কর্মসংস্থানের জন্য ঝিনাইদহ জেলা থেকে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি মাসে এ জেলা থেকে গড়ে ৮৩৩ জন বেকার যুবক কর্মসংস্থানের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। ফলে ঝিনাইদহ পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ছে। এদের বেশির ভাগই ছাত্র ও বেকার যুবক।
বর্তমানে ঝিনাইদহের ১ লাখ ২৪ হাজার নাগরিক বিদেশে কর্মের জন্য অবস্থান করছেন। এর মধ্যে নারী রয়েছেন ১৪ হাজারেরও বেশি।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত ৮ বছরে ঝিনাইদহ জেলা থেকে বিভিন্ন দেশে ৫৫ হাজার বেকার যুবক বিদেশ গেছেন। এর মধ্যে অন্তত ৪ হাজার নারী রয়েছেন।
তবে তাদের এই যাত্রা স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের কর্মশালায় চাকরির জন্য বিদেশ গমনের এই তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত জেলার সদর, হরিণাকুণ্ডু, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অন্তত ২৫ যুবক সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছেন।
এর মধ্যে সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ৩ জন, পিরোজপুর গ্রামের ২ জন, মিয়াকুণ্ডু গ্রামের ৪ জন, মহামায়া ও গাড়ামারা গ্রামের ৮ জন, হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চাঁদপুর ও সড়াবাড়িয়া গ্রামের ৮ জনসহ একাধিক যুবক রয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে লাশ হয়ে ফিরে আসলেও বেশির ভাগ নিখোঁজ রয়েছেন।
জেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা আব্দুল আলীম বলেন, ঝিনাইদহ জেলায় সবশেষ জরিপে ২০ লাখ ৫ হাজার জনসংখ্যা রয়েছে। এর মধ্যে ৩ দশমিক ১ শতাংশ বেকার। সে হিসেবে জেলায় বেকারের সংখ্যা হবে প্রায় ৬০ হাজার।
তবে সরকারি এই জরিপ সঠিক মনে করেন না অনেকেই। কারণ, প্রতিটি বাড়িতেই একাধিক বেকার যুবক রয়েছেন। বাড়ি বাড়ি কর্মক্ষম বেকার যুবক থাকায় দিন দিন সংসারে অশান্তি বেড়ে যাচ্ছে। চাকরি না পেয়ে অনেকে হতাশ হয়ে বিপথগামী হয়েছেন।
শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের রফিকুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও তিনি চাকরি পাচ্ছিলেন না। তাই ৬ বছর আগে কর্মসংস্থানের জন্য তিনি কুয়েতে গেছেন।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সামিউল ইসলাম বলেন, এখন যারা বিদেশ যাচ্ছে তাদের মধ্যে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে যাবার প্রবণতা বেশি। প্রতিমাসে আমাদের জেলা থেকে গড়ে ৮৩৩ জন মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। বর্তমানে জেলার ৬ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছেন।
জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে আসেন সদর উপজেলার চাপড়ী গ্রামের আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, অনার্স পাস করার পর চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো চাকরি পাইনি। তাই বাবার কিছু জমি বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এদিকে বেকার যুবকদের ভিসাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। ঝিনাইদহে ব্যাংকের শাখা স্থাপিত হওয়ার পর থেকে ৫ বছরে প্রায় ২ হাজার যুবককে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। সে হিসেবে কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে প্রায় ২২ কোটিরও বেশি টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে।
ঝিনাইদহ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ রুস্তম আলী বলেন, আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বেকার যুবকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। যাতে তারা বিদেশে গিয়ে ভালো বেতনে কাজ করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, কর্মী হিসেবে যারাই বিদেশে যাবেন, তাদেরই আমাদের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। নইলে দালালের খপ্পরে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সুজন-এর জেলা কিমিটর সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী আমিনুর রহমান টুকু বলেন, অনেক বেকার যুবকদের মাঠে কাজ করা ছাড়া উপায় থাকে না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। আর এই সুযোগে দালালদের মাধ্যমে বিদেশ পাড়ি দিয়ে প্রতারিত হয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে অনেকেই। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল কালের কণ্ঠকে বলেন, দক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে অনেকেই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আবার দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়ে অনেকে সর্বস্ব হারিয়েছেন। তাই বিদেশ গমনের আগে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেতে হবে। এজন্য বর্তমানে সরকারিভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, দালালদের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।