রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) চেয়ারম্যান কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.) বলেছেন, জাতির সমৃদ্ধি চাইলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করে ভালো মানুষকে নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী না থাকলে এই দেশটাই স্বাধীন হতো না। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.) একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, কোনো ব্যক্তির আঙুলের ইশারায় এই দেশ স্বাধীন হয়নি।
দেশের শত্রুরাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হওয়াটাই স্বাভাবিক। যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত ১১ হাজারের বেশি সদস্যের সংগঠন রাওয়ার চেয়ারম্যান বলেন, সেই সময় সেনা সদস্যরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। অথচ তারা শপথ নিয়েছিলেন পাকিস্তান রক্ষা করার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। পাকিস্তান যদি সফল হতো তাহলে তাদের সবার ফাঁসি হতো। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড হতে পারত। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন। অন্য কেউ জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন না। দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, সেক্রেটারি, পুলিশপ্রধান কেউ জীবন উৎসর্গের শপথ নেন না। সামরিক বাহিনী তাদের জীবন- যৌবন দিয়ে দেশের জন্য কাজ করে থাকে। একাত্তর সালে সেনাবাহিনী না থাকলে দেশটা স্বাধীন হতো না। আবার পঁচাত্তর সালে আর্মি না থাকলে দেশটা ইন্ডিয়ার হাতে চলে যেত। দেশের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে সেই সময় বিদ্রোহ করেছিল সেনাবাহিনী। ’৭৭ সালেও আবার চেষ্টা হয়েছিল। গত বছর ৫ আগস্ট আর্মি যদি ঘুরে না দাঁড়াত, শেখ হাসিনার পদলেহন করত, তাহলে কী অবস্থা হতো? সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যদি সব দলকে নিয়ে বৈঠক করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ না দিতেন। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সহায়তা না করতেন তাহলে আমাদের কী অবস্থা হতো?
তিনি বলেন, আর্মি সবসময় দেশের জন্য, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কাজ করে থাকে। ভারত বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছে না। বাংলাদেশকে তারা গ্রহণ করতে পারছে না। তারা এই দেশকে অস্থিতিশীল রাখতে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দালাল তৈরি করেছে। এই দেশকে তারা দালালদের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়।
সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.) বলেন, রাজনীতি করা প্রতিটি মানুষের অধিকার। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে যে কেউ রাজনীতি করতে পারেন। সেনাবাহিনীর ভালো, দেশপ্রেমিক মানুষরা রাজনীতিতে এলে দেশের উন্নয়ন হবে। তারা পার্লামেন্টে গেলে চুরি করবে না। দেশের জন্য কাজ করবেন। যারা ভালো দেশপ্রেমিক তারা যেন রাজনীতিতে আসে।
বিডিআর হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে তাঁর পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিডিআর হত্যাকান্ড সরাসরি ইন্ডিয়া করিয়েছে সেনাবাহিনীতে দুর্বল করার জন্য এবং শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য। তবে এখানে ভুল আছে। ভুলটা হলো কমান্ড ফেইলিউর। এতবড় ঘটনা ঘটল বিডিআর প্রধান জানলেন না। এটা বড় ব্যর্থতা। জেনারেল শাকিল থেকে শুরু করে সিনিয়র কর্মকর্তারা জানলেন না-এটা বড় ব্যর্থতা। এত বড় একটা ঘটনা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়নি। এটার বীজ অনেক আগে থেকেই বপন করা ছিল। দ্বিতীয়ত, যে অপকর্মগুলো তারা করছিল, হত্যাকান্ড ঘটিয়েয়েছিল, অফিসারদের মারছিল তখন যারা বাইরে আর্মি ছিল, সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ছিল সঙ্গে সঙ্গে তার ফোর্স পাঠিয়ে এই হত্যাকান্ড বন্ধ করে দেওয়া। এটা মাত্র এক ঘণ্টার কাজ। আর্মির যে ফায়ার পাওয়ার আছে তা দিয়ে সহজেই দমন করা যেত। ৩টা গেট দিয়ে ৩টা এপিসি ঢুকিয়ে দিলে তারা কিছুই করতে পারত না। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মইন ইউ আহমেদের মতো অপদার্থ অযোগ্য মানুষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অফিসারদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তিনি তার ভাইদের শঁপে দিয়েছেন শত্রুর হাতে। যারা মানুষ মারছে তাদের জন্য আবার প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে হবে কেন? আপনার ঘরে আগুন লাগছে আপনি আগুন না নিভিয়ে ফায়ার সার্ভিসে ফোন করতে থাকবেন। নিজে চেষ্টা করবেন না? আরেকটা ফেইলিউর হলো, সেই সরকারকে তখন সেনাবাহিনী উৎখাত করে নাই। যেই সরকার সেনাবাহিনীকে হত্যা করতে পারে, তাদের উৎখাত করা দরকার ছিল। জনগণের ফেইলিউর হলো, তারা কেন এই সরকারকে উৎখাত করতে রাস্তায় নেমে আসেনি। তাদের উচিত ছিল রাস্তায় নেমে আসা। কারণ, যেখানে সামরিক বাহিনীতে হত্যা করা হয় সেখানে এই দেশে কারও কোনো নিরাপত্তা নেই। পুরো দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসা উচিত ছিল। তাহলে দেশের এই নির্মম অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
সেনা কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে রাওয়া চেয়ারম্যান কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.) বলেন, তৎকালীন ডিজিএফআই ছিল সরাসরি ফ্যাসিস্ট হাসিনার আন্ডারে। আর্মির হেড কোয়ার্টারের আন্ডারে ছিল না। এনএসআই, র্যাব, এসএসএফ, ডিজিডিপি-এরা ছিল শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে। তাদের নিয়ন্ত্রণ আর্মি হেড কোয়ার্টারের আন্ডারে ছিল না। সব প্রধানমন্ত্রীর পকেটের জিনিস। চুরি সব তারাই করেছে। আর্মি অফিসারদের মধ্যে যারা অন্যায় করেছে তাদের বিচার অবশ্যই হবে। দোষী হলে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তারিক সিদ্দিক হবেন। আসলে সবাই আর্মির কথা বলেন, আসল চুরি তো করেন আমলারা। দেশ বিক্রি করেন পলিটিশিয়ানরা। চুক্তি করেন আমলারা। ড্রাফট করেন আমলারা। বেগম পাড়ায় বাড়ি করেছেন কারা? সেখানে আর্মি অফিসারদের বাড়ি নেই। বাড়ি আছে পলিটিশিয়ানদের, আমলাদের। তাদের ধরতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অবস্থান ও নীতির পরিবর্তন করতে হবে। তাদের দলে যেসব দুর্বৃত্ত, চোর, বাটপার, লুটেরা, হত্যাকারী আছে তাদের বের করে দিয়ে ভালো মানুষদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। যতদিন পর্যন্ত ভালো লোককে নির্বাচিত করতে না পারবে ততদিন আমাদের কোনো শান্তি আসবে না। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা মার্কাকে ভোট দেই। মানুষকে ভোট দেই না। চোর-ডাকাতকে ভোট দেই। মার্কা চিনি, ভালো মানুষ চিনি না। ৫০০ টাকায় ভোট বিক্রি করে দেই। আমাদের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে নারী, বৃদ্ধ ও শিশু বাদ দিলে প্রায় ১০ কোটি ইয়াং-এনার্জিটিক তরুণ রয়েছেন। এই ১০ কোটি মানুষকে জনসম্পদে পরিণত করে তাদের কাজে লাগানো গেলে বাংলাদেশের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। এই ১০ কোটি জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তর করে সরকারিভাবে যদি বিদেশে পাঠাতে পারি, সুপারভাইজারের নিচে পাঠাব না- তাহলে আমাদের অগ্রগতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু হতে পারে না।
তিনি বলেন, মানুষের চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো। চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি এগুলোর সঙ্গে ম্যাক্সিমাম পলিটিক্যাল পার্টিগুলো জড়িত। সেই চরিত্র ঠিক করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। ইসলামী আদর্শ যোগ করতে হবে। তাহলেই এই দেশ হবে বিশ্বের অন্যতম একটি শান্তিপূর্ণ দেশ।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।