২০০৭-০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভূমিকায় ত্রুটি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় সফররত সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ ড্যানিলোভিচ।
তিনি বলেছেন, ‘বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের এই সময়টায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। তবে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের সমর্থনে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।’
শনিবার (৮ মার্চ) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ঢাকার এক নতুন ভোর : গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের গতিশীলতা নেভিগেট করা’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে ছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ড্যানিলোভিচ।
বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন বিদেশি মিশনের কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, আন্তর্জাতিক, উন্নয়ন সংস্থা, নাগরিক সমাজের সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
সম্প্রতি রাজধানীর বারিধারার গার্ডেন গ্যালারি কসমসে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতি নিয়ে এক আলোচনায় নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন রাষ্ট্রদূত মাইলাম ও কূটনীতিক ড্যানিলোভিচ। সেখানে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করতে আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বের ভূমিকা এবং নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর আলোকপাত করেন তারা।
রাষ্ট্রদূত মাইলাম বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে সচেতন করার জন্য তার সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা একটি ছোট সংগঠন গঠন করি এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমেরিকান জনগণকে সচেতন করার জন্য কাজ করি। গত পাঁচ বছরে আমরা অর্থায়নের ব্যবস্থা করেছি এবং এই উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
এই সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে আসতে পেরে আমি আনন্দিত, বিশেষ করে গত দশ বছরে ভিসার কারণে আমি বাংলাদেশ সফর করতে পারিনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
আমি যে তথ্য আমার সরকারের কাছে পৌঁছে দেব, তা সঠিকভাবে সংগ্রহ করাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ। সেই সময় সরকার আমাকে তাদের পক্ষ নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল।’
গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরে জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতির ধারাবাহিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো শাসক দলের জবাবদিহির অভাব। গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে হলে একটি শক্তিশালী সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক অপরিহার্য।
স্বৈরাচারী শাসন কখনোই গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তথ্যযুদ্ধের সম্মুখীন। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মিডিয়াভিত্তিক বিভ্রান্তিমূলক তথ্য মোকাবেলায় কাজ করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাংলাদেশে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল সম্পর্কে দেওয়া বিবৃতিও বিভ্রান্তিকর, যা মূলত কিছু ব্যক্তি দ্বারা প্রচারিত, যারা দুই দেশের সম্পর্ক অস্থিতিশীল করতে চায়।’
ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম সম্পর্কিত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য নিছক মিথ্যা প্রচারণা, যা কিছু গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়াচ্ছে। সাবেক সরকার বিদেশি দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, যাতে তারা নিজেদের দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করতে পারে।’
ড্যানিলোভিচ আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে। স্বৈরাচারী শাসন কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূলে নয়।’
এ সময় তিনি ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির কিছু ভুলের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের সমর্থন নিয়ে সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তাদের অর্থায়ন নীতি এবং চলমান সংস্কারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।’
‘নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে এবং গত ১৭ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করে সুশাসন সংস্কারের জন্য ব্যবহার করা উচিত।’
জিল্লুর রহমান সুশাসন উন্নয়নকে উৎসাহিত করে—এমন উদ্যোগগুলোর গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেন এবং উল্লেখ করেন যে, এই ধরনের আলোচনা বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক রূপান্তরকে পরিচালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে সমর্থন এবং একটি টেকসই ও জবাবদিহিমূলক শাসন কাঠামো নিশ্চিত করতে ধারাবাহিক সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
আলোচনায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাও উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘প্রবাসী সম্প্রদায় প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে।’
উভয় বক্তাই গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘মিডিয়ার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। গণতান্ত্রিক আলোচনাকে শক্তিশালী করতে নাগরিক সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা উচিত।’
অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থী, রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন দুই কূটনীতিক।