মানুষ যখন উন্নতমানের কাঠ, স্টিলের খাট ইত্যাদি আসবাবপত্র ব্যবহার করছে, ঠিক এ সময়ই বাঁশের খাট, পালং, সুকেশ, দরমসহ গৃহস্থালি কাজের বিভিন্ন জিনিসপত্র সনাতনী পদ্ধতিতে তৈরি করছেন নেত্রকোনার কেন্দুয়ার আব্দুস সাত্তার। এ সব বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন ৯০ বছরের এই বৃদ্ধ।
সাত্তার তার ছোট ঘরের আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠা করেছেন কাঠ দিয়ে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারখানা। লোহার ফ্রেম তৈরি করে হাতে টানা মেশিন বসিয়ে খুন্দাই কাজের মাধ্যমে সনাতনী পদ্ধতিতে তৈরি করছেন স্বরাজ, দোতারা, একতারা, ডুগডুগি, খুঞ্জুরী, ঢোল, খমক, ঘাইল, বেলাইন ইত্যাদি।
এ ছাড়া বাঁশ-বেতের মাধ্যমে তৈরি করছেন মাছ শিকারের চাঁই (বাইর), পলো, ঝুপড়া, চুপরা, উঁইচ, বৃষ্টি ফেরানোর পাতলা, বিভিন্ন প্রকার ঘুড়ি, বিছানার খাট, পালং, দরম, স্যুকেশ, টেবিল, ৩৫ ফুট লম্বা বাঁশের মই ইত্যাদি।
ক্রেতারা তার বাড়িতে এসে এসব জিনিস কিনে নিয়ে যান। মূল্য নিয়েও সমস্যা হয় না। খুব কম মূল্যেই এসব তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করেন সাত্তার।
কম দামে বিক্রির কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, তিনি দরিদ্র হলেও লাভের আশায় এগুলো তৈরি করেন না। এ কাজকে তিনি শিল্প মনে করেন। তাই মনের মাধুরী মিশিয়ে একটু একটু করে এসব জিনিস তৈরি করেন তিনি। যে কারণে নিজে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে ৫৩ বছর ধরে মানুষের বহু ঘরবাড়ি নির্মাণ ও ঘর সাজাতে আসবাবপত্র তৈরি করে দিলেও নিজে থাকবার একটি ভাল ঘর নেই তার।
অত্যন্ত অর্থকষ্টে একটি মাত্র ভাঙ্গা ঘরে জীবনযাপন করছেন গ্রাম্য পণ্যের অসাধারণ এক হস্তশিল্পী এই কারিগর সাত্তার।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সরেজমিনে তার বাড়িতে গেলে কথা হয় বৃদ্ধ কাঠমিস্ত্রি সাত্তারের সঙ্গে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের চকসাদক কোনা পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই নিভৃতচারী শিল্পী। পিতা মৃত সমর আলী ওরফে লাবু মিয়া, মায়ের নাম নাইবের মা। তারা বহু আগেই মারা গেছেন।
সাত্তার জানান, একদম লেখাপড়া করেননি তিনি। স্ত্রী মোছা. আবিয়া খাতুনকে নিয়ে সংসারে তিন ছেলে- নজরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান ও দীন ইসলাম। তাদের স্ত্রীরা এবং নাতি-নাতনিদের নিয়ে ২১ জনের একটি পরিবার। মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ জায়গায় তাদের বসবাস।
তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে শখ করে এসব তৈরি করলেও পরে এটিই পেশা-নেশা হয়ে উঠে। ৪০-৪৫ বছর আগে মাসকা ইউনিয়নে উত্তর মাসকা গ্রামের ঘানি তৈরির কারিগর আ. জব্বারের কাছে কারুকাজের তালিম নেন তিনি। তিনিই আমার ওস্তাদ।'
এ সব আসবাবপত্র তৈরিতে কী কী যন্ত্রপাতি লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বাদ্যযন্ত্র ও আসবাবপত্র তৈরি করতে-কাঠ, বাঁশ, চামড়া, ফিতা ইত্যাদি কিনে আনতে হয়। এসব জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখন আর পোষে না। খুব টানাপোড়েনে আছি। তা ছাড়া বিদ্যুৎ চালিত খুন্দাইল মেশিন নেই। নিজে তৈরি হাতে টানা মেশিন দিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে এসব জিনিস তৈরি করি। এই সমস্ত জিনিস এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এগুলো জাদুঘরে স্থান পাওয়ার যোগ্য।'
তিনি বলেন, 'এই সব জিনিসপত্র তৈরি করতে দুইজন লোক লাগে। টাকা দিয়ে সহকারী রাখার মত সামর্থ্য নেই আমার। তাই যখন যাকে পাই তাকে দিয়েই দড়িটানার কাজটা করিয়ে নিই।'
একাজে সংসার চলে? এমন প্রশ্নের জবাবে শিল্পী বলেন, 'একদম চলে না। ঘরটা ভেঙে পড়ছে, মেরামত করতে পারছি না। ছেলেরা মিস্তিরি কাজ করলেও তারা আলাদা থাকে।'
এই শিল্পকর্ম তৈরিতে সরঞ্জামের বিষয়ে তিনি বলেন, বেশি কিছু লাগে না। একটি খুন্দাই মেশিন, কুইজবাটাল, রাউন্ডবাটাল, সাফবাটাল, বিলসা, মাথিম, করাত, হাতুড়ি, ফিতা, স্কেল ইত্যাদি।
তিনি বলেন, 'এক সময় বৈঠকি বাউল গান করতাম, এখন আর করি না। আমার তৈরি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে শিল্পীরা যখন গানবাজনা করেন আমার তখন খুবই আনন্দ হয়। তখন ভুলে যাই পেটে ভাত না থাকার কথা।'
সাত্তারের স্ত্রী জানান, 'সারাজীবন মানুষটা কষ্টই করল। থাকার মত একটা ঘর পর্যন্ত নেই। সরকার যদি একটা ঘর, একটা খুন্দাইল মেশিন দিতো, বাকি জীবনডা একটু শান্তি পাইতো।'
সাত্তারের প্রতিবেশী আব্দুল হাই, আব্দুর রহমান, মনিরুল ইসলাম, মহসিন আলম বাবুলসহ গ্রামের অনেকেই বলেন, তিনি (সাত্তার) একজন অসাধারণ গুণী মানুষ। সারাজীবন খুব কম লাভে একাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তার তৈরি জিনিস মানুষ দেখতে আসে এটা আমাদের গর্ব। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে শেষ জীবনে একটু সান্ত্বনা নিয়ে যেতে পারতেন।