢের দেখা হলো। কত কী মনে পড়তেসে বৃষ্টিতে! তোমারে একবার ফড়িংউড়ায় নিয়া গেসলাম মনে আছে...?’

‘ফুলনূররে দেখতে। তুমি সব সময় কবি তৈয়ব। জীবনে মায়ার ছলনা দরকার তোমাদের।’

‘কী সুন্দর একটা কথা বললা তুমি! জীবনে মায়ার ছলনা দরকার। বাহ! বৃষ্টি কবি বানিয়ে দিসে তোমারে।’

‘তোমারে কে বানাইসে?’

রাত্র নয়টার দিকে বৃষ্টি ধরল। ইলেকট্রিসিটি ফিরল। ব্যাঙের ডাক চরাচর মুখর করে রাখল। তৈয়ব আল আজাদ ফেসবুকে ঢুকলেন। বৃষ্টিতে সয়লাব হয়ে আছে ফেসবুক। যার যা মনে হয় লিখেছে। বেশির ভাগই ছবি, ভিডিও দিয়েছে। মানুষের মনের এত ভাব আগে জানার সহজ উপায় ছিল না।

আরে! বাকী বিল্লাহর কবিতা পোস্ট দিয়েছে ইশরাক—

বৃষ্টির কণা

যদি যায় গোনা

বৃষ্টির কণা

বৃষ্টির পোনা।’

জুলহাস আহমদ খান পাঠানের ছেলে ইশরাক। সে কবি। প্রচুর লাইক তার পোস্টে পড়েছে। বাকী বিল্লাহ কি ফেসবুকে আছে? ইশরাকের পোস্ট দেখবে? জীবনে একটা মাত্র কবিতা লিখেছে, এই কবিতা কি মনে আছে তার?

বাকী বিল্লাহ কেমন হয়েছে দেখতে?

কেমন ছিল দেখতে?

 

অঙ্কন : শামীম আহমেদ

সাত

দিন কেন হয়?

রাত কেন হয়?

চিরকালীন সিলোক। কোনোকালে কেউ এই সিলোকের উত্তর পায় নাই। ভাবন ঠাকুররা তা-ও ভেবে যায়।

হেমন্তকালের এই সকাল স্নিগ্ধ। অঘ্রান যায়, রাতে হিম পড়ে, শিশিরভেজা ঘাসে এ সময় আধঘণ্টামতো হাঁটেন দুই বন্ধু। জুতা খুলে রেখে খালি পায়ে হাঁটেন। স্থান : বালুর মাঠ, জুবিলি স্কুল। বালুর মাঠ আর বালুর মাঠ নাই, বহু আগে সুবজ ঘাসের দ্বীপ হয়ে গেছে। ভিজে থাকে ভোরে, পায়ে পায়ে তাদের প্রাণ দেয়। তবে কেন এই আজব বিষাদ?—দিন কেন হয়? রাত কেন হয়? বিষাদ, না চিন্তা। ফল সংগ্রাহক আদি মানবরা যারা গুছিয়ে চিন্তা করতে পারত, তারা এই চিন্তা শুরু করেছিল? কেন-চিন্তা।

‘কেন ভবে জন্ম নিলাম

কেন তোমারে দেখিলাম

কেন পুড়ে মরিলাম

কেন কেন রাই

কেনর উত্তর নাই

কোনো কেনর উত্তর নাই’

—আনাল ফকিরের গান।

নিরুত্তর এক মহাজিজ্ঞাসা কেন।

দুর! আনন্দে থাকো কবি তৈয়ব আল আজাদ। কবিতা বানাও। টাউনের দুই তরুণ কবি প্রকাশনা সংস্থা করেছে। জাদুকাটা প্রকাশন। এরা ধরেছে, একটা বই দিতে হবে। সম্মত হয়েছেন। পাণ্ডুলিপি গোছাচ্ছেন। বই উৎসর্গ করবেন নবদম্পতি শ্রীমান জুনুন ও শ্রীমতী টেসাকে। পদ্ম প্রুফ দেখে দেবে ফর্মা দুই হাজার টাকা করে দিলে।

‘দুই হাজার টাকা!’

‘দুই হাজার টাকা কম হয়ে যায় আব্বা। দুইটা মাত্র নোট, ভাবেন একবার।’

‘টাউনের সেরা প্রুফ রিডার বিভুদা। সে ফর্মা নেয় তিন শ টাকা।’

‘সে কি কবিকন্যা পদ্ম আজাদ আব্বা? কী যে বলেন না বলেন আপনি? ও মোর আল্লাহ!’

চার ফর্মার বই। আট হাজার টাকা পাবে পদ্ম। জুনুন থাকলে বোনের সঙ্গে লাগত। টেসা কি বইয়ের প্রুফ দেখতে পারে?

আজ কত তারিখ অঘ্রানের? ১৮, না ১৯? ২১ অঘ্রান রাতে মরেছিল হারুন। তার ছোটখাটো ডেডবডি হাসপাতালের ইমার্জেন্সির বেডে পড়ে ছিল। স্কুল লাইফ থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছেন, তাঁরা বিচলিত হয়েছিলেন। নামাজে জানাজায় শরিক হয়েছিলেন হারুনের। অনল্প মানুষের জানাজা। বিয়েশাদি করে মরে নাই হারুন, তার মৃত্যুসংবাদ শুনে আনজুম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। থুতনি কেটে গিয়েছিল আনজুমের। তিনটা সেলাই দিতে হয়েছিল। ঘোড়ার মুখের খবর। ঘোড়া না ঘোড়ী। দীপশিখা বলেছিল শশকঅঙ্ককে। বাংলার অধ্যাপক বোধিসত্ত্ব বড়ুয়া শশাঙ্ককে ডাকতেন শশকঅঙ্ক। দীপশিখা শশকঅঙ্কের প্রেমে পড়েছিল। শশকঅঙ্ক বুঝতে পারে নাই। দীপশিখা এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, স্বামী ডাক্তার, দুই কন্যা তাদের—তারা দীপশিখার মতো রূপবতী হয়েছে।

বাসস্ট্যান্ড রোডের মেয়ে দীপশিখা। জীতেন পণ্ডিতের মেয়ে দীপশিখা পণ্ডিত। ইংরেজির জাহাজ জীতেন পণ্ডিত স্যার। প্রচুর প্রাইভেট টিউশনি করতেন। তবে ঘরদোর করতে পারেন নাই। বিনা পয়সায় পড়াতেন অধিকাংশ ছাত্রকে। ভাড়া বাসায় থেকে মরেছেন। তাঁর কন্যার জননী কন্যাকে দুধের শিশু রেখে মরেছিলেন। জীতেন পণ্ডিত দ্বিতীয় পরিবার নেন নাই। কন্যার অযত্ন হবে। দীপশিখা বড় হয়েছে বলতে গেলে বাড়িঅলা ফরিদ তহশিলদারের বউঝিদের তদারকিতে। আনজুম ওই ফরিদ তহশিলদারের মেয়ে। দীপশিখার দুই মাস দুই দিনের ছোট। দুই মেয়ে, দুই ছেলের জননী আনজুম এখন লন্ডনের বাসিন্দা। তার বড় মেয়ে রাজনীতি করে। বড় কিছু হবে। কিছুদিন আগে একটা জাতীয় দৈনিকে তার ছবি ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। আনজুম ফেসবুকে আছে। পদ্মর সঙ্গে আছে।

জীতেন পণ্ডিত স্মরণে বহুদিন পর শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে সম্বোধন করলেন তৈয়ব আল আজাদ, ‘শশকঅঙ্ক।’

দিন ফিরে আসে।

ফিরে ফিরে আসে।

না। যায় যে দিন যায়।

শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন, ‘দীপশিখা ফোন করসিল।’

‘কী?’

