আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজে যাওয়ার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। দারিদ্রতা, অশিক্ষা, পৃষ্টপোষকতার অভাব ইত্যাদি কারণে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিল না। আগ্রহ ছিল না তাদের অভিভাবকদেরও। নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে এসে সমাজের অন্য দশ জনের সঙ্গে মিলেমিশে পড়াশোনা করাটাও তাদের অনুকূলে ছিল না।
তবে দিন বদলেছে। সময়ের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে সমাজের, সমাজের মানুষদের। তেমনি চিন্তা চেতনায় পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে হরিজন সমাজেও। দীর্ঘদিন ধরে নানাবিধ বৈষম্যের মধ্যেও শিক্ষার আলোয় একটি নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে চলেছে হরিজন ও বাঁশফোর সম্প্রদায়ের কিশোর-কিশোরীরা।
ময়মনসিংহের নতুনবাজার রেলক্রসিং সংলগ্ন হরিজনপল্লী এলাকায় হরিজন ও বাঁশফোর সম্প্রদায়ের বসবাস। হেলা পঞ্চায়েত প্রধান বিজয় হরিজনের দেওয়া তথ্যমতে, এই এলাকায় হরিজন ও বাঁশফোর মিলে প্রায় ৪০০ পরিবারের বাস এবং জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার জন। এ কমিউনিটির বেশিরভাগ মানুষ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করে থাকেন।
অল্প সংখ্যক মানুষ অন্য পেশায় জড়িত হলেও তা সংখ্যায় খুবই সীমিত।
এদের অনেকেই নিজেদের পরিচয় দিতে দ্বিধান্বিত হন। দেশ কিংবা রাষ্ট্র উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে গেলেও তাদের জীবনযাত্রার মানে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। এ সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করে থাকেন, পড়াশোনা করে তাদের জীবন-মানে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না। তাদের বংশধরদেরও পেশা হিসেবে ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীকেই বেছে নিতে হবে।
তবে হরিজন ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় মূলত এগিয়ে এসেছে বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
বেসরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানেই ২০-২৫ বছর আগে হরিজন পল্লীতে হরিজন শিশুদের নিয়ে চলত প্রাথমিক পর্বের পাঠদান। কিন্তু মাধ্যমিকে বা কলেজে হরিজন শিশুদের যাতায়াত তখন ছিল না বললেই চলে। তবে এ সম্প্রদায়ের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে এবং এখনো করছে। প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার (পিসিসি)-এর প্রকল্প প্রমোটিং এডুকেশন এন্ড রাইটস অব মাইনরিটিস (পার্ম) অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি হরিজন সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও অধিকার উত্তরণে ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থা।
প্রকল্পটি শুরু থেকেই হরিজন সম্প্রদায় এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ৮০ শিক্ষার্থীকে তাদের শিক্ষার সুবিধায় মাসিক শিক্ষাবৃত্তি, ভর্তি ও অন্যান্য ফি ও শিক্ষা উপকরণ দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কিশোর-কিশোরীদের জন্য ক্লাব গঠন, মানবাধিকার, নৈতিক মূল্যবোধ, জীবন দক্ষতা এবং বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত কর্মশালা করে থাকে। এতে এ কমিউনিটিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুরনো ধ্যান-ধারণা ভেঙে হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। পারস্পারিক যোগাযোগ দক্ষতা ও নেতৃত্ব দক্ষতা বেড়েছে। বাল্যবিবাহ বিষয়ে অভিভাবক ও কমিউনিটি জনগণের সচেতনতা বেড়েছে।
বর্তমানে নতুন বাজার হরিজন কমিউনিটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ২২০ জন, উচ্চবিদ্যালয়ে ৫৭ জন এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ জন পড়াশোনা করছে। যা নতুন আশার সঞ্চার করে। এ কমিউনিটির শিশু-কিশোর-যুবরাও এখন স্বপ্ন দেখে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, পুলিশ-আর্মি অফিসার ও শিক্ষক হওয়ার।
এ সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী শাওন সরকার বর্তমানে এইচএসসি পাশ করে অনার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, তার স্বপ্ন একজন ব্যাংকার হওয়া।
হরিজন পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি বিনোদ হরিজন বলেন, হরিজন পল্লীতে শিক্ষার হার খুব কম ছিল। হরিজন কমিউনিটির অনেক ছেলে-মেয়ে এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। স্বপ্ন দেখছে, ভবিষ্যতে ভালো অবস্থানে যাওয়ার।
হরিজন যুব সঙ্গের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব হরিজন বলেন, হরিজন পল্লীর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নিজ কমিউনিটির বাইরে স্কুলগুলোতে ভর্তির আগ্রহ কম ছিল। বর্তমানে শিক্ষার বিষয়ে সচেতনতার ফলে তারা নিজ কমিউনিটির বাইরেও অনান্য বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সুবর্ণা পলি দ্রং বলেন, একটি ন্যায্য ও বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। আমাদের কাজের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, নতুন বাজার হরিজন কমিউনিটির মানুষের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ছেলে শিশুর পাশাপাশি মেয়ে শিশুদের শিক্ষা ও অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্য বিবাহ হ্রাস পেয়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিসার মোহসীনা খাতুন বলেন, হরিজন শিশুরা আজ পড়াশোনায় এগিয়ে আসছে। এঠি ইতিবাচক দিক।