ঘড়ির কাটা তখন সকাল ৯টা ছুঁই ছুঁই করছে। বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্র গীর্জামহল্লার জামে কশাই মসজিদের মহিলাদের নামাজের প্রবেশদ্বার। ঈদের প্রথম জামায়াতের নামাজ শেষে প্রবেশদ্বারে নারীদের জটলা। ঠিক তখনই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন কলেজ শিক্ষার্থী আফসিয়া আক্তার ও স্কুলশিক্ষিকা রোশনে আরা বেগম।
তখন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহবধূ আঞ্জুমান বেগমও তাদের দুজনকে অতি মমতায় জড়িয়ে ধরেন।
ওই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে ছিলেন সাংবাদিক খান মনিরুজ্জামান। তার ভাষ্যমতে, তাদের প্রত্যেকের চোখেই আনন্দের ঝিলিক অনুভব করা গেছে। তাদের মধ্যে একমাত্র স্কুলশিক্ষিকা রোশনে আরা বেগম কশাই মসজিদে মেয়েদের দলে তারাবির নামাজ পড়েছেন।
নিউ সার্কুলার রোডের বাসিন্দা আফসিয়া আক্তার মসজিদে এই প্রথম এসেছেন। অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে তাই নিজেই বলে ওঠেন, ‘কখনো ভাবিনি, বাড়ির বাইরে মসজিদে এসে পুরুষের পাশাপাশি অন্য নারীদের সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করব।’
আরো পড়ুন
এবার আনন্দময় পরিবেশে দেশবাসী ঈদ উদযাপন করছে : মির্জা ফখরুল
কলেজ শিক্ষার্থীর সেই বক্তব্যের সত্যতা মেলে ইতিহাস ঘেঁটে। আর সেই নির্মম ইতিহাস হচ্ছে, নারীদের ঈদের নামাজ পড়ার জায়গা বলতে এতদিন ঘরের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
নারীরা বন্ধ ঘরে, বড়জোর বাড়ির ছাদে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। আফসিয়া এতদিন চৌহদ্দিতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তবে আজ সোমবার ঈদের দিন সকালে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রের কশাই মসজিদে গিয়ে দল বেঁধে নামাজ পড়েন আফসিয়ারা।
ঈদের দিন সকালে বিভাগীয় শহরের তিন শতাধিক মহিলা একমাত্র কশাই জামে মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি আলাদাভাবে নামাজ পড়েছেন। বরিশাল মহানগর ইমাম সমিতির সভাপতি ও জামে কসাই মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা আব্দুল মান্নান তাদের নামাজের ইমামতি করেছেন।
প্রার্থনা করেছেন বিশ্বশান্তির। ওই ইমামের নেতৃত্বেই পুরুষদের নামাজ পড়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল একই মসজিদের নীচতলায়।
আরো পড়ুন
নির্বাচন বিলম্বিত হলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে : মঈন খান
নগরীর কাঠপট্টি রোডের গৃহবধূ সাবানা বেগম বলেন, ‘মহিলাদের যে ফতোয়ার বেড়াজালে আটকে দেওয়া হয়েছিল, তার বাইরে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে নামাজ পড়তে পেরে খুব ভালো লাগছে।’
মসজিদে নামাজ পড়তে পেরে খুশি আমতলা মোড় এলাকার রুনা আক্তার, লায়লা বেগম, পুলিস লাইনস রোডের আলিয়া বেগমরাও। আলিয়ার কথায়, আমরা চাই কশাই মসজিদের মতো অধিকাংশ মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা হোক।
বরিশাল মহানগর ইমাম সমিতির সভাপতি ও জামে কসাই মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদের দুটি জামায়াতে প্রায় তিন হাজার নারী-পুরুষ নামাজ আদায় করেছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৪০০ নারী নামাজি ছিলেন। যেটা বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। শুধু ঈদের জামাত নয়, তারাবিতেও নারীদের অংশগ্রহণ অনেক ছিল। অন্তত দুই শতাধিক নারী প্রত্যেক দিন ইফতারি করেছেন।’
আরো পড়ুন
ঈদের আনন্দ উদযাপনে শরিয়তের নির্দেশনা
জানা গেছে, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানার কয়েকমাস আগে কেন্দ্রীয় জামে কশাই মসজিদ কমিটি ওই সময়টায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, দিনভর রোজা রাখার পরে মসজিদেই তারাবির নামাজ পড়তে পারবেন নারীরা। তারপর পর্যায়ক্রমে শুক্রবার জুমা, তারপর ফজর বাদে চার ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের নামাজ আদায়ের অনুমতি মেলে। সেই থেকে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে হেমায়েত উদ্দিন রোডের জামে কশাই মসজিদে গিয়ে দল বেঁধে নামাজ শুরু করেন নারীরা।
প্রায় ১৭ বছর আগে, নারীদের জন্য প্রথম কশাই মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু তখনও অনেকে ফতোয়া জারির মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। তবুও নারীদের জামায়াতে নামাজ আদায় থেমে থাকেনি। মাঝে দু’বছর করোনার প্রকোপে মসজিদে জামাতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। করোনা শেষে মসজিদে গিয়ে প্রতিদিনের নামাজ যাতে আদায় করা যায়, সে চেষ্টায় শামিল হয়েছিলেন নারীরা।