‘হ্যাঁ। রাতে।’

এসব কী রকমভাবে ঘটে? কত দিন পর আজ তৈয়ব আল আজাদ দীপশিখার কথা মনে করলেন, সেই দীপশিখা কাল রাতে ফোন করেছিলেন শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে! কেন?

বরের সঙ্গে কিছু সমস্যা হয়েছে দীপশিখার। মানুষটার সঙ্গে আর থাকবে না সে। অস্ট্রেলিয়ায়ই থাকবে না। দেশে ফিরবে। শুনেছে হাউজিং ব্যবসার রমরমা টাউনে। ফ্ল্যাট কিনবে। শশাঙ্কদাকে সেই ফ্ল্যাট কেনার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে।

‘দেশে কি সে একা ফিরবে? তার দুই মেয়ে?’

‘আমি এইসব কিছু জিগাই নাই।’

‘ভিডিও কল?’

‘কী?’

‘ভিডিও কল দিসল দীপশিখা?’

‘না।’

‘অ।’

‘আরে! তোমার মুখ ব্যাজার হয়ে গেল কেন? তোমার কথা মনে আছে তার।’

‘আমি সেই কথা বলি নাই। আমাদের বয়স হইসে।’

‘বয়স আমার হইসে। তোমার হয় নাই।’

রুবি প্রকাশিত হলেন দরজায়, ‘আদাব।’

শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন, ‘আদাব।’

তৈয়ব আল আজাদ বললেন, ‘আদাব।’

রুবি অল্প হেসে দিয়ে তাঁর শশাঙ্কদাকে বললেন, ‘বাসস্ট্যান্ড রোডের দীপশিখা দিদি কি তোমারে ফোন করসিল নাকি? নাম্বার নিল তোমার।’

কোনোকালে এই জগৎ-সংসারে আমোদের অভাব পড়িবে না। কার কথা এটা? যাঁর কথা তাঁকে মনে মনে একটা সালামালিকুম দিলেন তৈয়ব আল আজাদ। 

—আসসালামুআলাইকুম। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

 

আট

দুষ্ট প্রকৃতির বালক তাঁরা ছিলেন না। তৈয়ব আল আজাদ, শশাঙ্ক চক্রবর্তী। গুলতি দিয়ে পাখি মারেন নাই, পাখির ডিম চুরি করেন নাই। এসবে দড় ছিল পারভেজরা। পারভেজ, অপি, নীহার, মাসুক। গ্যাং ছিল তারা। নদীর পারের আইয়ুব কাকার ছেলে পারভেজ। আইয়ুব কাকা মুজিবর উকিলের মুহুরি। ঠাণ্ডা মানুষ। ঠাণ্ডার ঘরে ষণ্ডার জন্ম, কলেজ লাইফে বাম রাজনীতি করে চার-ছয়বার জেল খেটেছে পারভেজ। বিপুলসংখ্যক ভোট পেয়ে কলেজ সংসদের জিএস নির্বাচিত হয়েছিল। বড় নেতা হতো। টাউন থেকে নাই হয়ে গেল একদিন। নাই তো নাই, ছায়াচিহ্ন নাই। আইয়ুব মুহুরির ছেলে পারভেজ খুন হয়ে গেছে—ফিসফাস অব দ্য টাউন ছিল বহুদিন। এটা তৈয়ব আল আজাদের ভালো লাগে নাই। খুন হয়ে যাবে কেন পারভেজ? এত খারাপ ছিল না সে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। বুকের পাটা ছিল। বছর দেড়েক পর একদিন জানা গেল, পারভেজ খুন হয় নাই। আমেরিকা থেকে দুপুরে তার বাপকে টেলিফোন করেছিল সে, মুজিবর রহমান উকিলের ল্যান্ডফোনে।

সেই পারভেজ ত্রিশ বছর পর ফিরেছে টাউনে। আমব্রোসিয়া রেস্টুরেন্টে কাল একটা রি-ইউনিয়ন হয়েছে বন্ধুদের। জমজমাট রি-ইউনিয়ন।

সেই ষণ্ডা গোছেরই আছে পারভেজ। এই বয়সেও। পর্ন ফিল্মে কাজ করেছে বলল।

‘পর্ন ফিল্ম? ব্লু ফিল্ম?’

‘হ্যাঁ। ব্লু ফিল্ম। বুলু। বুলু।’

‘তুই কি করছিস? ডিরেকশন দিছিস?’

‘রোল প্লে করসি ব্যাটা।’

‘রোল প্লে মানে?’

‘রোল প্লে মানে বুঝিস না? আয় তোরে করে দেখাই!’

তার অবদানে সমৃদ্ধ দুটি পর্ন ছবির নাম বলেছে পারভেজ। ‘ইন্ডিয়ান ডক্টর ইজ ইন’ এবং ‘হি থিংকস আ’ম শি’। আমাদের দেশে এসব নিষিদ্ধ। গুগল সার্চ দিলে শো হয় না। পারভেজ বলেছে, জনহিতার্থে সে একটা শোর ব্যবস্থা করবে।

এগারোজন সমবেত হয়েছিল—পারভেজ ও তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কামরুল ছাড়া। পারভেজের হিসাবে সমবেত এগারোজনই মেয়াদোত্তীর্ণ পশু হয়ে গেছে। গবাদি পশু। বিয়ে করে বাচ্চা উৎপাদন করে এত দিন ধরে আছে সংসারে। কী করতে? জাবর কেটে মরতে?

পারভেজ বিয়ে করে নাই। লিভ ইন করে। তার লিভ ইন পার্টনার মিরিয়াম। তানজানিয়ান মহিলা। আট বছর ধরে তারা একসঙ্গে আছে। মিরিয়ামের বয়স ছেচল্লিশ। অ্যাক্টিভিস্ট কবি।

‘তার কবিতার বই আছে?’

‘ওরে! তুই তো আবার কবিরে বন্ধু। মিরিয়ামের প্রকাশনা আছে তিনটা। আমি তোরে দিব। কবিতার বই দুইটা, নিবন্ধের বই একটা। তোর ভালো লাগবে। ভালো লিখে সে।’

সকালে পারভেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট কামরুল দুইটা কবিতার বই দিয়ে গেছে। চা নাশতা করে বই দুইটা উল্টেপাল্টে দেখেছেন তৈয়ব আল আজাদ, কিছু পড়েছেন। মুগ্ধ হয়েছেন। অসামান্য কবি মিরিয়াম। তার কবিতার বই দুইটার নাম ‘আওয়ার গ্লাস পলিন অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ এবং ‘দিস ইজ নট আ ট্রি’। কবির নাম মিরিয়াম ওলকট। দুঃখ প্রকাশ করতে ফোন দিয়েছিল পারভেজ, মিরিয়ামের নিবন্ধের বইটা পায় নাই, কুরিয়ারে পরে পাঠিয়ে দেবে। তৈয়ব আল আজাদ তাকে আশ্বস্ত করেছেন, তাতে কোনো সমস্যা আপাতত নাই, মিরিয়ামের বিশুদ্ধ কবিতা পড়ে কয়েকটা দিন কেটে যাবে তাঁর। পারভেজ অত্যধিক খুশি হয়েছে। মিরিয়ামকে বলবে বলেছে।

এখন শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন, তাঁর পারভেজের কথা বিশ্বাস হয় নাই।

‘কোন কথা? তার বউ কবি? এই কথা কিন্তু সত্যি।’

‘এই কথা না, আরো অনেক কথা সে বলসে।’

‘কোন কথা, বলো?’

‘না।’

‘না কেন, বলো। পারভেজ স্পষ্টবাদী।’

‘বেশি স্পষ্টবাদী।’

শশাঙ্ক চক্রবর্তী আর কিছু বললেন না। পারভেজের কোন কথা তাঁর আঁতে লেগেছে সেটা শুনতে বন্ধুকে আর পীড়াপীড়ি করলেন না তৈয়ব আল আজাদ। একসঙ্গে পড়েছেন, বড় হয়েছেন, বন্ধুই বলবেন, কিন্তু দিনশেষে কী আসলে, দুই দিনের বৈরাগী পারভেজরা। তারা বন্ধু, তিনি ও শশাঙ্ক চক্রবর্তী। সুখে-দুঃখে আনন্দ-বেদনায় বন্ধু। হাড়ে আঁতে চেনা পারস্পরিক। বুদ্ধিসুদ্ধি হওয়ার পর থেকে একপেট। নিরীহ শান্ত ঠাণ্ডা মানুষ শশাঙ্ক চক্রবর্তী কিছু একগুঁয়ে আছেন ভেতরে। তেজমণ্ডিত দীপশিখা এই ‘ছোড়দা’ মার্কা ছেলের প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রেম কি এই বয়সেও যায় নাই? শশাঙ্ক চক্রবর্তীর দিক থেকেও যায় নাই? ফ্ল্যাট খুঁজছে সে দীপশিখার জন্য। এই হাউজিং ওই হাউজিংয়ে যায়। সঙ্গে যায় কে?

—তৈয়ব আল আজাদ।

তাদের এই পারফরম্যান্সে রুবি হতাশ, ‘এইটা কোনো কথা!’—বলে হেসে দিলে কথাটা কি আর হতাশাবাদী বিবেচনার পর্যায়ে থাকে?

‘পরকীয়া করতেসো তোমরা। এই বয়সে!’

‘আমরা মানে? শশাঙ্ক করতেসে।’

‘শশাঙ্ক করতেসে! তুমি সুযোগ পাইলে করবা না বলো?’

‘আরে না! কী বলো তুমি।’

‘কী বলি? তুমি কবি পদ্মর আব্বা। পরকীয়ায় এক্সপার্ট হেডমাস্টার তোমরা। হ্যাঁ। আমি এই রুবি না থাকলে দেখতাম।’

কী দেখতেন রুবি?

না থাকলে আবার কী করে দেখতেন?

বিরাট প্যারাডক্স।

তরল চিন্তা। মানুষের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে কিছু বই পড়েছেন তৈয়ব আল আজাদ। মানুষ বহুগামী। তারা বলছে। পৃথিবীর সকল মানুষ।

 

নয়

পদ্ম সবুজ কার্ডিগান পরেছে। কলেজে যাচ্ছে। মিরিয়াম ওলকটের বই দুইটা মেয়েকে পড়তে দিয়েছিলেন তৈয়ব আল আজাদ। সে পড়েছে। জুনুন, টেসাকে বলেছে পড়াবে।

মিরিয়াম ওলকট আপাতত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাই।

পদ্ম বলল, ‘আব্বা।’

‘হুম্।’

‘হুম্ কী আব্বা? কথা তো বলবেন। ভাই আপনারে ডর পায়। আমি কি ডর পাই বলেন? বলেন আমি আপনেরে ডর পাই?’

‘না। ডরভয় তোমার অন্তরে নাই।’

‘থ্যাংক ইউ আব্বা। এখন একটা স্মাইল দেন দেখি। হাসেন! আরে!’

নিজেও হাসিমুখ করে বাপের সঙ্গে একটা সেলফি উঠিয়ে চলে গেল পদ্ম। নম্র রোদে মেয়েকে একটা প্রজাপতিনী মনে হলো বাপের। এই সেদিন আঁতুড়ঘরে ঢুকে দেখলেন।

সংসারের যা নিয়ম, মেয়ের বিয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। তবে সেটা মেয়ে যেদিন বলবে। প্রেম করে সে? না। কিন্তু প্রেমিকের অভাব নাই তার। ছাত্রনেতা, কবি, গায়ক, লোকাল ব্যান্ডের ভোকালিস্ট আছে লিস্টে। ব্যাচেলর অধ্যাপক আছে। এদের কাউকেই মেয়ের পছন্দ না।—কেন?

‘আমি মনে হয় আরেক রকম আম্মা। আব্বা, ভাই আর কাক্কা ছাড়া আর কোনো পুরুষ মানুষরে আমার পছন্দ হয় না, বিশ্বাস করেন।’

‘বিশ্বাস করসি। বিয়া করবি না?’

‘যদি না করি? রাগ করবেন আম্মা?’

মেয়ের এই সমস্ত কথা তার বাপকে অবগত করেছেন রুবি। তৈয়ব আল আজাদ বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধরে থাকতে বলেছেন রুবিকে। তাঁদের কন্যার যা বয়স, বসন্ত-বাতাসের মতো মন তার এখন।

বসন্ত বাতাস বা প্রজাপতিনী।

গোলোকপুর থেকে পলু কল দিল।

মকবুল হোসেন চাচার ছেলে পলু। গোলোকপুরের সহায়-সম্পত্তির দেখাশোনা করেন মকবুল হোসেন চাচা, পলু তাঁর সহকারী মতো। এরা না থাকলে কিছু না করে এই জমিদারের জীবন কাটাতে হতো না। তৈয়ব আল আজাদ কল ধরলেন। পলু যা বলল সব দরকারি কথা। কিন্তু নীরস, ভালো না শুনতে। তবু কত কথা আমাদের শুনতে হয়।

মকবুল হোসেন চাচার লেখাপড়া কম, বিবেচনা বেশি। দলিল-দস্তাবেজ পানির মতো বোঝেন। পলু এত দড় এখনো হয় নাই। তবে ছেলে করিতকর্মা। হোস্টেলে থেকে টাউনের কলেজ থেকে বিকম পাস করে গেছে।

