চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামকেও একটি পর্বে অতিথি করার সুযোগ হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি ধারণ করার চার দিন পরই তিনি না-ফেরার দেশে পাড়ি দেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে তাঁর কোনো ফুটেজ ছিল না। আমাকে তারা অনুরোধ করেছিল চ্যানেল আইকে বলে কিছু ফুটেজ দেওয়ার জন্য। এ রকম অনেক অনেক স্মৃতি আছে অনুষ্ঠানটি ঘিরে। ২০১২ সালে আমার ছেলে দেশের বাইরে পড়তে গিয়েছিল। সঙ্গে আমাকে যেতে হয়েছিল বলে আর অনুষ্ঠানটা করা হয়নি।
আশির দশকের শুরুতে সংবাদ পাঠে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। সেই সময়ে এই পেশায় যোগ দেওয়া খুব সহজ ছিল কি?
আমরা খুব কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছিলাম। মনে আছে, চারটি ধাপ পার করার পর আমি সংবাদ পাঠে সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন দেশে একটামাত্র টিভি চ্যানেল, বিটিভি। প্রথম ধাপে ছিলাম ৫০ জনের বেশি। শুরুতে রিডিং পড়ার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। এর পরের ধাপে স্ক্রিন টেস্ট হয়েছিল। তারপর আরো দুটি ধাপ পার হয়ে আমরা মাত্র পাঁচজন সুযোগ পেয়েছিলাম। শুরুতে লোকাল নিউজগুলো পড়তাম আমরা। দুই বছর পর ৫ মিনিটের নিউজ এবং দশ বছর পর প্রধান নিউজ পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এখন তো অনেকে এক বছরের মধ্যেই প্রধান নিউজ পড়ার সুযোগ পায়। তা ছাড়া দেশে টেলিভিশন চ্যানেলও অনেক।
আপনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। এত বড় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লেখালেখিসহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত। সময় করে ওঠেন কিভাবে?
সময়কে কখনো অবহেলা করি না। মনে করেন, টেবিলে বসে আছি, হঠাৎ মুড এলো, একটা ছড়া লিখে ফেললাম। তা ছাড়া প্রতি বুধবার কিন্তু এখনো আমি বাংলাদেশ বেতারে রাত সাড়ে ৮টার সংবাদ পড়ি। নিয়মিত অফিস করি, পরিবারকেও সময় দিই। আমার মনে হয়, সময়ের সঠিক ব্যবহার করলে এক দিনে অনেক কিছুই করা যায়।
আপনি সব সময় পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও সমান তালে এগিয়ে চলার কথা বলেন। বর্তমান সমাজে নারীরা কতটুকু এগিয়েছে বলে মনে করেন?
অনেকটাই এগিয়েছে। আমার কথাই যদি বলি, ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলাম। খুব ইচ্ছা, সাংবাদিকতায় পড়ব। মনে করতাম, সাংবাদিকতায় না পড়লে সাংবাদিক হওয়া যায় না। ইচ্ছার কথা পরিবারকে জানালাম। আম্মু-আব্বু রাজি হলেন না। আব্বু বললেন, ‘এখনো তো তোমাকে কোথাও যেতে হলে ভাই অথবা আমাকে নিয়ে যেতে হয়। তুমি কিভাবে সাংবাদিকতা করবে? তা ছাড়া সাংবাদিকদের রাতবিরাতে বাসায় ফিরতে হয়। সমাজ কী বলবে?’ ইচ্ছাটা আর পূরণ হলো না। বাধ্য হয়ে ফিন্যান্সে অনার্স-মাস্টার্স করলাম। অথচ এখন দেখেন, হাজার হাজার মেয়ে সাংবাদিকতায় পড়ছে, সাংবাদিকতা করছে। আমাদের সময়ে কোনো মেয়ে পাইলট হবে ভাবাই যেত না। আর এখন কত মেয়ে পাইলট! আমরা অনেক এগিয়েছি। তবে আরো এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বের বুকে উদাহরণ তৈরি করতে হবে।
শিশু সাহিত্যে আপনার বিশেষ দখল রয়েছে। এটা কি সহজাতভাবে এসেছে?
ছোটবেলায় দেখেছি, পরিবারের সবাই নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ত। বাসায় তখন অবজারভার ও আজাদ পত্রিকা রাখা হতো। বাবার কঠোর নির্দেশ ছিল, পত্রিকা পড়তেই হবে। আমিও পড়তাম। তবে শিশু সাহিত্যের পাতাটা খুব টানত। সেখানেই ছোটদের ছড়া, গল্প পড়ে মনে হতো আমার নামটা যদি সেখানে থাকত! এই শুরু—ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। বাসায় সবাই নাম দিলেন কবি মেয়ে। ১৯৬৮ সালে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘পাকিস্তান খবর’ পত্রিকায়। কিছু দিন পরে ডাকযোগে ১০ টাকা সম্মানিও পেয়েছিলাম। সেই যে শুরু, আর থামিনি।
গত ৫৭ বছরে মোট কতটি বই প্রকাশিত হয়েছে আপনার?
৪৪টি। প্রথম বই ‘রেলগাড়ি’ প্রকাশ করেছিলেন আমার স্বামী মতিউর রহমান চৌধুরী। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৩০টি ছড়ার বই ও ১০টি ছোটদের গল্পের বইসহ সংখ্যাটা ৪৪-এ পৌঁছেছে। পাঠক ও প্রকাশকদের অপার ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ।
এবারের বইমেলায় কী এসেছে?
এবারও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি ‘দোতনা ও ছোটমামা’ সিরিজের ও অন্যটি ‘সঙ্গী যখন ছড়া’। আমি বিদেশে ঘুরতে খুব পছন্দ করি। বিদেশে ঘোরার অভিজ্ঞতা ‘দোতনা ও ছোটমামা’ সিরিজে তুলে ধরি। এবার ম্যানিলার অভিজ্ঞতা লিখেছি। বাচ্চারা এই সিরিজ দারুণ পছন্দ করে।
লেখক হিসেবে আপনার অর্জন নিয়ে যদি বলতেন...
অনেক পুরস্কারই তো পেয়েছি। তবে দুজন মানুষের দুুটি বাক্য আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। বিখ্যাত কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ বলেছিলেন বাক্য দুটি। আমার ‘কথায় কথায়’ বইটির প্রকাশনা উৎসবে অতিথি হয়েছিলেন শামসুর রাহমান। স্টেজে তিনি বইটি পড়েছিলেন। এরপর যখন বইটি নিয়ে তাঁকে কথা বলার অনুরোধ করা হলো, তিনি মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে বললেন, ‘আমি ওর (আমার) ছন্দ মিলের বাহাদুরি দেখে স্তম্ভিত হয়েছি।’ আরেকবার বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে কবি আল মাহমুদের সামনে দুটি ছড়া আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলাম। শুনে আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে টিভির সামনে যারা কবিতা দুটি শুনলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ঈর্ষান্বিত হয়েছেন, এ মেয়েটা এত সুন্দর ছড়া কিভাবে লেখে!’