<p>পৃথিবীর প্রভাবশালী ভাষাগুলোর মধ্যে আরবি অন্যতম। আরবি ভাষার অতীত ইতিহাস খুবই চমকপ্রদ। কারণ মহান আল্লাহ কোরআনুল কারিমের জন্য আরবি ভাষা নির্বাচন করেছেন। আর কোরআনুল কারিম আল্লাহর কালাম, যা অনন্তকাল থেকে লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বরং এটা অতি সম্মানিত কোরআন, যা লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ।’ (সুরা : বুরুজ, আয়াত : ২১-২২)</p> <p>বোঝা যায়, আরবি ভাষাও অনন্তকাল থেকে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া আরবি জান্নাতের ভাষা হওয়ার কারণে আদম (আ.) জান্নাতে থাকাকালে স্বভাবতই আরবিতে কথাবার্তা বলেছেন। কাজেই সন্দেহাতীতভাবে আরবি অনন্তকালের ভাষা, প্রথম ভাষা এবং পৃথিবীর সৃষ্টির আগে থেকে চলে আসা ভাষা। তবে পৃথিবীতে প্রচলিত আরবি ভাষার ইতিহাস বর্ণনায় ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে আরবি ভাষা সেমিটিক ভাষার পরিবর্তিতরূপ। কারণ সেমিটিক ভাষাগুলোর মধ্যে আরবি মূল সেমিটিক ভাষার সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং আরবিই মূল সেমিটিক ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো বেশির ভাগ সংরক্ষণ করে।</p> <p>সেমিটিক ভাষাবংশ : পৃথিবীর সব ভাষাকে ভাষাতাত্ত্বিক কয়েকটি মূল ভাষাপরিবারে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। যাকে ভাষাপরিবার বা ভাষাবংশ বলে। সবচেয়ে বিস্তৃত ভাষাপরিবার হলো ইন্দো-ইউরোপীয়  (Indo-European) , এরপর গুরুত্বপূর্ণ ভাষাপরিবার হলো—সেমিটিক-হেমিটিক। সম্প্রতি গ্রিনবার্গ এই ভাষাপরিবারের নাম দিয়েছে ‘আফ্রো-এশীয়। অতীতে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল থেকে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত এই ভাষাপরিবারের বিস্তার ছিল। এই ভাষাপরিবার এখনো এসব এলাকায় প্রচলিত থাকলেও এ পরিবারের কিছু ভাষা লোপ পেয়েছে। যেমন—একসময়ের আক্কাদীয় ভাষা আর ব্যবহার হয় না।</p> <p>এর স্থান দখল করেছে আরবি। সেমিটিক-হেমিটিক ভাষাপরিবারকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। হেমিটিক শাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা মিসরীয়। আর সেমিটিক শাখাটি দুটি ভাগে বিভক্ত—এক. পূর্ব সেমিটীয়, যার একমাত্র ভাষা আক্কাদীয়। দুই. পশ্চিম সেমিটীয়, যার উত্তর-পশ্চিম উপশাখার উল্লেখযোগ্য ভাষা ফিনিশীয় এবং দক্ষিণ-পশ্চিম উপশাখার উল্লেখযোগ্য ভাষা আরবি ও ইথিয়পীয়। (আরবি ভাষাতত্ত্ব, ঢাকা : সালেহা প্রকাশনী, ২০২৩ খ্রি., পৃ.-৪৫-৪৭)</p> <p>সেমেটিক ভাষাভাষীর পরিচয় : বনু সাম বা সেমাইট হলো নুহ (আ.)-এর পুত্র সামের বংশধর। সৈয়দ সুলাইমান নদভির মতে, সামী বা সেমেটিক জাতি হলো—সামি বা সেমিটিক ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠী। আয়লাম ও লুদ সামের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও সামী ভাষাভাষী না হওয়ায় তারা সামী জাতিতে শামিল নয়। অন্যদিকে ফিনিশীয়রা সাম বংশোদ্ভূত নয়, কিন্তু সামী ভাষায় কথা বলার কারণে সামী জাতির অন্তর্ভুক্ত। আবিসিনিয়ার অধিবাসীরাও সামী ভাষাভাষী হিসেবে সামী জাতির মধ্যে গণ্য। (তারিখে আরদুল কোরআন, ১ম খণ্ড, আযমগড় : দারুল মুসান্নিফিন শিবলি একাডেমি, ১৯৫৫ খ্রি., পৃ.-১০৫)</p> <p>কোরআনের প্রভাবে আরবি ভাষা রক্ষিত : ভাষা সর্বদা বিবর্তন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে অগ্রসর হয়। কোনো ভাষাই বেশি দিন এক অবস্থানে বর্তমান থাকে না, বিশেষ করে যে অঞ্চলের অধিবাসীরা তাদের বাসভূমির সীমানাকে বিজয়ের মাধ্যমে অথবা উপনিবেশ স্থাপন করে বিস্তৃত করে তাদের ভাষা দ্রুতগতিতে পরিবর্তন হয়। কারণ তারা অন্যান্য জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ভাষার সংস্পর্শে এসে নিজেদের ভাষা-সভ্যতার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে না। ফলে একসময় তাদের মূল ভাষার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং সে স্থলে নতুন ভাষা জন্ম  নেয়।