পলু হিসাব দিল, এই বছর তিন হাজার মণ ধান তারা পেয়েছে। তৈয়ব আল আজাদের জমিদারি চলে মূলত এই ধান বেচা টাকায়। সামনের মাসের দুই তারিখে পলু কিছু টাকা দিয়ে যাবে। শিবালয়ের কোবাদ মহাজন তাঁর ম্যানেজারকে দিয়ে পাঠাবেন। পাঁচ শ মণ ধানের দাম বাবদ অগ্রিম। কোবাদ মহাজনের বায়না এক হাজার মণ। ত্রিশ-বত্রিশ বছর ধরে কারবার মহাজনের সঙ্গে, তৈয়ব আল আজাদ মানুষটাকে কখনো দেখেন নাই। ফোনে কথা বলেছেন কয়েকবার।

পলু সালাম দিয়ে ফোন রাখল। তৈয়ব আল আজাদ শুকরিয়া আদায় করলেন পরম করুণাময়ের দরবারে।

 

দশ

আলফাতা ইশতিয়াক, শিপন মুস্তাফা, নওশাদ মসরু, সুলতান সুলেমান। দর্শনির বিনিময়ে টাউনের চার তরুণ কবির কবিতাসন্ধ্যা। তৈয়ব আল আজাদ সপরিবারে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। গিয়েছিলেন। মুগ্ধ হয়েছেন। হাউসফুল শো। কবিতা এখনো শোনে মানুষজন! দর্শনির বিনিময়ে শোনে! তৈয়ব আল আজাদ কবিদের প্রতি দোয়ামূলক বক্তব্য রেখেছেন। মানুষ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। কবিতা পড়ার অনুরোধ উঠেছিল, মাইকস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে যান নাই। চার কবিই পূর্বপরিচিত পদ্মর। কলেজের সিনিয়র। নওশাদ মসরু গত বছর স্কলারশিপ পেয়ে চলে গেছে রাশিয়ায়। ছুটিতে দেশে ফিরেছে। কবি বাহিনীকে রুবি দাওয়াত দিয়ে এলেন, শুঁটকি বড়া, চিতলের কোপ্তা খাওয়াবেন। জুনুনের বয়সী এরা। জুনুন তার ছেলেটা—বিরাট বদমায়েশ। ছেলের বউ টেসা—ছোট্ট এক মেয়ে বদমায়েশ। তৈয়ব আল আজাদ সস্নেহে ভাবলেন। কেরালার মেয়ে না টেসা। বরিশালের মেয়ে। টেসা পলিকার্প রোজারিও। কয়েকটা ভাষা অবশ্য পারে। প্রথম দিন শ্বশুরের সঙ্গে ‘ফান’ করেছিল। শাশুড়ি, ননদিনী সেটা জানতেন। দেখো কাণ্ড! ‘তুমি একটা কিউটের ডিব্বা টেসা। তুমি একটা মায়ার বাক্স টেসা।’—পদ্ম বলে।

কিউটের ডিব্বা, মায়ার বাক্স। মিষ্টি লাগে শুনতে। জাদুকাটা প্রকাশনের একটা ছেলেকে কল দিলেন তৈয়ব আল আজাদ, ‘তানভীর।’

‘জি কবি। স্লামালিকুম।’

‘ওয়ালিকুম সালাম। শোনো তানভীর। আমার বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করতে দিতে পারো আর্টিস্টরে।’

‘জি কবি। নাম ঠিক করসেন?’

‘করসি। মায়ার বাক্স, ঘুমাও।’

‘কী-ই-ই? মায়ার বাসকো—’

‘বাসকো না তানভীর, বাক্স। বইয়ের নাম, মায়ার বাক্স, ঘুমাও।’

‘স্লিপ অব টাং গুরু। মায়ার বাক্স, ঘুমাও। অসাধারণ নাম হইসে! এখনই মেইল করে দিতেছি আর্টিস্টরে।’

‘কবিতা দিবা না?’

‘আর্টিস্টরে? আর্টিস্ট কবিতা পড়ে না কবি। নাম শুনে প্রচ্ছদের ডিজাইন করে দেয়।’

এ আবার কোন আর্টিস্ট? নাম শুনে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করে দেয়! ‘মায়ার বাক্স, ঘুমাও’ কী আঁকবে সে? এসব নিয়ে কোনোকালেই কথা বলেন না তৈয়ব আল আজাদ। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও বললেন না। বই ছাপার আগে প্রকাশক যদি প্রচ্ছদের ডিজাইন দেখায় দেখবেন। না হলে দেখবেন না। জুনুন টেসা আসার অন্তত এক দিন আগে তাঁর বইটা দরকার।

‘মায়ার বাক্স, ঘুমাও’ নামটা পদ্ম অত্যধিক পছন্দ করল এবং রয়ালিটি দাবি করে বসল।

‘রয়ালিটি? কেন? কিসের?’

‘আসমান থেকে পড়বেন না আব্বা। মায়ার বাক্স, ঘুমাও। মায়ার বাক্স কথাটা আপনি আমার কথা শুনে লেখেন নাই বলেন। কিরা কেটে বলেন।’

‘লিখসি।’

‘লিখসেন! এইতো। এখন এই কথাটা তো আমার কপিরাইট করা আব্বা। আমার বৈধ অনুমতি ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। অনুমতি নিয়া ব্যবহার করলে বুঝছেন তো রয়ালিটি দিতে হবে আমারে। আইন অনুযায়ী রয়ালিটি তিন সাড়ে তিন হাজার টাকা আসে। আপনি না হয় এক হাজার টাকাই দিলেন আব্বা।’

‘সেই তো।’

‘সেই তো কী আব্বা? সেই তো কী? আজ নগদ কাল বাকি। নগদে আপনি আমার রয়ালিটি পরিশোধ করে দেন আগে। দুইটা না, তিনটা না, একটা মাত্র নোট। দেন না আব্বা।’

রুবিও পছন্দ করলেন নামটা, ‘ভালো। মিষ্টি। এই রকম নাম তুমি আগে আর দেও নাই। মায়ার বাক্স, ঘুমাও। বাহ!’

মায়ার বাক্স কল দিল রাতে। শাশুড়ি, ননদ, শ্বশুরের সঙ্গে পাক্কা এক ঘণ্টা সাতচল্লিশ মিনিট কথা বলল। শেষ বত্রিশ মিনিট ননদের সঙ্গে। কথার অন্তে পদ্ম তাকে বলল, ‘মায়ার বাক্স, ঘুমাও।’

 

এগারো

স্বপ্ন দেখে তৈয়ব আল আজাদ ঘুম থেকে উঠে হতভম্ব হলেন। বা বিকল্প পাঠ হতে পারে, তৈয়ব আল আজাদ স্বপ্ন দেখে হতভম্ব হয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। আগা নাই মাথা নাই স্বপ্ন। ওসব এখনো আছে শরীরে? আছে। কী যে দেখলেন! তবে ফুলনূরকে দেখবেন ভাবেন নাই। ফড়িংউড়ার দুন্দু কারিগরের মেয়ে ফুলনূর। দুন্দু কারিগর মাটির পুতুল গড়ে। তার মেয়েও এক মাটির পুতুল। পলিমাটি দিয়ে বানানো।

মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তৈয়ব আল আজাদ প্রথম ফড়িংউড়া গিয়েছিলেন হাবিবুরের সঙ্গে। ‘ডাকাইত’ হাবিবুর। বঁটি দা দিয়ে তরজার বেড়া কেটে এক ভাবির ঘরে ঢুকে পড়েছিল। সফলকাম হয় নাই যদিও। ধরা পড়ে হেনস্তা হয়েছিল।

ফড়িংউড়া মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক রব শিকদার। তার একমাত্র শালা হাবিবুর। তৈয়ব আল আজাদকে আনাল ফকিরের মোকামে নিয়ে গিয়েছিল সে। জীবিত কিংবদন্তি আনাল ফকির বসে ছিলেন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে। মঞ্চে গান করছিল ফুলনূর—

‘যাইবার কালে কতজনে

কত কথা কয়ে যায় গো

অর্থ কী হয় সেই কথার

অর্থ কী হয়...’

হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা কালো ফুলনূর। নীল ওড়না। চোখে ধরেছিল সদ্য তরুণ কবি তৈয়ব আল আজাদের। হাবিবুর ঘুুঘু বিশেষ। ভাবগতিকে বুঝে গিয়েছিল সব। ফুলনূরের সঙ্গে কবিবন্ধুর দেখা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মোকামের পুকুরের পারে। সেদিকে আলোর কমতি থাকলেও মানুষের চোখ মুখ নাক বোঝা যায়, ডৌল বোঝা যায়। ফুলনূরের শরীর বোঝা যাচ্ছিল। ফুলনূরের ঘ্রাণ উড়ছিল হাওয়ায়। বোবায় ধরেছিল ‘জাগন্ত’ তৈয়ব আল আজাদকে।

‘গান শুনসি। ভালো লাগসে।’

‘এনে কী? গান শুনবেন?’

‘ন্-ন্-না। নাহ!’

‘কী করবেন? হি হি হি! আমারে ধরবেন?’

চরম বিব্রতকর পরিস্থিতি। য পলায়তি স জীবতি...তরুণ কবি ঝেড়ে দৌড় দিয়েছিল। হাবিবুর বিরক্ত হয়েছিল, ‘তুমি দোস্ত কামলা না বুঝছি। ছেড়ির বুকে হাত দিসো?’

‘কী বলো?’

‘আরে দোস্ত, পঞ্চাশ ট্যাকা দিসি আমি ছেড়িরে। তুমি কিছু করো নাই? হায় হায়রে!’

‘কী করবো?’

‘কী করবা? কদমবুসি করবা ছেড়িরে! আর কী করবা? হায় হায়রে! আমার সলিড পঞ্চাশ ট্যাকা লস!’

মেট্রিক পাস করতে পারে নাই, পরের বছর শ্রমিক ভিসার ব্যবস্থা করে ইতালি চলে গিয়েছিল হাবিবুর। তার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয় নাই। কলেজ গোয়িং তৈয়ব আল আজাদ পরে অনেকবার গেছেন ফড়িংউড়ায়। আনাল ফকিরের মোকামে থাকে ফুলনূর, আনাল ফকির ফুলনূরের বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিরামপুরের লতিফ বাজনদারের সঙ্গে। ফুলনূর বয়স্ক মানুষটার সঙ্গে থাকে নাই। পালিয়েছিল লতিফ বাজনদারের সাগরেদ বেটির গাঁওয়ের হাসন আলির সঙ্গে। থাকতে পারে নাই চরম নেশাখোর হাসন আলীর সংসারেও। মোকামে ফিরেছিল, চরণসেবা করবে আনাল ফকিরের। কিন্তু তার জাত আলাদা। পলিমাটির শরীর তত দিনে আরো সিজিল হয়েছে। চোখ থেকে যায় না।

পৃথুলা সেই রঙ্গিণী ফুলনূরকে স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠেছেন, অস্বস্তি লাগল, রুবির মুখ দেখলেন তৈয়ব আল আজাদ। ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে। সুখীত্তা মুখ। রুবি কি সুখী?

ত্রিপুরার কবি দিব্যজ্ঞান মূকুটমণি খুবই আশ্চর্য হয়েছিলেন, ‘বলো কী দাদা? বউদি ছাড়া আর কোনো কেউ না?’

‘না ভাই।’

‘তুমি আর কারো বডি টাচ করো নাই? চুমুটুমু খাও নাই?’

‘না।’

‘তুমি দাদা হোমোসেপিয়েন্স না। হা হা হা!’

রুবিও হোমোসেপিয়েন্স না তাহলে। তারা স্বামী-স্ত্রী আলাদা প্রজাতির।

কসম, ফুলনূরকে বহুদিন আর মনে ছিল না তৈয়ব আল আজাদের। আনাল ফকির বিলীন হওয়ার আগেই মোকাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল ফুলনূর। কেউ বলে কামরূপ-কামাখ্যায় গেছে, কেউ বলে আজমিরে। ফুলনূরের কি কোনো সন্তান হয় নাই? নাকি সে নেয় নাই?

স্বপ্ন এত জলজিয়ন্ত হয়? অশান্তি লাগল তৈয়ব আল আজাদের। যেন বিরাট অপরাধ করে ফেলেছেন। ফুলনূরের সঙ্গে শুয়েছেন গোপনে।—সংকোচ লাগছে রুবির দিকে তাকাতে। তবু আবার তাকালেন। আলো-অন্ধকারে রুবিকে দেখলেন। ‘আট বছর আগের একদিন’-এর ‘উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা’ ঘরে। রুবি ঘুমিয়ে আছে জলের নিচে বুঝি, শান্ত পঙক্তির মতো কবিতার।

দুর! স্বপ্ন কি কেউ নিজে বানায়?

স্বপ্নটা তৈয়ব আল আজাদ রুবিকে বলবেন?

মাথা খারাপ।

রুবির বিষাদ অসহনীয়।

‘আকর্ষণ মরে যায়, ভালোবাসা মরে না পঙ্খী।’

আকর্ষণ মরে গেছে তৈয়ব আল আজাদের?

এক ফোঁটা না।

আকর্ষণ মরে নাই, ভালোবাসা মরে নাই।

রুবি এক সহজ রহস্যময়ী। আকর্ষণের অধিক মায়াবিস্তারী। স্বপ্নে ফুলনূরকে দেখিলে কী হয়?—খাবনামায় নিশ্চয় লেখা নাই। শশাঙ্ক চক্রবর্তীর ব্রেইনে লেখা থাকতে পারে। তিনি কী বলেন দেখা যাক।

ব্রাহ্মণ সন্তান শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে বয়সোচিত চিন্তায় ধরেছে ইদানীং। মানে অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক যে চিন্তাকে বয়সোচিত বিবেচনা করেন। সে কেমন? কামবাসনামূলক চিন্তাকে এখন কুচিন্তা মনে হয় শশাঙ্ক চক্রবর্তীর। কথা হলো, চিন্তা আর স্বপ্ন এক না। মানুষ চিন্তা করে, স্বপ্ন করে না।

রুবি স্বপ্ন দেখছেন, চোখের পাতা কাঁপছে। স্বপ্নবিদ্ধ রুবির মুখাবয়ব দেখতে দেখতে আবার ঘুম ধরে গেল তৈয়ব আল আজাদের।

