<p>দেশে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কাজটি এখন সম্পন্ন হবে বলেই অনেকের ধারণা। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ব্যাংক পরিচালনার মানোন্নয়ন করার উদ্দেশ্যে এই খাতে সংস্কারের উদ্যোগ দীর্ঘদিনের দাবি হলেও এ ব্যাপারে সে রকম গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ আগে কখনো নেওয়া হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই এদিকে নজর দিয়েছে এবং দেশের ব্যাংকিং খাত সংস্কারের উদ্দেশ্যে গভর্নরের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্সও গঠিত হয়েছে। ফলে পর্যবেক্ষকমহলের বিশ্বাস, এবার অন্তত দেশের ব্যাংকিং খাতে একটি মানসম্পন্ন সংস্কার হবে।</p> <p>দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের দাবি যেমন দীর্ঘদিনের, তেমনি এই কাজটি বেশ জটিল এবং ব্যাপক এক কর্মযজ্ঞও বটে। দেশের ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খল অবস্থা যেমন দীর্ঘদিনের, তেমনি এই খাতের সমস্যারও কোনো অন্ত নেই। ফলে সব কিছু ঠিক করে, সব ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা দূর করে এবং বিরাজমান সব সমস্যার সমাধান করে একটি কার্যকর ও সফল সংস্কার সম্পন্ন করা এক ধরনের অসাধ্য সাধন করার মতো। এ কথা ঠিক যে দেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যার যেমন শেষ নেই, তেমনি সব সমস্যা সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়।</p> <p>গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। তবে দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যার বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে সুশাসনের অভাব এবং মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ। এই দুটি বিষয় যে দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সমস্যা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এগুলো অন্য আরো অনেক সমস্যার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে।</p> <p>যেমন নিয়ন্ত্রক সংস্থার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা এবং এক ধরনের আপসমূলক আচরণের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। একইভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির মাধ্যমে আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয় ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বা ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট (সিআরএম) প্রবর্তন করতে না পারার কারণে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। যা হোক, সার্বিক বিচারে সুশাসনের অভাব এবং খেলাপি ঋণ আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমস্যা। এ কারণেই ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করতে হলে প্রথমেই ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিতে হবে। ব্যাংকিং খাত সংস্কারে সুশাসনই বড় চ্যালেঞ্জব্যাংকে সুশাসন নিয়ে আলোচনা করা যত সহজ, বাস্তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।</p> <p>সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে সুশাসনের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নিরূপণ করা। অর্থাৎ কী কী পদক্ষেপ নিলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটি নিশ্চিত করে নির্ধারণ করা বেশ কষ্টসাধ্য। সুশাসন সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে সব কিছু ঠিকমতো চললে বলা হয় সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে। আবার যখনই কোনো সমস্যা হয় বা কোনো কিছুর ব্যত্যয় ঘটে, তখন বলা হয় যে সুশাসনের বড় অভাব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের ব্যাংকে সে রকম কোনো সমস্যা হয় না বা তেমন কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায় না। এ কারণে বলা হয়ে থাকে যে উন্নত বিশ্বের ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যাংকে নানা সমস্যা লেগেই আছে এবং প্রায়ই অনেক কিছুর ব্যত্যয় ঘটে। সে কারণে বলা হয়ে থাকে যে সেসব দেশের ব্যাংকে সুশাসনের বড় অভাব।</p> <p>এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে ন্যূনতম সুশাসন বা গুড গভর্ন্যান্স মেনে চলা হয় না। এর বড় কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের বেসরকারি ব্যাংকের মালিক হচ্ছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। যাঁরা দেশের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক, তাঁরাই ব্যাংকের পরিচালক এবং চেয়ারম্যান হয়ে থাকেন। ফলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা তাঁদের আর দশটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেভাবে পরিচালনা করেন, ঠিক একইভাবে ব্যাংকও পরিচালনা করে থাকেন। তাঁরা বুঝতেই চেষ্টা করেন না যে দেশের এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেক আইন ও বিধি-বিধান মেনে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। ফলে ব্যাংক পরিচালনা করতে গিয়ে তাঁরা এমন আচরণ করেন এবং এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেন, যা প্রচলিত আইনের চরম লঙ্ঘন। আর এ কারণেই ব্যাংকে তখন সুশাসনের চরম অভাব দেখা দেয়।</p> <p>বহুল আলোচিত এই সুশাসনের সংজ্ঞা নিয়ে আমাদের দেশের অনেক ব্যাংকারের মধ্যেও পরিষ্কার ধারণা নেই। আমি অনেক ব্যাংকারের কাছে সুস্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছি যে সুনির্দিষ্টভাবে কী কী পদক্ষেপ  নিলে ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সন্তোষজনক উত্তর আমি কারো কাছ থেকেই সেভাবে পাইনি। আর এ কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার কাজটি এমনিতেই জটিল হয়ে যাবে। এর বিকল্প হিসেবে আইএমএফ বা বিদেশি পরামর্শকদের কাছ থেকে সুশাসনের ব্যাপারে কিছু সুপারিশ এবং পদক্ষেপ নিয়ে বাস্তবায়ন করলেই যে দেশের ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে, সেটিও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তা ছাড়া এভাবে সুশাসন নিশ্চিত করলে কাগজে-কলমে ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলেও বাস্তবে সুশাসন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। কেননা আমাদের দেশের ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে আমাদের সমাজের ব্যাংকিং চাহিদার কথা মাথায় রেখে।</p> <p>আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সুনির্দিষ্টভাবে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া অপরিহার্য, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের মধ্যকার সুনির্দিষ্ট সীমারেখা; ২. পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের কার্যক্রম পৃথকভাবে চিহ্নিত করা; ৩. ব্যাংকিং সংক্রান্ত আইনের সংশোধন; ৪. প্রযুক্তির মাধ্যমে সুশাসনের প্যারামিটার বা শর্তগুলো প্রতিপালন করা এবং ৫. নিয়ন্ত্রক সংস্থার এনফোর্সমেন্ট ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।          </p> <p>আমাদের দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো সীমারেখা নেই। এখানে পরিচালনা পর্ষদ, বিশেষ করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালকরা এমডি বা প্রধান নির্বাহীকে যা নির্দেশ দেন, তাঁরা সেগুলোই বাস্তবায়ন করে থাকেন, সেগুলো নিয়মের মধ্যে থাকুক বা নিয়মবহির্ভূত হোক। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অবস্থা এমন দাঁড়ায়, যেখানে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট টিম বা এমডি নির্দেশের জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই ব্যবস্থা ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বড় ধরনের অন্তরায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্টের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দিতে হবে। যেমন—ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি</p> <p>সম্পূর্ণরূপে ম্যানেজমেন্ট টিমের দায়িত্ব এবং তারাই এই দায়িত্ব পালন করবে। এখানে পরিচালনা পর্ষদ বা চেয়ারম্যান-পরিচালকদের সিদ্ধান্ত দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো রকম মতামত দেওয়ারও সুযোগ থাকবে না। এভাবেই ব্যাংক পরিচালনার সব কার্যক্রমে পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের মধ্যে সীমারেখা নিশ্চিত করে ফেলতে হবে।</p> <p>সুশাসন নিশ্চিত করার স্বার্থে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের কার্যক্রমকে সুনির্দিষ্টভাবে পৃথক করে দিতে হবে। আমাদের দেশে ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের কাজের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ফলে পরিচালনা পর্ষদের যা করার কথা না, তারা তা-ও করে। পক্ষান্তরে ম্যানেজমেন্ট টিমের যা করার কথা, তারা সেটি করে না। যেমন আমাদের দেশের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঋণ আবেদন মঞ্জুর করে, যা কোনো অবস্থায়ই পরিচালনা পর্ষদের কাজ নয়। পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের এ রকম এলোপাতাড়ি দায়িত্ব পালন কখনোই সুশাসনের পর্যায় পড়ে না। পরিচালনা পর্ষদ ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন এবং নির্দেশনা প্রদান করবে। যেমন ব্যাংকের ঋণদানের সর্বোচ্চ সীমা, ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা, কোন ধরনের গ্রাহকদের কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে, কোন কোন খাতে কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে প্রভৃতি উল্লেখ করে একটি ঋণ ঝুঁকি গাইডলাইন প্রদান করবে। আর ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট টিম এই গাইডলাইন এবং শর্ত মেনে ঋণ প্রদান করবে। এর কোনো রকম ব্যত্যয় ঘটলে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট টিম একক বা সমষ্টিগতভাবে দায়ী থাকবে। ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে কাগজে-কলমে সুশাসনের বিষয়গুলো লিখে রাখলে যে এর প্রয়োগ হবে, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।</p> <p>সুশাসনের শর্তগুলো প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রয়োগ করার উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবহৃত প্রযুক্তিতে সুশাসনের শর্তগুলো আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত থাকলে সেসব শর্ত মেনেই ব্যাংকের কাজ পরিচালনা করতে হবে। তখন চাইলেও এসব শর্তের ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে না। এর পাশাপাশি সুশাসনের অনেক বিষয় ব্যাংকসংক্রান্ত অনেক আইনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রচলিত আইনের সংশোধন করার প্রয়োজন হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সুশাসনের বিষয়গুলো যাতে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়াতে হবে।</p> <p>এ কথা অনস্বীকার্য যে দেশের ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করতে হলে ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। আবার এই সুশাসন নিশ্চিত করার কাজটি যে মোটেও সহজ নয়, সেটিও সবাইকে বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। তবে সঠিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারলে কাজটি যে অসম্ভব, তেমনও নয়। তাই ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কাজটি নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু অসম্ভব নয়।</p> <p><em>লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</em></p> <p><em>nironjankumar_roy@yahoo.com</em></p>