</p> <p>তবে মূল আরবি ভাষা ইসলাম আগমনের পর থেকে পবিত্র কোরআনের প্রভাবে রক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। উইলিয়াম রাইট মন্তব্য করেছেন—‘বর্তমান কালের আরবি দুই হাজার বছর আগের আরবির এক অতি ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধি, সে তুলনায় ইতালি বা ফরাসি ভাষা লাতিন থেকে অনেক আলাদা এক ভাষা।’ (Comparative Grammar of the Semitice Languages, London: 1923, P. 12.)</p> <p>আরবে প্রচলিত আরবি ভাষা : আরব দেশ উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে বিভক্ত। দক্ষিণের অধিবাসীরা আরিবা অর্থাৎ খাঁটি আরব এবং তাদের আদি পুরুষ কাহতান হিসেবে তারা বানু কাহতান। উত্তর আরবের অধিবাসীরা মুস্তারিবা অর্থাৎ আরবি জাতীয়তা গ্রহণকারী আরব। তারা বানু ইসমাঈল বা ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর। তাদের ‘আদনানি’ও বলা হয়। কারণ ‘আদনান’ তাদের প্রখ্যাত একজন পূর্বপুরুষ। আরব দেশের সব অঞ্চলে একই ধরনের আরবি প্রচলিত ছিল না। ভাষা বিজ্ঞানীরা আঞ্চলিক আরবি ভাষাগুলোকে প্রথমে দক্ষিণ ও উত্তর—এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। দক্ষিণের ভাষায় বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক উপভাষা উদ্ভব হয়েছিল। (তারিখু আদাবিল লুগাতিল ‘আরাবিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, বৈরুত : দারু মাকতাবাতিল হায়াত, ১৯৯২ খ্রি., পৃ.-৪৯)</p> <p>জাহেলি যুগের উত্তর আরবীয় আরবি ভাষাকে কুরাইশি ও তামিমি মোটামুটি এ দুটি উপভাষায় ভাগ করা যায়।</p> <p>আরবিয়্যুম মুবিন : উত্তর আরব, বিশেষত মক্কার ভাষাকে ‘আরবিয়্যুম মুবিন’ বলা হয়েছে। কোরআনের ভাষা আরবিয়্যুম মুবিন। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু কোরআনের ভাষা সুস্পষ্ট আরবি ভাষা।’ (সুরা : নহল, আয়াত : ১০৩) </p> <p>মুবিন অর্থ ব্যাখ্যাকারী, উন্মুক্তকারী, প্রকাশক, সুস্পষ্ট ইত্যাদি। মুবিন এখানে একটি পরিভাষা। সংক্ষেপে মুবিন একটি ভাষার নাম, যে ভাষা কোরআনের ভাষা এবং যে ভাষায় জাহেলি যুগের কবিরা কবিতা রচনা করেছে। উত্তর আরবের কুরাইশ ও বানু সাদের ভাষা সর্বোত্কৃষ্ট। রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরাইশ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন এবং সাদ গোত্রে প্রতিপালিত হন বলে তাঁর ভাষা সুন্দর ও উত্তম ছিল। কুরাইশদের ভাষা ছিল অন্য ভাষাগুলোর তুলনায় উন্নত। মক্কায় সমগ্র আরব থেকে বহু লোক হজ পালন করতে আসত। মক্কার অনতিদূরে উকাজ মেলায় বেচাকেনা ছাড়াও সাহিত্য সম্মেলন হতো। কবি ও বাগ্মীদের সমাগত হতো এ মেলায়। এভাবে ভাষা ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবারই বোধগম্য একটি সাধারণ ভাষা অস্তিত্বে এসেছিল।</p> <p>অন্যদিকে কুরাইশরা ব্যবসার জন্য আরবের বাইরে গমন করে অনারব সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। ফলে তাদের ভাষা ও চিন্তায় ব্যাপকতা ও গভীরতা এসেছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর সারা আরব একটি ভাষার অধীনে চলে আসে। সে ভাষা জাহেলি যুগের কবিদের ভাষা, কুস ইব সাঈদের (মৃত. ৬০০ খ্রি.) উকাজ মেলায় ধর্মীয় বক্তৃতা প্রদানের ভাষা, কিসরা আনওশিরওয়াঁ (মৃত. ৫৭৯ খ্রি.)-এর দরবারে হীরা রাজা নুমান ইবনে মুনজির কর্তৃক প্রেরিত আরব প্রতিনিধিদলের আরবের পক্ষে কথা বলার ভাষা, আরবের বিশিষ্ট বাগ্মী আকসাম ইবন স্বায়ফী, হাজিব ইবন জুরারাহ, হারিস ইবন জালিম প্রমুখ ব্যক্তির ভাষা, প্রাচীন যুগ থেকে অসংখ্য প্রবাদ বাক্য রচিত হওয়ার ভাষা, পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার ভাষা, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষা, সাহাবিদের ভাষা, নানা সন্ধিপত্র ও তৎকালীন রাজা-বাদশাহদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ভাষা এবং  আরব দেশের সীমা অতিক্রম করে তৎকালীন সভ্যজগতের প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ডে সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সরকারি কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হওয়ার ভাষা। সেটিই ক্লাসিক্যাল আরবি ভাষা ‘আরবিয়্যুম মুবিন।’</p>