কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলে। শিকারিরা অনেক সময় জেলের বেশ ধারণ করে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে। তাদের ধরতে সুন্দরবনে স্মার্ট প্রেট্রোল এবং বন বিভাগের টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিকার কমছে না।
তারা জানান, বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনো তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। শিকারি চক্রের কাছ থেকে অর্থ, হরিণের মাংসসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, অসাধু পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরাও।
আরো পড়ুন
টক দইয়ের সঙ্গে যেসব খাবার খাওয়া অনুচিত
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড এবং সুন্দরবন বিভাগ,গত বছরের জানুয়ারি মাস হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে শিকার করা ৬টি হরিণের মাথা, একটি গুঁইসাপ, ৮টি হরিণের চামড়া, ৪৮০ কেজি মাংস, ৩৮০টি হরিণ মারার ফাঁদ জব্দ করা হয়। আটক করা হয় ১৫ জন চোরা শিকারিকে। বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা এ বন্যপ্রাণী শিকারিদের আটক করা হয়। গত বছর বন্যপ্রাণী আইনে কয়রায় ৩৫টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ১২টি মামলা হরিণ শিকার ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে, যা বর্তমানে চলমান আছে।
সর্বশেষ গত বুধবার (২২ জানুয়ারি) রাতে সুন্দরবনের সত্যপীরের খাল এলাকা থেকে ৮০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে বন বিভাগ। এর আগে গত ৩ জানুয়ারি ৩৪ কেজি হরিণের মাংসসহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করে কয়রা থানা পুলিশ। এসব বিষয়ে পৃথক দুইটি মামলা হয়েছে। আটক করা হয় ১ জনকে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার এবং জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গকিলোমিটার। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে।
আরো পড়ুন
কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হলেই শুল্কারোপ বাদ : ট্রাম্প
যেভাবে চলে হরিণ শিকার
হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে ফাঁদ পাতেন শিকারিরা। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে পেতে আসা হয় ফাঁদ। পরের রাতে গিয়ে আবার দেখা হয়। যেসব এলাকায় হরিণের বিচরণ বেশি সেসব স্থানে নাইলনের জাল পেতে, স্প্রিং বসানো ফাঁদ পেতে, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও তীর অথবা গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়।
মাছ ধরার পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারিরা রাতের আঁধারে গোপনে বনে ঢোকেন। নাইলনের দড়ির এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করেন তারা। হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়। অনেক সময় এসব ফাঁদে আটকে হরিণ মারাও যায়। আবার অনেক সময় ফাঁদে পা আটকে জালে জড়িয়ে থাকে।
এসব ফাঁদ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কালিরচর, শিসখালী, ছদনখালী, কাগানদী, মরাকাগা, কেওড়াতলী খাল, ভোমরখালী, কুকুমারী, ভোমরখালী খাল, খলিশাবুনিয়া, বড়কুকুমারী খাল, নীল কোমল,কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে এনে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন জায়গায় হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
জানা গেছে, খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা ও জোড়শিং এলাকায় হরিণ শিকারি চক্রের আধিপত্য বেশি। আর হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বজবজা ও খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ি এলাকা। এ ছাড়া মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের নয়ানি, হড্ডা, খোঁড়লকাটি, বানিয়াখালী, শেখেরকোনা ও তেঁতুলতলার চর; কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর, ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর কয়রা; উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, কাটকাটা; মহারাজপুর ইউনিয়নের পূর্ব মঠবাড়ি, পবনা, মঠেরকোনা গ্রাম হরিণশিকারি চক্রের তৎপরতা রয়েছে। এসব গ্রামে হরিণ শিকারিরা রাতে ও দিনে দলবদ্ধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে নিয়মিত হরিণ শিকার করে। এসব এলাকায় হরিণ শিকার করে বিক্রি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।
আরো পড়ুন
হাসপাতাল ছেড়ে কোথায় উঠবেন খালেদা জিয়া?
দক্ষিণ বেদকাশির বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘একপাশে গহিন জঙ্গল অপরপাশে বসতি। মাঝে ছোট একটি নদী। শীতের সময় নদীর খালে পানি কম থাকে। পেশাদার হরিণ শিকারিরা গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে নাইলনের দড়ির ফাঁদ পেতে রাখে। আবার কলা ও রুটি দিয়ে বিষ টোপ দিয়ে রাখে। চলাচলের সময় হরিণ ওই ফাঁদে আটকে যায়। তারপর বনরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণের মাংস বিক্রি করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘গত কিছু দিন ধরে এলাকায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের খুশি করতে ও তদবির হিসেবে হরিণের মাংস সরবরাহ করে থাকে শিকারিরা। শিকারিদের বন বিভাগের লোকজন চেনেন। কিন্তু তাদের কখনো গ্রেপ্তার করেন না। আবার আটক করা হলেও বের হয়ে তারা আবারও শুরু করে।’
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, ‘কয়রা উপজেলাটি সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলাটিকে ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ, কয়রা এবং শাকবাড়িয়া নদী। উপজেলাটির তিন দিক নদীবেষ্টিত এবং ৭টি ইউনিয়নই সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত। উপজেলাটির গ্রামগুলোর বেশিরভাগই শ্রমজীবী মানুষ। সুন্দরবনের পাশের এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারই সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারাই বেশি হরিণ শিকারের সাথে যুক্ত।’
আরো পড়ুন
রাবিতে বহিরাগত শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার, মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা
এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কর্মসংস্থান হারিয়ে বনজ সম্পদ আহরণসহ নানা উপায়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কমেছে। যে কারণে বনজীবীদের কেউ কেউ জীবিকার তাগিদেও এসব কাজে লিপ্ত হচ্ছে।’
কয়রা থানার ওসি জি এম ইমদাদুল হক বলেন, ‘সব অপরাধ দমনে কয়রা থানা পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক হরিণ শিকার বেড়েছে। আমাদের অভিযান ও আমরা বাড়িয়েছি। একজনকে মাংসসহ গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, কয়রার সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকা থেকে এক হরিণ শিকারির কাছ থেকে তিনি এ মাংস এনেছেন। আমরা হরিণ শিকারি ও এদের মদদ দাতাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হরিণ শিকার বন্ধে আমরা হরিণের মাংস ক্রেতা, বিক্রেতা ও শিকারিদের চিহ্নিত করছি। ১১টি বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা করে এগোচ্ছি। সব স্টেশন কর্মকর্তাদের ইতিমধ্যে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমাদের কেউ হরিণ শিকারিদের সহায়তা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হরিণ শিকারের বিষয়ে আমাদের “জিরো টলারেন্স” থাকবে সব সময়।’
আরো পড়ুন
প্রকল্প এলাকা ঘুরে কাজ শুরুর নির্দেশ দিলেন জেলা প্রশাসক
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, ‘বন বিভাগ হরিণ শিকারিদের প্রতিনিয়ত ধরছে। এ ছাড়া স্মার্ট পেট্রোলিং টিমও হরিণ শিকারিদের ধরতে কাজ করছে। মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতরে খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। সে কারণে চোরা শিকারিরা এ সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এসব শিকারিদের ধরতে বন বিভাগ তৎপর রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে শিকারিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে বন বিভাগ। হরিণের ক্ষেত্রে বনের ভেতরে অপরাধ উদঘাটনের তথ্য দেওয়ায় ২০ হাজার টাকা এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া আছে। বনে শিকার বন্ধ এবং শিকারিদের ধরতে ১১ পরিকল্পনা নিয়ে বন বিভাগ অভিযান শুরু করেছে।’