<p style="text-align:justify">রাজনীতিতে সন্ত্রাসের মদদদাতা নিজাম উদ্দিন হাজারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনশক্তি রপ্তানিতেও হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর এক মাফিয়া। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে মাফিয়াচক্রের প্রধান হোতা ফেনী-২ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য প্রায় সোয়া শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">নিজের রিক্রুটিং এজেন্সি স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেডের (আরএল-১৫৫১) মাধ্যমে গত দেড় বছরে আট হাজার ৫৬৯ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠান তিনি। এর জন্য অভিবাসন ব্যয়, মেডিক্যাল খরচ ও বিমানের টিকিট খরচের বাইরে কর্মীপ্রতি এক লাখ ৪২ হাজার টাকা করে আদায় করেন, যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১২১ কোটি ৬৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।</p> <p style="text-align:justify">জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য ব্যবসায়ীদের কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (এফডব্লিউসিএমএস) অটো রোটেশনে চক্রের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নামে এসেছিল। আর এই চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন নিজাম হাজারী। এই চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে ছাড়পত্র ও ই-ভিসা করার বাধ্যবাধকতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজাম হাজারী বাড়তি ওই টাকা হাতিয়ে নেন।</p> <p style="text-align:justify">ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই আট হাজার ৫৬৯ জন কর্মীর মধ্যে মাত্র কয়েক শ কর্মী পাঠায় নিজাম হাজারীর রিক্রুটিং এজেন্সি স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড।</p> <p style="text-align:justify">তবে কর্মীর সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও কেউ বলছে ৪০০, কেউ বলছে ৫০০। তার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করে বাকি কর্মীদের মালয়েশিয়ায় পাঠান অন্য ব্যবসায়ীরা। স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিবন্ধন, ছাড়পত্র, সরকারি বিভিন্ন ফি বাবদ কর্মীপ্রতি এক লাখ ৫২ হাজার টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাকি এক লাখ ৪২ হাজার টাকা নিজাম হাজারীর স্নিগ্ধা ওভারসিজকে দেওয়া হয়।</p> <p style="text-align:justify">চক্রে প্রবেশের আগে এই পরিস্থিতি ছিল না</p> <p style="text-align:justify">বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন নিজাম হাজারী। লাইসেন্স নেওয়ার সাড়ে তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে যান। তবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো প্রতারকচক্রে যোগ দেওয়ার পর গত দেড় বছরে দেশটিতে আট হাজার ৫৬৯ জন কর্মী পাঠায় নিজাম হাজারীর রিক্রুটিং এজেন্সি স্নিগ্ধা ওভারসিজ। মালয়েশিয়ায় সর্বাধিক কর্মী পাঠানো এজেন্সির তালিকায় ৪ নম্বরে উঠে আসে স্নিগ্ধা ওভারসিজ। </p> <p style="text-align:justify">নিজাম হাজারীর সঙ্গে চক্রে ছিলেন আরো দুই সাবেক এমপি</p> <p style="text-align:justify">শুধু নিজাম হাজারী নন, এই চক্রে তাঁর সঙ্গে জড়িত ছিলেন আরো দুজন সাবেক সংসদ সদস্য। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১১৪৬) এবং ফেনী-৩ আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (আরএল-১৩২৭) এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই দুই সাবেক সংসদ সদস্য প্রায় একই পরিমাণ কর্মী পাঠানোর ছাড়পত্র পান।</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠানের নামে মালয়েশিয়া থেকে ৯ হাজার ৩৪৪ জন কর্মীর চাহিদাপত্র আসে। তবে বিএমইটি থেকে আট হাজার ৫৯২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। আর ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ৯ হাজার ৪৩১ কর্মীর নামে ছাড়পত্র পায়।</p> <p style="text-align:justify">বিএমইটির তথ্য মতে, এই তিন সাবেক সংসদ সদস্য ২৬ হাজার ৫৯২ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিজাম হাজারীর মতো ওই দুই সাবেক সংসদ সদস্যকেও কর্মীপ্রতি এক লাখ ৪২ হাজার টাকা করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সে হিসাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে এই তিনজন সাবেক সংসদ সদস্য হাতিয়ে নিয়েছেন ৩৭৭ কোটি ৬০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।</p> <p style="text-align:justify">জড়িত ছিলেন সাবেক এক সংসদ সদস্যের স্ত্রী-মেয়ে</p> <p style="text-align:justify">নিজাম হাজারীর এই চক্রে কুমিল্লার সাবেক সংসদ সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ (আরএল-১১৩) এবং তাঁর মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটাল এন্টারপ্রাইজও (আরএল-১৪৫৭) জড়িত ছিল। বিএমইটির তথ্য মতে, অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও অরবিটাল এন্টারপ্রাইজের নামে অন্তত ১১ হাজার কর্মীর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিক কতসংখ্যক কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছিলেন তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। চক্রের নিয়ন্ত্রকদের সহায়তা দিয়েছে এ দুটি এজেন্সি। এদের দুর্নীতি-অপকর্মে গত ৩১ মে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।</p> <p style="text-align:justify">২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর এজেন্সি বাছাইয়ের নামে মালয়েশিয়া সরকার তিন সংসদ সদস্যের প্রতিষ্ঠানসহ ২৫টি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেয়। এই এজেন্সিগুলো সিন্ডিকেট নামে পরিচিত। পরে যোগ হয় আরো ৭৫টি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি। সরকার ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা খরচ নির্ধারণ করলেও এজেন্সিগুলো কর্মীদের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।</p> <p style="text-align:justify">দুদকের অভিযোগেও উঠে আসে একই তথ্য</p> <p style="text-align:justify">মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গঠিত চক্রে প্রবেশ করে অবৈধ বাণিজ্য করা চার সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চক্রটি দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য করেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।</p> <p style="text-align:justify">দুদক সূত্র জানায়, সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি অভিযোগ অনুসন্ধান করবে। অভিযোগের বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে দুদক। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে চক্রের এই হোতাদের সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">দুদকের সারসংক্ষেপে বলা হয়, মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট বা চক্রে যোগ দেওয়ার পর দেড় বছরে প্রায় আট হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির মাধ্যমে। এ ছাড়া ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠালেও মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে আট হাজার ৫৯২ জন কর্মী। ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে পাঠিয়েছে সাত হাজার ৮৪৯ কর্মী। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন কর্মী। চক্র গঠনের সময় আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।</p> <p style="text-align:justify">দুদক বলছে, তিন সংসদ সদস্য ও একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এই খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠিয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৪টি দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো কর্মীপ্রতি অন্তত দেড় লাখ টাকা ‘চক্র ফি’ পেয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">দুদকের সারসংক্ষেপে আরো বলা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করা হয়েছে এই খাতে। সরকার নির্ধারিত ফিয়ের চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চক্র ফি নেওয়া হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি।</p>