দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় শিল্পোন্নয়নে জোর দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার, যদিও ২১ জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে স্থাপন করা হয়েছিল পদ্মা সেতু। একই সঙ্গে স্থাপন করা হয় পায়রা বন্দর। এই সেতু ও বন্দরের প্রথম সুফল মিলবে পটুয়াখালী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) উন্নয়নে। দীর্ঘদিনের নানা জটিলতার অবসান ঘটিয়ে এই ইপিজেডের ৪১৩ একর জমি অধিগ্রহণ
করা হয়েছে।
গত বছরের জুলাই মাসে স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে এই ইপিজেডের উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে যায়। অধিগ্রহণ করা জমির মালিকরা মাটি কাটার যন্ত্র সরিয়ে তখন কাজ বন্ধ করেছিলেন। ওই সময়ে তাঁরা ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন।
এসব দেনা-পাওনা পরিশোধ করে এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণ শেষ করেছে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন।
গত ৩০ জানুয়ারি ৬৬৬টি দাগের ৪১৩.০৩ একর জমি ইপিজেড স্থাপনের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এই জমির সব ধরনের দায়দায়িত্ব মুক্ত করে সরকারের ওপর অর্পিত হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন অনুযায়ী এই জমির ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের পচাকোড়ালিয়া গ্রামে স্থাপন করা হচ্ছে পটুয়াখালী ইপিজেড।
আর দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় স্থাপন করা হচ্ছে ইনভেস্টরস ক্লাব। এই ইপিজেডের ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হওয়ায় এখন ত্বরিতগতিতে উন্নয়ন হবে বলে আশা করছে স্থানীয় লোকজন। পাশাপাশি উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর অর্থনীতিতে চমক আসবে।
ইপিজেড কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই ইপিজেডে নির্মিত শিল্প এলাকায় ২০২৬ সালে প্লট বরাদ্দ শুরু করার কথা রয়েছে। পরিকল্পনামতো উন্নয়ন হলে উদ্যোক্তা ও স্থানীয় লোকজনের ভাগ্য পরিবর্তনের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
বর্তমানে ইপিজেডের উন্নয়নকাজ চলছে। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। এক হাজার ৪৪৩ কোটি টাকার প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়নের আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ৪১০.৭৮ একরের এই ইপিজেডের মধ্যে ১৩০ একর জমিতে বালু ভরাট হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় কুয়াকাটায় ২.২৫ একর জমিতে তৈরি হবে বিনিয়োগকারী ক্লাব।

এই প্রকল্প পরিকল্পনার আওতায় সড়ক, ড্রেন নির্মাণের পাশাপাশি চারটি ছয়তলা কারখানা ভবন, তিনটি ১০ তলা, চারটি ছয়তলা আবাসিক ভবন, একটি ছয়তলা ও দুটি চারতলা অফিস ভবন এবং দুটি অন্যান্য ভবন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১৫টি সাবস্টেশন, ১৫ কিলোমিটার ১১ কেভি লাইন এবং একটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম গত জানুয়ারি মাসে প্রকল্প এলাকায় খাল উন্নয়ন ও স্টাফ ডরমেটরি নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করেছেন। এই দরপত্র চলতি মাসেই মূল্যায়ন করে কার্যাদেশ দেওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত অক্টোবরে সড়ক উন্নয়নের পাশাপাশি কালভার্ট নির্মাণের জন্য অষ্টম প্যাকেজের আওতায় দরপত্র দেওয়া হয়।
প্রকল্পের পরিচালক জানিয়েছেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পুরো মাটি ভরাটের কাজ শেষ করা হবে। এখানে ১৫৪টি ফ্যামিলির জন্য বাড়িঘর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ড্রেন, ফুটপাত, কালভার্ট, স্কুলসহ অন্য সব কাজ করে দেওয়া হবে। এই ইপিজেডের উন্নয়ন যথাসময়ে শেষ করে আগামী এক বছরের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের মাঝে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রকল্প এলাকায় সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থাকছে তিন লাখ মিটারের বেশি রাস্তা। প্রায় ৩০ হাজার মিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা। অফিস ও আবাসিক মিলিয়ে ১০টি ভবন থাকছে। এ ছাড়া থাকছে হেলিপ্যাড ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা। দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
বেপজা সূত্রে জানা যায়, আগামী এক বছরের মধ্যে দৃশ্যমান হবে পটুয়াখালীর রপ্তানিমুখী প্রকল্পের এই ইপিজেড। মাটি ভরাটের কাজ শেষ হলে প্লট শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া যাবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে খুলে যাবে উপকূলীয় মানুষের অর্থনীতির চাকা। স্বপ্নের পদ্মার প্রথম অর্থনৈতিক সুফল আসবে নতুন এই ইপিজেড থেকে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পরিকল্পনা করছেন দেশের অবহেলিত এই অঞ্চলের উন্নয়নে সুযোগ তৈরি হবে। তাঁরা সুযোগ পেলে এই ইপিজেডে প্লট নিতে আগ্রহী আছেন। উদ্যোক্তারা দাবি করছেন, ইপিজেডে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানি সুবিধা এবং পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থপনাসহ বিনিয়োগের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সুবিধা দিলে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি রপ্তানিমুখী এই শিল্পাঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।
প্রকল্প সম্পন্ন হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই লাখ কর্মসংস্থানের আশা করছে বেপজা। এ ছাড়া প্রকল্পটিকে ঘিরে আবাসন, বহুমাত্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে স্থানীয় লোকজন। তাদের দাবি, এই শিল্প প্রকল্প উন্নয়ন হলে কর্মসংস্থানে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকল্পে জমিদাতা ১২৬ পরিবারের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে আশ্রয়ণ এলাকা, যেখানে পানি, স্যানিটেশন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ থাকবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা।
প্রসঙ্গত, পটুয়াখালী ইপিজেডে ৩০৬টি শিল্প প্লট করা হবে। বাকি জায়গায় বর্জ্য শোধনাগার, পয়োনিষ্কাশন ও ড্রেনেজ, সড়ক, জলাধার, সবুজায়ন ও আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। প্রকল্প ব্যয় এক হাজার ৪৪৩ কোটি টাকার মধ্যে সরকারের তহবিল থেকে এক হাজার ১০৫ কোটি টাকা আসবে। আর ৩৩৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ
অঞ্চল কর্তৃপক্ষ।