গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় (৭৬ কেজি ওজনের বোমা মামলা হিসেবে পরিচিত) ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহালের পূর্ণাঙ্গ রায় সোমবার প্রকাশিত হয়েছে। ৮৬ পৃষ্ঠার এ রায় লেখা হয়েছে বাংলায়। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত রায় দিলেও পূর্নাঙ্গ রায় লেখা সম্পন্ন হওয়ায় তা সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, বোমা দুটি বিস্ফোরিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সমাবেশস্থলে উপস্থিত লোকজন ও আশেপাশে বাড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে অনেক লোকের প্রাণহানীর সম্ভাবনা ছিল।
এক কিলোমিটারের মধ্যে ব্যাপক ধ্বংসলীলায় পরিণত হতো।
রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিল আসামিরা গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে সভা করে। সেখানে মুফতি হান্নাসহ ৫০ জন বক্তব্য দেয়। সেখানে তারা বলে যে, ইসলামী আলেমদের ওপর অত্যাচার বন্ধ না হলে শেখ হাসিনার পরিণতি তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়েও ভয়াবহ হবে।
ওই সভার বক্তব্যের সঙ্গে এই মামলার পরিস্কার যোগসুত্র পরিলক্ষিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আসামিরা রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মুগধার অফিসে সভা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বোমা পুতে রাখে। উদ্দেশ্য ছিল এই বোমা বিস্ফোরনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীদের হত্যা করা। রায়ে বলা হয়, ষড়যন্ত্রে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে সমগ্র জাতি আবারো একটি অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে নিমজ্জিত হতো। বোমা দুটি বিস্ফোরিত হলে এলাকাটি একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতো।
রায়ে বলা হয়েছে, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কতিপয় আসামি ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুর ও মুগদাপাড়া অফিসে মিটিং করেছিল। মিটিংয়ে তাদের মত প্রকাশ করে যে, আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামবিদ্বেষী এবং ভারতের দালাল হিসেবে ইসলাম ধ্বংসের কাজে লিপ্ত। সুতরাং তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে হবে হত্যার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু কি ধরনের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ তৎকালীন সরকার করেছিল ও ভারতের সাথে কি করেছিল তার কোনো বক্তব্য স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেনি। আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গভীর পর্যন্ত দেখা যায়, একটি অবাস্তব ও
ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে তাদের এ ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছিল। আসামীরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সরকারকে দোষারোপ করেছিল। রায়ে বলা হয়, দেশে মহিলা নেত্রী ইসলামসম্মত নয়, তারা তা প্রতিহত করবে-আসামিদের এই ধ্যান-ধারনা এবং শক্তি প্রদর্শন ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করেনা। কারন ইসলাম শান্তির ধর্ম। ষড়যন্ত্রকারীরা মূলত যাকে হত্যা করার জন্য এই ঘটনা অবতরণ করে তিনি তখন দেশের বৈধ সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। একটি বৈধ সরকার প্রধানকে তার সহযোগিতার প্রচেষ্টা এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য ক্ষতিকর তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরবর্তীতে দেশের নিরীহ স্বাধীনতাকামী উপলব্ধি করেছিল। এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণায় জাতির জন্য একটি কলঙ্কময় অধ্যায়।
রায়ে বলা হয়, এইরূপ ধ্বংসলীলা প্রায়শ আফগানিস্তানে সংঘটিত হয়ে থাকে। যেখানে গিয়ে মুফতি হান্নানসহ ষড়যন্ত্রকারীদের কেউ কেউ প্রশিক্ষন নিয়েছিল এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। সেজন্যই তালেবানী কায়দায় এ ধরনের ঘটনা সংঘটনের জন্য মুফতি হান্নানসহ অন্যান্য আসামীদের দায়িত্ব দিয়েছিল। রায়ে বলা হয়, আসামিরা এ দেশের প্রচলিত আইন মান্য করতে নারাজ। তারা জঙ্গী তৎপরতার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে চায়। কিন্তু তাদের এই ধরনের চিন্তা এসে প্রসূত আইন কখনো সমর্থন করেনা। তারা সকলেই জন্মগতভাবে দেশেরই নাগরিক। ষড়যন্ত্র করে এবং বোমা দুটি টুতে রাখার মধ্য দিয়ে যে অপরাধ তারা সংঘটিত করেছে তা ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং জঘন্য। দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গী তৎপরতার এদেশ থেকে বিলীন হওয়া প্রয়োজন।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলায় (৭৬ কেজি ওজনের বোমা মামলা হিসেবে পরিচিত) ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও একজনের ১৪ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে এবং একজনকে খালাস দিয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট। লিখিত রায়ে আদালত কোন আসামির কি ভূমিকা ছিল তা পূন্খানুপুন্খভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মামলার রায় ও আইনের সঙ্গে তার পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে।
যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে তারা হলেন- ওয়াসিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন ওরফে মারফত আলী, মো. রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে শিমন খান, মো. ইউসুফ ওরফে আবু মুসা হারুন ওরফে মোসাহাব মোড়ল, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বক্কর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই এবং মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আবু ওমর। এদের মধ্যে মো. ইউসুফ ওরফে আবু মুসা হারুন ওরফে মোসাহাব মোড়ল, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আবদুল হাই পলাতক।
এছাড়া মেহেদি হাসান ওরফে গাজী খান ওরফে আবদুল ওয়াদুদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আনিসুল ওরফে আনিস ও মো. মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমানকে দেওয়া ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। তবে কারাবন্দী এই দুইজনের
সাজাভোগ করা হয়ে গেলে তাদের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে। আর নিম্ন আদালতে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সরোয়ার হোসেন মিয়াকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশের একটি চায়ের দোকানের পেছন (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশ স্থলের পাশে) থেকে ২০০০ সালের ২০ জুলাই ৪০ কেজি ও ও ২৩ জুলাই ৭৬ কেজি ওজনের বোমা উদ্ধার করা হয়। এই বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের ১৮ এপ্রিল আবুল হোসেন খোকনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। এরপর ২০০৬ সালেল ১৯ নভেম্বর মূফতি আবদুল হান্নান তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ১৪ জনের নাম প্রকাশ করায় পুলিশ আরও আটজনকে আসামি করে ২০০৯ সালের ২৯ জুন সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। এ মামলায় বিচার শেষে ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট রায় দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২। এরপর ওইবছরের ২৪ আগষ্ট হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। নথি হাইকোর্টে পৌছার পর প্রধান বিচারপতির নির্দেশে জরুরী ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয় এবং তা বিচারের জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি। এছাড়া কারাবন্দি আসামিরা আপিল করে। উভয় আবেদনের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট রায় দেন।