পদ্ম ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে দেখল আব্বা উঠেন নাই, আম্মা উঠেন নাই। উঠান ঝাঁট দিচ্ছে আনতারা। চিনি ছাড়া এক কাপ চা বানিয়ে পদ্ম আব্বা-আম্মার ঘরে ঢুকল। ও মোর আল্লাহ! ঘুমের ঘোরে নিশ্চয় আব্বার হাত আম্মার মুখের উপর পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, আব্বা আম্মার নাক টিপে ধরে আদর করছেন।

বয়স্ক নায়ক-নায়িকা আরো মিনিট দশেক পর ঘুম থেকে উঠলেন।

 

অঙ্কন : শামীম আহমেদ

বারো

কবি সুলতান সুলেমান অ্যাকসিডেন্ট করেছে। জাদুকাটা প্রকাশনের তানভীর ফোন করে এই সংবাদ দিল। তৈয়ব আল আজাদ বিচলিত হলেন। সাদউল্লাহ ক্লিনিকে আছে সুলতান সুলেমান। মল্লিকপুরে বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছে, একটা বাছুরকে বাঁচাতে গিয়ে। বাঁ পায়ের পাতার হাড় গুঁড়া হয়ে গেছে। তৈয়ব আল আজাদ মনস্থ করলেন, সাদউল্লাহ ক্লিনিকে যাবেন।

পদ্ম বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে যাই আব্বা।’

‘চলো।’

ছয়তলা সাদউল্লাহ ক্লিনিকের তিনতলায় আছে সুলতান সুলেমান। দুই শ এগারো নাম্বার কেবিন। লিফটে দেখা হলো কবি আলফাতা ইশতিয়াক ও শিপন মুস্তাফার সঙ্গে। তারাও সুলতান সুলেমানকে দেখবে। আগে থেকেই কেবিনে আরো কয়েকজন কবি ছিল টাউনের। কবিসভা হয়ে উঠল কেবিন। পদ্মর পরিচিত কবি সকল। বরং তৈয়ব আল আজাদ এই প্রথম দেখলেন টাউনের দুই তরুণ কবিকে। পদ্ম ভূমিকা রাখল, ‘আব্বা, এই হলেন জিনাত আপা। জিনাত নাওয়ার। আপার কবিতা আপনি পড়সেন। এই কবির কবিতাও পড়সেন। এ হলো কবি নাসুম জিবরান।’

আহত সুলতান সুলেমান মনে হলো খুবই বিব্রত সমস্ত ঘটনায়। টাউনের আরো দুই সিনিয়র কবি এলেন আহত তরুণ কবিকে দেখতে। কাজির পয়েন্টের কবি আবু নুমান এবং মড়ার টিলা রোডের কবি শামসুদ্দিন ‘মনাক্কা’ ভাই। রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সহানুভূতি দেখিয়ে তাঁরা কুশল বিনিময় করলেন তৈয়ব আল আজাদের সঙ্গে। পদ্ম সালাম দিল দুই কবিকে। দুই কবি আপ্লুত হলেন। দোয়া দিলেন, বিশ্ববিখ্যাত হবে পদ্ম।

আবু নুমান বললেন, তাঁর বয়স এই বছর আটষট্টি হয়েছে। মনাক্কা ভাইয়ের বয়স সামনের ডিসেম্বরে পঁচাত্তর হবে। নাতি-নাতকুরের বিয়ে হয়ে গেছে, মনাক্কা ভাই গত বছর বিয়ে করবেন বলে ভাইরাল হয়েছিলেন।

সুলতান সুলেমানের পরিবারের কেউ তাকে দেখতে আসে নাই নাকি? বোন দুইটা ছাড়া আর কেউ আসে নাই। তারাও এসে দ্রুত চলে গেছে। ছেলে বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছে শুনে মনসুর উকিল বেজায় খেপেছেন। ঘোষণা দিয়েছেন, ছেলেকে জুতাপেটা করবেন। অনায্য এই আচরণ মোটে ভালো লাগল না তৈয়ব আল আজাদের। মনসুর উকিলের ফোন নাম্বার আছে তাঁর ফোনে। ফোন করে কথা বলা যায়। কিন্তু মনসুর উকিল টাউনের বিখ্যাত গোঁয়াড়। গোঁয়ার্তুমির জন্য কলেজ লাইফে ‘খোদাই ষাঁড়’ উপাধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যাক। ছেলেটাকে জুতাপেটা না করলেই হলো।

‘তোমার বইটা কি প্রকাশিত হইসে?’ তৈয়ব আল আজাদ বললেন।

সুলতান সুলেমান বলল, ‘জি?’

‘কবিতার বই। ভোরের রোদ চরিয়ে কবর আবাদ?’

বিস্মিত হলো সুলতান সুলেমান, ‘আপনি জানেন? কে বলল?’

‘পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখসিলাম।’

‘অ। প্রকাশিত হয় নাই। আর্টিস্ট প্রচ্ছদ দিতে দেরি করতেসে।’

আর্টিস্টদের বেজায় দাপট দেখা যাচ্ছে। সুলতান সুলেমানের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ যে আর্টিস্ট করবেন, তিনি কি কবিতা পড়ে করবেন? নাকি উরাধুরা যা মনে হয়?

শিপন মুস্তাফা সুলতান সুলেমানের মামা। এই প্রথম জানলেন তৈয়ব আল আজাদ। মনাক্কা ভাই উপযাচক হয়ে বললেন, ‘আরে, টাউনের সর্বকালের সেরা সুন্দরী! নোশিন আরা মুক্তা! মনসুর উকিল তারে বিয়া করসে না? মুক্তা তো শিপন মুস্তাফার বইন।’

সাদউল্লাহ ক্লিনিকের গেইটে চা পান সিগারেট ডাবের দোকান আছে। পদ্ম বলল, ‘চা খাই আব্বা?’

ঝোলাগুড়ের চা বানায় একটা দোকানে। পদ্ম খোঁজপাতি নিয়ে বসল। চমৎকার চা। চুমুক দিয়ে তৈয়ব আল আজাদ ভাবলেন, শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে একদিন এই চায়ের দোকানে নিয়ে আসতে হবে। পদ্ম বলল, ‘আব্বা।’

‘হ্যাঁ?’

‘ভাই সিগারেট টানে জানেন তো আব্বা?’

‘জানি।’

‘টেসাও আব্বা।’

‘জানি।’

‘আপনি রাগ হন নাই?’

‘না। রাগ হবো কেন?’

‘আমার রাগ হইসে আব্বা। আমি আপনার মতো হই নাই। ভাইও আপনার মতো হয় নাই।’

‘পৃথিবীর কেউই কারো মতো হয় না।’

‘আব্বা।’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি যদি সিগারেট টানি আপনি কি রাগ হবেন, বলেন? মন থেকে বলেন।’

‘না।’

‘পৃথিবীতে আপনার মতো আর কেউ নাই আব্বা।’

সহজ কথা। বুক ভিজে গেল তৈয়ব আল আজাদের।

মেয়ে কি সিগারেট ধরেছে? না। তৈয়ব আল আজাদের দাদি সিরাজবানু ফরসি হুক্কা টানতেন। সেই হুক্কা এখনো তাঁদের গোলোকপুরের বাড়িতে সংরক্ষিত আছে।

আরো এক কাপ করে ঝোলাগুড়ের চা খেয়ে তাঁরা উঠলেন।

 

তেরো

‘বৃষ্টি হচ্ছে আর কি হবে না

হবে তবে এই বাস্তবে না।’

শিপন মুস্তাফার অণুকবিতা। ফেসবুকে দিয়েছে। পড়ে লাইক দিলেন তৈয়ব আল আজাদ। অণুকবিতা খুব লেখা হচ্ছে ইদানীং। ফেসবুকে কবিরা লিখছে। দেশের প্রবীণ কয়েকজন কবি ফেসবুকে তাসের ঘর দিয়ে বসে আছেন। তাঁরাও লিখছেন। উত্কৃষ্ট কবিতা, নিকৃষ্ট কবিতা। মনে রাখার মতো কবিতা একটা দীর্ঘকাল ধরে আর লেখা হচ্ছে না। মনে রাখার মতো ভালো কবিতা।

আনতারা চা আর নিমকপড়া দিয়ে গেছে।

শশাঙ্ক চক্রবর্তী বিরক্ত হলেন, ‘কী করো তুমি তৈয়ব?’

‘এই তো আর এক মিনিট।’

‘এক মিনিট! তুমি এক মিনিট আমার কথা শোনো।’

‘কী?’

‘আমি কখন আসছি বলো তো?’

‘তুমি? পাঁচ-সাত মিনিট।’

‘পাঁচ-সাত মিনিট! উনপঞ্চাশ মিনিট হয়ে গেসে!’

‘উনপঞ্চাশ মিনিট! কী বলো?’

‘আমি কি মনোক্তি বলতেসি? ছয়টা দুই মিনিটে আমি আসছি। এখন বাজে ছয়টা একান্ন মিনিট। ‘আর এক মিনিট’ কথাটা তুমি দশবারের বেশি বলসো। দশবার পর্যন্ত হিসাব রাখসিলাম, পরে আর হিসাব রাখি নাই। এই যে তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেসে। নিমকপড়ার প্লেটে দুইটা পিঁপড়া উঠসে দেখো। আচ্ছা, আমি তো ফেসবুক করি না, আমি কি বেঁচে আছি না?’

‘এইটা বাঁচা না-বাঁচার ব্যাপার তো না।’

‘অবশ্যই বাঁচা না-বাঁচার ব্যাপার। দুঃখের কথা হলো, তুমিও এই ব্যাপারের নর্দমায় ডুব দিয়া থাকতে পছন্দ করতেসো।’

‘আরে, সে রকম কিছু না। দেখি আর কি। কে কী লিখল, কে কী বলল।’

‘দেখা খুব দরকার?’

‘যারা লেখে তাদের জন্য দরকার বুঝসো। সমকালীন সাহিত্যের ধারা সম্পর্কে না জেনে লেখার উপায় নাই।’

‘সমকালীন সাহিত্যের ধারা ফেসবুকে বহমান?’

‘বিরাট অংশ। অস্বীকার করা যাবে না।’

‘অ। আই টু ডাই ইউ টু লিভ বাট অনলি গড নোজ হুইচ ইজ বেটার?’

‘হা হা হা!’

তৈয়ব আল আজাদের মোবাইল ফোন বাজল।

পদ্ম কলিং।

তৈয়ব আল আজাদ ধরলেন, ‘হ্যাঁ?’

‘আসসালামআলিকুম আব্বা।’

‘ওয়ালিকুমসালাম। কী বিষয়?’

‘বিষয় কিছু না আব্বা। আপনারে সালাম দিলাম। আম্মার কাছে টাকা-পয়সা নাই। আপনি কি তারে কিছু দান খয়রাত করবেন? মানে আমার কয়টা টাকা দরকার আব্বা। এই ধরেন আট-নয় শ। মানে এক হাজার টাকা ধরেন। আম্মা দিয়া দিলে আর আপনেরে বলতাম না। এই অবস্থায় আম্মারে কয়টা টাকা দিয়া দিলে লাভ কিন্তু আপনারই আব্বা। বলেন?’

হেসে ফেললেন তৈয়ব আল আজাদ। এই বেঁচে থাকা বড়ো সুন্দর। রুবির মতো স্ত্রী, পদ্মর মতো কন্যা, শশাঙ্ক চক্রবর্তীর মতো বন্ধু যখন থাকে নিকটে। কাল তুমুল হাওয়ার রাত ছিল। আজ সকালে অল্প বৃষ্টি হয়েছে। দুপুরে হয়েছে। আকাশের নীল রং দেখা গেছে বিকেলে। আশ্চর্য গোধূলি হয়েছে সন্ধ্যায়। তৈয়ব আল আজাদ কিছুক্ষণ নদীর পারে ছিলেন। আংশিক গোধূলি দেখেছেন।

পদ্ম আবার কল দিল।

‘আসসালামআলিকুম আব্বা।’

‘ওয়ালিকুমসালাম।’

‘আপনি আম্মারে কিছু বলবেন আব্বা? বলেন।’

‘কী বলবো?’

‘কী বলবেন মানে? ও মোর আল্লাহ! বলেন পদ্মর আম্মা, আমি তোমারে দুই হাজার টাকা দিতেসি। এক হাজার টাকা পদ্মরে দিয়ো। নেন! বলেন!...আম্মা, আপনি এই রকম করতেসেন কেন? আরে! ফোন ধরেন! ধরেন!’

রুবি ফোন নিয়ে বললেন, ‘হুঁ?’

তৈয়ব আল আজাদ বললেন, ‘তিন হাজার টাকা আছে ড্রয়ারে। এক হাজার টাকা মেয়েরে দিয়ো।’

‘কী?’

‘চা দিতে পারবা? তোমার দাদার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেসে। নিমকপড়াও দিয়ো। পিঁপড়া উঠসে তোমার দাদার নিমকপড়ার প্লেইটে।’

‘আরে! আরে!’ শশাঙ্ক চক্রবর্তী বৃথা তড়পালেন।

 

চৌদ্দ

মড়ক লেগেছে তাদের ইয়ারে। বিগত দুই-তিন বছরে আবু জাহিদ খান মারা গেছেন, কুমুদ রায় মারা গেছেন, এহিয়া মির্জা চৌধুরী মারা গেছেন, ন্যাথানিয়েল দাশ মারা গেছেন। আজ মারা গেছেন নিকুঞ্জ বাউল। মাইকিং করেছে সকালে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যাপারে কিছু বলে নাই। নিকুঞ্জ বাউলের শবদেহ কি টাউনের শ্মশানে পোড়াবে, না ধারার গাঁও নিয়ে যাবে? ধারার গাঁওয়ের সন্তান নিকুঞ্জ বাউল। টাউনের বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। আজাদী স্পোর্টিং ক্লাবের সেন্টার ফরোয়ার্ড, পরে কোচ হয়েছিলেন। জেলা ক্রীড়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বহুদিন। প্রচুর মানুষ হবে শ্মশানে। তৈয়ব আল আজাদ মনে করলেন যাবেন। কিন্তু শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন, ‘তারে তো পুড়াবে না।’

‘পুড়াবে না মানে?’

‘বসায়ে সমাধি দেবে।’

তৈয়ব আল আজাদ এটা জানতেন না। শশাঙ্ক চক্রবর্তী আরো তাজ্জবের কথা বললেন—নিকুঞ্জ বাউল হিন্দু মানে সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন না নাকি।

‘কী বলো। তারে পূজা-পার্বণে দেখসি। দুর্গাপূজায় আরতি দিত।’

‘পূজা-পার্বণ তাদের ধর্মেও আছে।’

সেই ধর্ম হলো বাউল ধর্ম। লালন সাঁই, মহিম সাঁইদের মতো বাউল ফকির না এরা, এই বাউল ধর্ম আলাদা ধর্ম।

বাষট্টি বছর বয়সে একটা নতুন ধর্মের কথা শুনলেন। আপ্লুত হলেন তৈয়ব আল আজাদ। জেলা ক্রীড়া পরিষদের বর্তমান অর্থ সম্পাদক বিজন সেনকে কল দিলেন। বিজন সেন কল ধরে বলল, ‘দাদা পাবলিক ফিগার ছিলেন। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর শবদেহ আমরা এক ঘণ্টা বিডি হলে রাখব, কবি। দুপুর বারোটা থেকে একটা।’

‘তাঁর সমাধি কি শ্মশানে হবে বিজন?’

‘না কবি। ধারার গাঁওতে।’

বিডি হলে গেলেন তৈয়ব আল আজাদ, শশাঙ্ক চক্রবর্তী। শবদেহ দেখলেন নিকুঞ্জ বাউলের। বন্ধু সেই অর্থে ছিলেন না হয়তো, কিন্তু তাঁরা একসঙ্গে পড়েছেন। নিকুঞ্জ বাউল পত্রিকায় তৈয়ব আল আজাদের কবিতা দেখলে পড়তেন। ষাঁড়ের গুঁতোয় আহত শশাঙ্ক চক্রবর্তীকে দেখতে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিডি হলে সোহেল হাবিব, কাউন্সিলর সহিদুল, মাসুদ করিম, জুলহাস আহমদ খান পাঠান, সত্যশিব দাস, আবু মিসিরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলো। সোহেল হাবিবের ডায়াবেটিস, মাসুদ করিমের হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে, রিং পরাবেন, আবু মিসিরের সম্প্রতি পত্নীবিয়োগ হয়েছে, জুলহাস আহমদ খান পাঠানের রোগ কী ডাক্তাররা নির্ণয় করতে পারছেন না—পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিচ্ছেন। সত্যশিব দাসের গরু কালিন্দী বিইয়েছে, কালিন্দী কালো, বাছুর ধবধবে সাদা হয়েছে, সত্যশিব দাশের পত্নী ইন্দুবালা বাছুরের নাম রেখেছেন কানাই। শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন, ‘বাছুরের জেন্ডার?’

সত্যশিব দাস খেপলেন, ‘তুমি শশাঙ্ক সব সময় এই রকম! মানুষের ভালো দেখতে পারো না। বাছুরের নাম কানাই। পুজো-পাঠ না করলেও তুমি বামুন, কানাই নাম ছেলে না মেয়ের হয় তুমি জানো না? এই বয়সেও তোমার কাণ্ডজ্ঞান হয় নাই!’

শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন, ‘কানাই পিসির কথা তোমার মনে নাই সত্যশিব? সুনির্মলের কানাই পিসি তোমাদের বাসায় ছুটা কাজ করত।’

‘কানাই পিসির প্রকৃত নাম কানাইবালা শশাঙ্ক। কানাইবালা দাসী।’

‘তবে? তোমার বাছুরের নাম বউদি কানাইবালা রাখতেই পারেন। সংক্ষেপে কানাই।’

‘খবরদার শশাঙ্ক! আমার বাছুরের নাম নিয়া তুমি আর একটা কথাও বলবা না। আমার বাছুর আমার সন্তান। কেউ সেই সন্তানের অপমান করলে আমি তার শেষ দেখে ছাড়ব বলে দিলাম।’

জুলহাস আহমদ খান পাঠান এই পর্যায়ে মধ্যস্থতা করলেন। ঝগড়া মিটিয়ে দিলেন দুই বুড়ার। যদিও এঁরা বুড়া হন নাই। ক্লাস এইটের টিফিন পিরিয়ড কি স্কুলের টেবিল টেনিস রুমে বসে আছেন এখনো। সত্যশিব দাস টেবিল টেনিসে ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।

অচেনা একজন মানুষ সালাম দিলেন তৈয়ব আল আজাদকে।

‘আসসালামআলিকুম।’

‘ওয়ালিকুমসালাম।’

‘কিরে আমারে চিনতে পারো নাই?’

‘আরে! হেনিবল!’

তৈয়ব আল আজাদ আলিঙ্গন করলেন ইউসুফ হাসান হেনিবলকে। কত বছর পর দেখা? ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ? কিছু কম-বেশি হতে পারে। হেনিবলের আব্বার বদলির চাকরি। জুবিলি স্কুলে হেনিবল দুই বছর পড়েছিলেন। মেধাবী ছাত্র এবং বিতার্কিক। আবদুর রউফ ‘বিতর্ক’ স্যারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন।

বিরাট ব্যবসায়ী সেই হেনিবল এখন। তিনটা শিল্প-কারখানার মালিক। জুবিলি স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র পারভেজের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ আছে তাঁর। মালদ্বীপে রিসোর্ট করেছেন, পারভেজ তার পার্টনার মিরিয়ামকে নিয়ে সেই রিসোর্টে ছিল দুই মাস। মিরিয়াম রিসোর্টে বসে কবিতা লিখেছে। পারভেজ মারামারি করেছে। লোকাল গুণ্ডাদের সঙ্গে বিরাট মারপিট বাধিয়ে দিয়েছিল। কেলেঙ্কারি কাণ্ড।

আরেকজনের খবর দিলেন হেনিবেল। এসডিপিওর বোন সুরাইয়া মম। সেইকালীন টাউনের হার্টথব। না জেনে স্কুল-কলেজ গোয়িং কত ছেলের হৃদয় যে বিদীর্ণ করেছেন! সেই সুরাইয়া মম বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। চার বাচ্চার মা। মটকু হয়েছেন। তাঁর এক মেয়ে ইংলিশ গান গায়।

ডায়াবেটিস ধরেছে হেনিবেলকে। ব্লাড প্রেসার হাই। নানা নিয়ম মেনে চলতে হয়। জুবিলি স্কুলের বন্ধুদের দেখতে এক বেলার জন্য উপস্থিত হয়েছেন টাউনে। নিকুঞ্জ বাউলের মৃত্যু উপলক্ষে প্রায় সকলের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল।

‘নিকুঞ্জর আত্মীয়-স্বজন কেউরে দেখলাম না।’

ফিরতি পথে তৈয়ব আল আজাদ বললেন।

‘শম্ভুরে দেখসি।’ শশাঙ্ক চক্রবর্তী বললেন।

‘অ।’

শম্ভু নিকুঞ্জ বাউলের ভাতিজা। নিকুঞ্জ বাউলের সন্তান-সন্ততি নাই। দিনে ফুটবল, রাতে মদ করে জীবন পার করে চলে গেলেন মানুষটা।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