বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) পরিচালক মুন্সী মুহাম্মদ ওয়াকিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতৃপক্ষের দায়িত্ব প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের সমস্ত ঋণগ্রহীতার তথ্য সংরক্ষিত হয় ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি)। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ।
ঋণ তথ্যের গোয়েন্দা বিভাগও বলা হয় এটিকে। ব্যাংকিং খাতের ঋণ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এই বিভাগ ভূমিকা রাখে। এটি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক এবং নিয়োগের ক্লিয়ারেন্স প্রদান করে। জাতীয় নির্বাচনের সংসদ সদস্য প্রার্থীদের নমিনেশনের ক্লিয়ারেন্সও এই বিভাগ থেকেই দেওয়া হয়। আর এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, অর্থাৎ সিআইবিতে গত ২৩ বছর স্বপদে বহাল রয়েছেন মুন্সী মুহাম্মদ ওয়াকিদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক ব্যক্তি একই বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করলে বিভিন্ন সংকট দেখা দেয়। ওই ব্যক্তির মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাবও তৈরি হতে পারে। আর যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাকে আদালত তলব করেন, তখন এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের দীর্ঘদিনের অনিয়ম, জবাবদিহিতার অভাব এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততার বিরুদ্ধে এক কঠোর সতর্কবার্তা হিসেবেও প্রতিধ্বনিত হয়।
রিট পিটিশনে অভিযোগ করা হয়েছে, মুন্সী মুহাম্মদ ওয়াকিদ গত বছরের ১২ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং ১৪৪০৭/২০২৪-এর আদেশ ইচ্ছাকৃতভাবে অমান্য করেছেন। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছেন। এতে আদালতের প্রতি অবজ্ঞা ও আইনের প্রতি ধৃষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি রিফাত আহমেদ এবিষয়ে রুল জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, কেন ওয়াকিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা হবে না, সে বিষয়ে আগামী ৬ এপ্রিল লিখিত ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তিনি যেন উক্ত তারিখে ব্যক্তিগতভাবে আদালতে হাজিরা দেন।
পিটিশনারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট আবু খালেদ আল মামুন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল খ. বাহার রুমি, নূর মোহাম্মদ আজামী, মো. আব্দুল জব্বার জুয়েল, সুমাইয়া বিনতে আজিজ ও মো. তানভীর প্রধান।
আদালতের নির্দেশ অনুসারে, পিটিশনারকে রেজিস্ট্রার্ড ডাকযোগে এবং প্রচলিত নিয়মে সংশ্লিষ্ট সকল বিবাদীকে নোটিশ পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই আদেশ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে একটি শক্ত বার্তা। যে কোনো সংস্থা বা কর্মকর্তা যদি আইনের ঊর্ধ্বে উঠতে চান, তাহলে তাদেরকেও জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তবে এই পরিস্থিতি এখন শুধু ওয়াকিদের ব্যক্তিগত দায় নয়। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, মুন্সী মুহাম্মদ ওয়াকিদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির অভিযোগ একদিনের নয়। অতীতেও বহুবার তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ এবং দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উঠেছে। একাধিক জাতীয় দৈনিকে এসব বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সিআইবিতে ঋণের তথ্য হালনাগাদের নিয়মে পরিবর্তন আনার নির্দেশ দেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। মুন্সী মুহাম্মদ ওয়াকিদের পরামর্শে ও তৎকালীন গভর্নরের নির্দেশনা অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ঋণের তথ্য সরাসরি সিআইবির ড্যাশবোর্ডে আপলোড করার ক্ষমতা পায়। সেই সুযোগে আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট অনেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে সিআইবি রিপোর্টে পরিবর্তন করে খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়েছেন। এমনকি প্রকৃত ঋণখেলাপি হয়েও সিআইবির রিপোর্ট পরিবর্তন করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালের বিগত সরকারের অধীনে ডামি নির্বাচনকে সামনে রেখে মুন্সী ওয়াকিদকে একটি বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে বর্তমান পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ সিআইবিতে পোস্টিং করান। এসাইনমেন্টটি ছিলো বহির্বিশ্বে যেন ডামি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো যায় সেজন্য বেশি সংখ্যক প্রার্থী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ঋণ খেলাপিদের সিআইবি রিপোর্টে বিশেষ সুবিধা দিয়ে খেলাপী মুক্ত দেখিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। এজন্য পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তাকে এই নতুন দায়িত্ব দিয়ে তৎকালীন সিআইবি পরিচালককে সরিয়ে দেন।
এর আগে, গভর্নর রউফ তালুকদার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারের লঙ্ঘন করে সিআইবি তথ্যের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাত থেকে সরিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে দিয়ে দেন, যেন তারা প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য পরিবর্তন ও সংশোধন করতে পারে।