একাধিক বিশেষজ্ঞ সংস্থার রিপোর্টেও এই আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে, যার জেরে ভয় গ্রাস করছে লগ্নিকারীদের মধ্যে। ক্ষতি থেকে বাঁচতে বাজার থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। এর জেরেই জটিল হচ্ছে আমেরিকার আর্থিক পরিস্থিতি।
ট্রাম্প গত বুধবার বিশ্বজুড়ে সব দেশের পণ্য আমদানিতে গড়ে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ ৬০টি দেশের ওপর উচ্চমাত্রায় শুল্ক আরোপ করেন। এর পরই ধস নামে মার্কিন পুঁজিবাজারে। ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্সের হিসাব অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুই দিনে ৫০০ সম্পদশালী হারিয়েছেন ৫৩৬ বিলিয়ন ডলার। শুধু শুক্রবারেই হারিয়েছেন ৩২৯ বিলিয়ন ডলার। কভিড-১৯ মহামারির পর এত বড় পতন আর হয়নি। ব্লুমবার্গের সম্পদ সূচক অনুসারে, প্রায় ৯০ শতাংশ ধনী ব্যবসায়ীর ভাগ্যের পতন ঘটেছে এই দুই দিনে। গড়ে তাঁদের ৩.৫ শতাংশ সম্পদ হ্রাস পেয়েছে।
সবচেয়ে বেশি সম্পদ হারিয়েছেন মার্কিন ধনকুবেররা। শুধু শুক্রবারেই ইলন মাস্কের টেসলার শেয়ারের দাম কমেছে ১০ শতাংশের বেশি। এতে মাস্কের নেট সম্পদ কমেছে ৩১ বিলিয়ন ডলার। এই বছরে ইলন মাস্কের সম্পদ কমেছে ১৩০ বিলিয়ন ডলার। পণ্য সরবরাহে বিলম্ব ও ট্রাম্প প্রশাসনে মাস্কের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুঁজিবাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা কম্পানি টেসলার শেয়ারের দাম আগে থেকেই হ্রাস পাচ্ছিল। ইলন মাস্ক থেকে পিছিয়ে নেই মেটাপ্রধান মার্ক জাকারবার্গও। দুই দিনে তাঁর কম্পানির শেয়ারের দর পড়েছে ১৪ শতাংশ। আর তাঁর সম্পদমূল্য কমেছে ২৭ বিলিয়ন ডলার।
ব্যবহৃত গাড়ি বিক্রির কম্পানি কারভানার সিইও আর্নেস্ট গার্সিয়া দুই দিনে হারিয়েছেন দুই বিলিয়ন ডলার। এদিন কম্পানিটির শেয়ারের দাম ২৮ শতাংশ কমে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যে অল্প কয়েকজন ধনকুবের ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের প্রভাব থেকে তাৎক্ষণিক রক্ষা পেয়েছিলেন, তাঁদের একজন কার্লোস স্লিম। তিনি মেক্সিকোর শীর্ষ ধনী। গত বুধবার ট্রাম্প বেশ কয়েকটি দেশের ওপর নতুন করে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন, তালিকায় নেই মেক্সিকোর নাম। ট্রাম্পের সেদিনের শুল্কের খাঁড়া থেকে বেঁচে যাওয়ার পর গত শুক্রবার তাঁর কম্পানির শেয়ারদর কমে প্রায় ৫ শতাংশ এবং তিনি হারান ৫.৫ বিলিয়ন ডলার।
মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস : ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। কমবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের অবসানের শুরু হলো বলা যায়। এখন তারা পারস্পরিক দর-কষাকষির যুগে চলে যাবে; বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার ধার আর বিশেষ ধারবে না।
দুর্যোগের মেঘ দেখছে মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান। ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার তিন দিনের মধ্যে মন্দার পূর্বাভাস দিল তারা। চলতি বছরেই আমেরিকান অর্থনীতি মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বলে তাদের অনুমান। কম্পানির প্রধান অর্থনীতিবিদ মাইকেল ফেরোলি বলেছেন, ‘চলতি বছরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) সংকুচিত হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা হলে তার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতেও পড়বে। সারা বিশ্বে মন্দার আশঙ্কা ৬০ শতাংশ, জানিয়েছে জেপি মরগ্যান। এর আগে তাদের পূর্বাভাস ছিল, মন্দার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে এ প্রসঙ্গে ফেরোলি বলেন, ‘শুল্কের চাপে আমাদের জিডিপি সংকুচিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। গত বছর জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ১.৩ শতাংশ। চলতি বছরে আমরা ০.৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করছি না।’ বেকারত্ব বৃদ্ধির পূর্বাভাসও দিয়েছেন ফেরোলি। তাঁর আশঙ্কা, চলতি বছরে আমেরিকার অর্থনীতি মন্দার মুখোমুখি হলে বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশে উঠে যেতে পারে।
এদিকে ২ এপ্রিল নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার আগেই গোল্ডম্যান স্যাকস পূর্বাভাস দেয়। তারাও মন্দার আশঙ্কা ২০ থেকে ৩৫ শতাংশে উন্নীত করে এবং তারা বলে, অর্থনীতির মৌল ভিত্তিগুলো আগের বছরের মতো অতটা শক্তিশালী নয়।
বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি জানিয়েছে, মন্দার আশঙ্কা নিয়ে আলাপ-আলোচনা আরো বাড়বে। তারা আরো বলেছে, এখন শেয়ারবাজার, বন্ড ও মুদ্রাবাজারের যে অবস্থা, তাতে মন্দার বাস্তবতা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এইচএসবিসির বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, তাঁরা বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে শেয়ারবাজার পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে তাঁরা বুঝতে পারছেন, বিনিয়োগকারীরা এরই মধ্যে মনে করছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ মন্দা আসার আশঙ্কা প্রায় ৪০ শতাংশ। এই আশঙ্কার কারণেই শেয়ারের বর্তমান দাম এবং বাজারে বিনিয়োগকারীদের কার্যকলাপ কিছুটা প্রভাবিত হচ্ছে; অর্থাৎ মন্দা আসার আশঙ্কা মাথায় রেখেই বাজারে কেনাবেচা চলছে।
এর মানে এই নয় যে মন্দা নিশ্চিতভাবেই আসবে, তার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ; বরং শেয়ারবাজার বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে আছে, তা সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়া অন্যান্য গবেষণা সংস্থা যেমন—বার্কলেস, বোফা প্লোবাল রিসার্চ, ডয়চে ব্যাংক, আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটস ও ইউবিএস গ্লোবাল ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের মতো প্রতিষ্ঠানও সতর্কতা জারি করেছে। তারা বলছে, ট্রাম্পের এই শুল্কনীতি জারি থাকলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ মার্কিন অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, ৯ এপ্রিল থেকে এই বর্ধিত শুল্ক কার্যকর করা হবে। তবে কোনো দেশ যদি এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা করতে চায়, সে পথও খোলা আছে। শুল্ক আরোপের ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি অনেক কমে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের পূর্বাভাস, আমদানি কমতে পারে অন্তত ২০ শতাংশ। সার্বিকভাবে মার্কিন অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। সূত্র : রয়টার্স, হিন্দুস্তান টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল