<p>একজন অপরাধীকে কারাগারে বন্দি রাখা হবে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়; বরং তাকে সঠিক পথ বলে দিয়ে গন্তব্য দেখানোর জন্য। তার জীবন যে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে সে অন্ধকার দূরীভূত করি আলোর রশ্মি জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। যারা বন্দিদের তত্ত্বাবধানে থাকবে তাদের আচরণ-উচ্চারণ, চলাফেরা সব কিছু দেখেই মুগ্ধ হয়ে সে আলোর পথে ছুটে আসবে। কিন্তু যদি বন্দিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়, তাহলে তো সে বন্দি অন্ধকারের দিকে আরো বেশি করে ছুটবে।</p> <p>বন্দিদের সঙ্গে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর আচরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত; সুমামা ইবনে উসালের ঘটনা। তিনি ছিলেন বনু হানিফা গোত্রের এক নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি। সে রাসুলকে হত্যা করার জন্য মদিনায় এসেছিল। আর রাসুল (সা.) তার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন, তার কিছু নমুনা এই হাদিসে এসেছে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কিছুসংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্যকে ‘নাজদ’-এর দিকে পাঠান। অতঃপর বনু হানিফা গোত্রের এক ব্যক্তিকে তারা ধরে নিয়ে এলো। তার নাম ছিল সুমামাহ ইবনে উসাল। তিনি ইয়ামামাবাসীর সরদার ছিলেন। তারা মসজিদের একটি খুঁটির সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখল। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কাছে এলেন এবং বলেন, হে সুমামাহ, তোমার কাছে কেমন মনে হচ্ছে? সে জবাব দিল, আমার কাছে তো ভালোই মনে হচ্ছে। আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন, তাহলে খুনি ব্যক্তিকেই হত্যা করলেন। আর যদি আপনি অনুগ্রহ করেন, তবে আপনার অনুগ্রহ হবে কৃতজ্ঞ ব্যক্তির ওপর। আর যদি আপনি সম্পদ চান, তবে আপনাকে তাই দেওয়া হবে, আপনি যা চাইবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে যথাবস্থায় রেখে দিলেন। [এভাবে রাসুল (সা.) তিন দিন তার সঙ্গে কথা বলেন, এরপর]।</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা সুমামাহকে ছেড়ে দাও। তারপর সুমামাহ মসজিদের নিকটবর্তী একটি খেজুরগাছের নিকট গেলেন। সেখানে তিনি গোসল করলেন। এরপর মসজিদে প্রবেশ করে বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসুল। হে মুহাম্মদ, আল্লাহর শপথ! পৃথিবীতে আমার কাছে আপনার চেহারার চেয়ে খারাপ চেহারা আর ছিল না। আর এখন সব মানুষের চেহারা থেকে আপনার চেহারাই আমার বেশি প্রিয়। আল্লাহর শপথ! আপনার ধর্ম থেকে বেশি খারাপ ধর্ম আমার কাছে আর ছিল না। আর এখন আপনার ধর্মই আমার কাছে সব ধর্ম থেকে অধিক প্রিয়। আল্লাহর কসম! আপনার জনপদ থেকে বেশি নিকৃষ্ট জনপদ আমার কাছে আর ছিল না। আর এখন আপনার জনপদই আমার কাছে সব জনপদের চেয়ে বেশি প্রিয়। আপনার অশ্বারোহী সৈনিকরা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। অথচ আমি তখন ওমরা করার ইচ্ছা করেছিলাম। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে সুসংবাদ দিলেন এবং ওমরাহ করার নির্দেশ দিলেন। এরপর যখন তিনি মক্কায় ফিরে এলেন, তখন এক ব্যক্তি তাঁকে বলল, তুমি কি ধর্মান্তরিত হয়েছ? তখন তিনি বললেন, না; বরং আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছি। আল্লাহর কসম! ইয়ামামা থেকে একটি গমের দানাও তোমাদের কাছে পৌঁছাবে না। যতক্ষণ না রাসুলুল্লাহ (সা.) তাতে সম্মতি দেন। (মুসলিম, হাদিস : ৪৪৮১)</p> <p><strong>বন্দিদের সঙ্গে কোমল আচরণ</strong></p> <p>বন্দিদের সঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) কোমল আচরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। নবীজি (সা.) যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যেই সদয় আচরণের আদেশ দিয়েছেন তা শুধু মুখে বলে সীমাবদ্ধ করেননি, বরং বাস্তবে প্রয়োগ করে তিনি দেখিয়েছেন। তাদের সঙ্গে এমন সুন্দর আচরণ করতেন, যাতে তারা নিজেদের নবীজির কাছে নিরাপদ ও সুরক্ষিত মনে করতে বাধ্য হয়। বিশেষত, তাদের খাবারদাবার ইত্যাদি বিষয়ে সাহাবাদের সতর্ক করেছেন। হাদিসে এসেছে রাসুল (সা.) বলেছেন, যুদ্ধবন্দিদের প্রতি কল্যাণের ও সদাচরণের অঙ্গীকার গ্রহণ করো। (আল-মুজামুল কাবির : ৯৭৭)</p> <p>ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সাহাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা বন্দিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো। ফলে সাহাবারা খানার সময় তাদের নিজেদের থেকে প্রাধান্য দিতেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/৫৮৪)</p> <p><strong>নারী ও শিশুদের সঙ্গে যেমন আচরণ করতেন</strong></p> <p>নারী ও শিশু বন্দিদের ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাদের মানসিক বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা বজায় রাখতেন। এ জন্য তিনি শিশুসন্তান ও মায়ের মাঝে আলাদা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আবু আইয়ুব (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, (বন্দিনী) মা ও তার সন্তানকে একে অন্য থেকে যে ব্যক্তি আলাদা করল, আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে তার এবং তার প্রিয়জনদের পরস্পর থেকে আলাদা করবেন। এ হাদিস অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিশেষজ্ঞ সাহাবি ও তৎপরবর্তীরা আমল করেছেন। বন্দিনী মা-সন্তান, পিতা-পুত্র এবং ভাইদের পরস্পর থেকে আলাদা করাকে তারা নিষিদ্ধ বলেছেন। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৫৬৬)</p>