<p>অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া উপস্থাপন করা হয়েছে। তিন পৃষ্ঠার খসড়া উপস্থাপনের পর রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে মতামত জানাতে বলা হয়েছে।</p> <p>বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে সর্বদলীয় এ বৈঠকে অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। </p> <p><strong>যা আছে ঘোষণাপত্রে</strong></p> <p>ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান, ১/১১ ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলের স্বরূপ বর্ণনা করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয় এবং নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার অভিপ্রায় জানানো হয়।</p> <p>এতে বলা হয়, যেহেতু এই ভূখণ্ডের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রাম করেছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল;</p> <p>যেহেতু এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের শাসকদের বঞ্চনা ও শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল,</p> <p>যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহণকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের মতামত ও প্রত্যাশাকে প্রতিফলন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ করার পথ সুগম করেছিল,</p> <p>যেহেতু পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন শাসনামলে রাষ্ট্র ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনির্মানে ব্যর্থতা ছিল এবং একারণে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি,</p> <p>যেহেতু ক্ষমতার সুষ্ঠ রদবদলের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে ষড়যন্ত্রমূলক ১/১১ বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ সুগম করা হয়;</p> <p>যেহেতু বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে,</p> <p>যেহেতু বিগত সরকারের আমলে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, মানবিক অধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি খুনি রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে,</p> <p>যেহেতু, উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনা পরিবারের নেতৃত্বে অবাধে লুটপাট, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে বিগত সরকার বাংলাদেশ ও এর সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে;</p> <p>যেহেতু, শেখ হাসিনার ফ্যাসিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় পনের বছর যাবত নিরন্তর সংগ্রাম করে জেলজুলুম, হামলা মামলা, গুম খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়;</p> <p>যেহেতু, বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষন ও খবরদারির বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে তপ্লিবাহক আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে,</p> <p>যেহেতু, ধারাবাহিক তিনটি নির্বাচনী প্রহসনের মধ্য দিয়ে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে,</p> <p>যেহেতু, ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী আমলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র ছাত্র ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারী চাকুরীতে দলীয় নিয়োগের একচেটিয়া ও কোটাভিত্তিক সুবিধা সৃষ্টি করে ছাত্র, চাকুরী প্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়,</p> <p>যেহেতু, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গণহত্যা চালানোর ফলশ্রুতিতে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়,</p> <p>যেহেতু, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রদের প্রণীত ৯ দফা দমনে সরকার আরো নির্মমতার আশ্রয় নেয় এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে, কারফিউ জাহ্রী করে এবং বররেইড করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে,</p> <p>যেহেতু, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে,</p> <p>যেহেতু, শেখ হাসিনার পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জনগণ ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং অবৈধ ও অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান,</p> <p>যেহেতু, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবেলায় গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের অভিপ্রায় ও পরম অভিব্যক্তি রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত;</p> <p>আমরা, ছাত্র-জনতা সেই অভিপ্রায়বলে আত্মমর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আদর্শ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করিলাম,</p> <p>আমরা, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার আহবান জানাচ্ছি এবং ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অখন্ডতা রক্ষার্থে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহবান জানালাম;</p> <p>আমরা সুশাসন ও সুষ্ঠ নির্বাচন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি তেয়াগ নিশ্চিত করার জন্য অন্তবর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।</p> <p>আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।</p> <p>আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম,</p> <p>আমরা এই ঘোষণা প্রদান করিলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যর অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে।</p> <p>আমার এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম যে এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।</p> <p>আমাদের এই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে।</p>