বাংলাদেশের প্রতিভাবান পরিচালক তৌকির আহমেদ (জন্ম ১৯৬৬) এর "স্ফুলিঙ্গ" বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শন, বিশ্বাস, সততা, মানবতার উপলব্ধিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের একটি তাগিদ এই সিনেমা। জয়যাত্রা (২০০৪), রূপকথার গল্প(২০০৬), দ্বারুচিনি দ্বীপ(২০০৭), অজ্ঞাতনামা(২০১৬), হালদা(২০১৭), ফাগুন হাওয়ার(২০১৯) পর তৌকির আহমেদ নির্মাণ করলেন তাঁর সপ্তম চলচ্চিত্র "স্ফুলিঙ্গ" (২০২১)।
সিনেমাতে সাম্যবাদী পার্থ (শ্যামল মাওলা) তরুণ প্রজন্মের 'স্ফুলিঙ্গ'।
পার্থকে ঘিরে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সমাজ নানান দুর্নীতির বেড়াজালে পর্যদুস্ত। তাই শিক্ষক যখন পার্থকে 'কমিউনিস্ট' বলে ব্যঙ্গ করে, এ উপেক্ষা যেন পুরো জাতির প্রতি অনুরণিত হয়। ফলে পার্থ বাবার পেনশনের টাকা উদ্ধারে যেমন হয়ে উঠে মারমুখী,তেমনি শিক্ষকের আদর্শহীন কাজের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠে তার আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে নজরুল 'বিদ্রোহী' হতে চেয়েছিলেন। আর বর্তমান সময়ের নানান অসাধু পদক্ষেপ এর বিরুদ্ধে তরুণদের স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বালাতে চেয়েছেন নির্মাতা। এই স্ফুলিঙ্গ কখনো গানের, কখনো প্রতিবাদের, কখনো মুক্তিযুদ্ধের।
পার্থ(শ্যামল মাওলা) পুরো সময়কে অনবদ্য বিশ্বাস যোগ্যতায় উপস্থাপন করেছেন।
পরিমনি 'দিবা' চরিত্রে এক অতলান্ত গভীরতাকে ধারণ করেছেন। পর্দায় যার উপস্থিতি স্নিগ্ধ ও সরল।। সুঅভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম একাকার হয়ে গেছেন আইরিন চরিত্রে। প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেতা রওনক হাসানের ব্যক্তিত্বের একটা ভীষণ শক্তি আছে, যে কারণে যে কোন চরিত্রই তিনি ধারণ করেন অনিবার্য বিশ্বস্ততায়। এ সিনেমায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। একুশে পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা আবুল হায়াতকে নেতিবাচক চরিত্রে দেখিয়েছেন পরিচালক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব-- সে দ্বন্দ্বময় কূট, খল চরিত্রের রূপায়নে তাঁর পরিমিতিবোধ দেখার মতো। এছাড়া মামুনুর রশীদ, ফখরুল বাশার, শহীদুল আলম সাচ্চু, করভী মিজান প্রত্যেকেই স্ব স্ব চরিত্রে অনবদ্য ও বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। সংগীত আয়োজনে ব্যান্ড দলের মিউজিক্যাল জার্নি দারুণ ভাবে তৈরি করেছেন পিন্টু ঘোষ। গানগুলো এ ছবির বড় সম্পদ। পরিচালক একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতির পিতার চেতনাকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পরিবাহিত করেছেন অসামান্য দক্ষতায়।
ছবিতে ১৯৭১ ও ২০২১ সমানতালে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। একাকার হয়ে গেছে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম। ৫০ বছর আগে পরের দুই সময়কে ধারণ করতে দুটো কালার ডিজাইন কাহিনির সাথে অনায়াসে দর্শকের যোগসূত্র তৈরি করেছে। লাইট ও শেড, সাউন্ড ডিজাইন এবং সম্পাদনা সুপ্রযুক্ত। তবে একই লোকেশনে বার বার শ্যুটিং নান্দনিকতা ও বিশ্বাস যোগ্যতায় ছেদ ঘটিয়েছে। যেমন- গানের কনসার্ট গুলো একই জায়গায় প্রায় একই আর্ট ডিরেকশন এ ধারণ করা হয়েছে। লংশট ও ওয়াইড শট এর কমতি, পাশাপাশি কম্প্রোমাইজড ও কমপ্যাক্ট শট বেশি বলেই মনে হয়েছে। ফলে চলচ্চিত্রের চলমানতা সবসময় অনুভূত হয়নি।
মেকআপ কোনও কোনও জায়গায় আরও যত্নশীল হলে ভালো লাগতো। ( যেমন- মমর ঠোঁটের নিচের সিলভারের গয়না একই পয়েন্টে থাকেনি।) পোশাকের বিন্যাসে অনেক সময় চরিত্রের উপস্হাপনে খটকা লাগে। যেমনঃ মুল চরিত্রকে ছাপিয়ে পরীমণির গানের দৃশ্যের (ভালোবাসি তোমারে) শাড়ি দুটো উপস্থাপিত হয়েছে। আগের পোশাক গুলোর মতো 'দিবা'র পোশাক না হয়ে এগুলো যেন পরীমণির পোশাক হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি মেধাবী নির্মাতা তৌকির আহমেদের অন্যান্য সিনেমার প্রযত্ন এই চলচ্চিত্রে কোথাও কোথাও অনুপস্থিত মনে হয়েছে।
স্বপ্নের বাংলাদেশ নিবেদিত এই চলচ্চিত্রে শিক্ষাঙ্গনের নানান দুর্নীতি,বিচার ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের স্বদেশ পলায়ন-- সমকালীন নানান অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন নির্মাতা। সেলুলয়েডে জাতির জনকের দর্শন ও চিন্তা এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে বর্তমান তারুণ্যের মেলবন্ধন তথা যোগসূত্র তৈরি নির্মাতার অনন্য কৃতিত্ব।