হাজি মহিউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা আহমদ পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ষাটের দশকে যখন আমি বাংলা একাডেমিতে প্রকাশনা ও বিক্রয় বিভাগে কর্মরত।
১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে একাডেমির বেশ কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে সে বইগুলোর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের তাগিদ আসছিল।
তাগিদ আসছিল লেখক ও পাঠক উভয়ের তরফ থেকে। কিন্তু একাডেমিতে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ ছিল না। সরকারের কাছে দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য আর্থিক অনুদান চাইলেও পাওয়া যেত না। এই পরিপ্রেক্ষিতে একাডেমি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল যে নিঃশেষিত প্রথম সংস্করণের বইগুলোর মধ্য থেকে কোনো বই যদি কোনো প্রকাশক দ্বিতীয় সংস্করণ বা পরবর্তী প্রকাশ করতে চান, তাহলে সে বইগুলো সেই প্রকাশককে দিয়ে দেওয়া হবে।
হাজি সাহেব তখন এসেছিলেন দ্বিতীয় সংস্করণের বই প্রকাশনা নিয়ে আলোচনা করতে। সে সূত্রে হাজি সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। বাংলা একাডেমির দ্বিতীয় সংস্করণের বইগুলো কিভাবে প্রকাশ করা যায়, সে প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়। এ সময় মরহুম কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু একাডেমির বাজেটে তার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না। অপরদিকে হাজি সাহেব বিশ্বনবী প্রকাশ করতে দারুণ আগ্রহী। আমরা শর্ত দিলাম হাজি সাহেব যদি বাংলা একাডেমির আরো কিছু বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে আগ্রহী থাকেন, তাহলেই ‘বিশ্বনবী’ একাডেমির পক্ষ থেকে তাঁকে প্রকাশ করতে দেওয়া হবে। হাজি সাহেব সম্মত হলেন। তিনি শুধু বিশ্বনবীর প্রকাশক হলেন তা-ই নয়, একই সঙ্গে তিনি একাডেমির বেশ কয়েকটি বইয়ের দ্বিতীয় ও পরবর্তী সংস্করণের প্রকাশক হলেন। যত দূর মনে পড়ে, এসব বইয়ের মধ্যে একটি ছিল মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, সিরাজউদ্দীন কাসিমপুরীর লোকসাহিত্যে ছড়া ও আরো বেশ কিছু বই।
তিনি যখন একাডেমিতে আসতেন সাধারণত প্রথমেই আসতেন প্রকাশনা বিভাগে। তারপর পরিচালকের ঘরে যেতেন। তিনি প্রায়ই একাডেমিতে আসতেন কখনো কাজে অথবা নিছক গল্প করতে বা আড্ডা দিতে। তখন একাডেমিতে সব সাহিত্যিক ও সাহিত্যামোদীর আগমন ঘটত, আড্ডা হতো। এসব আড্ডায় আসতেন আবদুল গনি হাজারী, সানাউল হক, সিকান্দার আবু জাফর, ফর্রুখ আহমদ, কবি আবদুল কাদির, সুফি জুলফিকার হায়দার, প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ, গোলাম রহমান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, এককথায় এ দেশের সব কবি-সাহিত্যিক। তাঁদের অনেকেই আজ আর ইহজগতে নেই। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক আবু যোহা নূর মোহাম্মদ। আবু যোহা ছিলেন হাজি সাহেবের বাঁধা লেখক।
বাঁধা লেখক বলছি এ কারণে যে তিনি আহমদ পাবলিশিং হাউসের বহু বইয়ের লেখক ছিলেন। একটি বিষয়ে হাজি সাহেবের সুনাম ছিল। তিনি কোনো লেখককে তাঁর প্রাপ্য রয়্যালটি বা পারিশ্রমিক দেননি এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
ঢাকায় যখন তিনি প্রথম প্রকাশনা আরম্ভ করেন তখনই তিনি শিশুসাহিত্য প্রকাশের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শৈশবেই যদি শিশুরা মহৎ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসতে পারে অথবা মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করে, তবে তারাও মহৎ ব্যক্তিদের জীবন অনুসরণ করে বড় হয়ে উঠবে। তাহলেই তারা সঠিকভাবে মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। সে কারণে তিনি প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন মহৎ জীবনী গ্রন্থমালা। মাত্র আট আনা অর্থাৎ আজ যাকে আমরা পঞ্চাশ পয়সা বলি সে মূল্যের এক একটি বই। এই সিরিজের বেশির ভাগ বই লিখতেন আবু যোহা নূর মোহাম্মদ। বইগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
প্রকাশনা নিয়ে হাজি সাহেব যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যে সংগ্রাম করেছেন এবং যে ভিত্তির ওপর তাঁর সংস্থাকে দাঁড় করিয়েছেন সেগুলোকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করি, তাহলে বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে পারব। এবং সেটাই হবে বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাস।