ঈদ ঘনিয়ে আসছে। এবার ঈদে টানা ৯ দিনের সরকারি ছুটি। রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি অভিমুখে ছুটবে মানুষ। পথে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামবে।
উভয় ঘাটে ফেরিপার হতে আসা যাত্রীবাহী বিভিন্ন গাড়ির চাপ বাড়বে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
এদিকে নৌরুটসহ ঘাট পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণের কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঘাট সমস্যা, আনফিট লঞ্চ, ভুয়া টিকিট বিক্রি, বেপরোয়া কুলি, উল্টোপথে গাড়ি, ফেরিতে জুয়ার ফাঁদসহ নানা কারণে আসন্ন ঈদযাত্রা ঘিরে জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
ঘাট সমস্যা
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথের দৌলতদিয়া প্রান্তে সাতটি ফেরিঘাটের মধ্যে বর্তমান ৩, ৪ ও ৭ নম্বর ঘাট তিনটি চালু রয়েছে।
অপর চারটি বন্ধ হয়ে আছে। এদিকে পদ্মা নদীতে পানি কমে যাওয়ায় ‘লো-ওয়াটার লেভেলে’ ঘাটপল্টুন স্থাপন করার পর থেকে চালু থাকা ওই তিনটি ঘাটের গুরুত্বপূর্ণ পকেটপথ অনেক ঢালু হয়ে আছে। এতে ফেরি থেকে পন্টুনে নামার পর গাড়িগুলো পকেটপথ দিয়ে সহসা সংযোগ সড়কের ওপরে উঠতে পারছে না।
ঢালু পকেটপথ অতিক্তম করতে গিয়ে প্রায়ই সেখানে মালবোঝাই অনেক ট্রাকের এক্সেল ভেঙ্গে গাড়ি বিকল হয়ে পড়ছে।
আবার সংযোগ সড়ক থেকে ওই ঢালুপথে নেমে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেরিতে উঠছে বিভিন্ন গাড়ি। পাশাপাশি সবকটি ঘাটের পন্টুনের গুরুত্বপূর্ণ পকেটগুলোতে (যেখানে ফেরি ভিরে) কোনো বেরিয়ার নেই। সেখানে ফেরি ভিড়ে না থাকলে পকেটগুলো সম্পূর্ণ খোলা ও অরক্ষিত অবস্থায় থাকছে।
আনফিট লঞ্চ
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলাচলকারি লঞ্চগুলো চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরনো। প্রায় অকেজো হয়ে পড়া কোনো কোনো লঞ্চের উপরে চকচকে বাহারি রঙের প্রলেপ থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিনসহ ভিতরের অনেক কিছইু জোড়াতালি দেওয়া।
সেখানে প্রশিক্ষিত কোনো মাষ্টার (চালক) না নিয়ে অনেক লঞ্চমালিক সামান্য বেতনে অনভিজ্ঞ ‘হেলপার’ দিয়ে তাদের লঞ্চ চালাচ্ছেন।
প্রতিটি লঞ্চে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, ফায়ার বাকেট, বালুভরা বাক্স, পাম্প মেশিন, লাইফ বয়া, ফাস্টএইডসহ জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ লঞ্চে তা প্রয়োজনীয় সংখ্যক নেই। প্রতি বছর ঈদের আগে ঘরমুখো ও ঈদের পরে কর্মমুখো মানুষর চাপ পড়ে লঞ্চঘাটে। এ সুযোগে চলাচলকারি প্রতিটি লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহনের অভিযোগ রয়েছে।
ভুয়া টিকিট বিক্রি
ব্যস্ততম দৌলতদিয়া ঘাটে বিআইডাব্লিউটিসির ফেরির টিকিটবুকিং কাউন্টারক ঘিরে স্থানীয় দালালচক্র রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে বিভিন্ন পণ্যবাহি ট্রাকচালকদের কাছ থেকে ওই দালালরা অতিরিক্ত টাকা নিয়ে ফেরির টিকিট কিনে দেয়। পাশাপাশি তারা সিরিয়াল ভেঙে পেছনের ট্রাক আগে নিয়ে ফেরিপারাপার করে থাকে।
তবে প্রতি বছর ঈদের তিন দিন আগে থেকে পরের তিন দিন দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ট্রাকপারাপার বন্ধ থাকে। এ সময় টকদালাল চক্রের লোকজন দূরপাল্লার বিভিন্ন পরিবহন বাসের নামে ভুয়া টিকিট হাতে রেখে তারা সাধারণ যাত্রীদের প্রলুব্ধ করে। পরে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রীদের হাতে ওই ভুয়া টিকিট ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে দ্রুত কেটেপড়ে দালালরা। এতে বিপাকে পড়েন ঘরমুখো মানুষের অনেকই।
বেপরোয়া কুলি
দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট ও বাসটার্মিনাল এলাকায় বিভিন্ন যাত্রীর ব্যাগবোঝা বয়ে নেওয়ার কাজ করে এলাকার একদল কুলি। কিন্তু ঈদের আগে ও পরে লঞ্চঘাটে যখন হাজারো মানুষের ঢল নামে, তখন সেখানে কুলিদের অনেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা লঞ্চঘাট থেকে ১০-২০ টাকায় মিটিয়ে যাত্রীর ব্যাগ-বোঝা বয়ে নিয়ে যায় বাসটার্মিনালে।
সেখানে যাওয়ার পর ওই যাত্রীর কাছ থেকে জোর করে ৫০ থেকে ১০০ টাকা আদায় করে তারা। পাশাপাশি সুযোগ বুঝে বিভিন্ন যাত্রীর পকেট মেরে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয় সংঘবদ্ধ ওই কুলি-মজুরদের অনেকেই।
উল্টোপথে গাড়ি
মহাসড়কের দৌলতদিয়া ঘাটের ট্রাফিকমোড় থেকে বাংলাদেশ হ্যাচারিজ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। সেখানে সড়ক বিভাজন থাকা সত্বেও সংশ্লিষ্ট ট্রাফিকপুলিশের উদাসীনতার সুযোগে ওই ডাবল লেন সড়কে উল্টোপথে অবাধে চলাচল করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, রিক্সা, অটোরিক্সা, নছিমন, করিমন, মাহেন্দ্রসহ থ্রি-হুইলার বিভিন্ন গাড়ি।
এদিকে প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঈদের আগে ও পরে ওই সড়কে গাড়ির চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়বে। মহাসড়কের ওই ডাবল লেন অংশে উল্টোপথে গাড়ি চলাচল দ্রুত বন্ধ না হলে সেখানে যে কোনো সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
ফেরিতে জুয়ার ফাঁদ
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে রাতে চলাচলকারি ফেরিগুলোতে যাত্রী নিরাপত্তায় পুলিশি পাহারা নেই। এ সুযোগে এলাকার সংঘবদ্ধ একদল দুর্বৃত্ত ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে। রাতের অন্ধকারে ট্রলার নিয়ে এসে যাত্রীবেশে তারা চলন্ত ফেরিতে ওঠে। পরে সুযোগ বুঝে ফেরির ভিতরে মোমের আলো জ্বালিয়ে নিজেদের মধ্যে নগদ টাকার ‘তিন তাসের জুয়া’ খেলার আসর বসায়। তা দেখে ফেরিযাত্রীদের অনেকেই প্রলুব্ধ হয়ে ওই জুয়া খেলায় অংশ নেয়। তখন তারা জুয়া খেলায় অংশ নেওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নেয়। শেষে ঘাটে ভেড়ার আগে চলন্ত ফেরি থেকে ট্রলারে নেমে নদীর ভাটিপথে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ঘাটসংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এই নৌপথে চলন্ত ফেরিতে জুয়ার আসর ও ছিনতাইকালে সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তরা ধারালো রামদা, ছুঁরি ও চাইনিজ কুঁড়াল ব্যবহার করে থাকে। তাই ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেও মুখ খুলতে সাহস পায়না। পাশাপাশি ভুক্তভোগী যাত্রীদের অনেকে ঝামেলা এড়াতে আইনের আশ্রয় না নিয়ে নিজ গন্তব্যে চলে যায়।
কর্তৃপক্ষের মতে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার সহকারি মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার ঈদে অতিরিক্ত গাড়ি ও যাত্রীর চাপ সামাল দিতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট প্রস্তুত হয়ে আছে। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জেলাপুলিশ, থানাপুলিশ, বিআইডাব্লিউটিসি, বিআইডাব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।’