ওই বাসিন্দারাই এখন বলছেন, গত দেড় দশকে আরো কয়েক হাজার নতুন মানুষ যেমন এসেছে, তেমনই অনেকে আবার দক্ষিণ ভারত বা মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে চলে গেছে অর্থের বিনিময়ে ভারতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়ে। এরা মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকেই এসেছে এবং এখনো আসছে, জানালেন ওই এলাকার এক বাসিন্দা।
‘এই তো কদিন আগে আমাদের দোকানে এক ছেলে এসেছিল–এ বাংলাদেশে আমাদের পাশের গ্রামের মানুষ–তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম যে কী রে তুই এখনো ফেরত যাসনি! সে জুলাই মাস নাগাদ এসেছিল এখানে। তো জবাব দিল সে আর ফেরত যাবে না’, বলছিলেন ওই অঞ্চলের অনেক পুরনো এক বাসিন্দা। তিনি যে ব্যক্তির ব্যাপারে এই কথাগুলো বলছিলেন, তিনি ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান।
আবার আরেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কথা জানালেন ওই পুরনো বাসিন্দাই, যিনি সীমান্ত পার হতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন, আদালতেও তোলা হয়েছিল, কিন্তু ভারতে বসবাসকারী তার আত্মীয়-স্বজন বেশ অনেক হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন।
পূর্বপরিচিত ওই বাসিন্দা বিবিসিকে বলছিলেন, ‘তার এক আত্মীয় সেদিন বলল যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল! এরা আসলে মরিয়া হয়ে চলে আসে তো! জিজ্ঞাসা করলে বলে গ্রামে থাকলে খাব কী, ধরা পড়লে পড়ব, তখন দেখা যাবে।’
তার কথায়, ‘নিয়মিতই খবর বেরোচ্ছে দেখছি আমরা সবাই যে অমুক জায়গায় বাংলাদেশি ধরা পড়েছে। তবে এখানে কারো কোনো দুশ্চিন্তা তো দেখি না।’
‘উদ্বেগের প্রতিফলন’
গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের এটা নজরে আসছে যে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ার খবর কিছুটা বেশিই প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্র-টিভিতে। আবার এই সময়ের মধ্যেই জঙ্গি সন্দেহে বেশ কয়েকজন এবং বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে পাসপোর্ট ও অন্যান্য ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহেও গ্রেপ্তার হয়েছে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে। সেসব খবরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে সংবাদ চয়নের স্বাভাবিক নিয়মেই।
কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলির বেশির ভাগই এমন সব গ্রেপ্তারের, যাদের সঙ্গে অন্তত প্রাথমিকভাবে কোনো রকম জঙ্গি যোগ অথবা জাল পাসপোর্ট চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ পায়নি পুলিশ বা বিএসএফ।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আগস্ট মাসের পর থেকে এ ধরনের খবর প্রকাশের দিকে সম্পাদকরা নজর দিচ্ছেন সংগত কারণেই। কলকাতা ও শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত ‘এই সময়’ সংবাদপত্রের বিশেষ সংবাদদাতা সুরবেক বিশ্বাস এই মতামত পোষণকারী একজন সিনিয়র সংবাদকর্মী। তবে তিনি শুধু তার কাগজ নিয়ে কথা বলতে রাজি হলেন না। কারণ তিনি ওই সংবাদপত্রের মুখপাত্র নন।
তবে সামগ্রিকভাবে সংবাদপত্রে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশসংক্রান্ত খবর বেশি করে ছাপা হচ্ছে কি না, এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে এ দেশে এসেছেন অথবা কারো ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ভারতে থেকে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন–এ রকম খবর সব সময়েই পুলিশ আমাদের দেয়, আমরাও প্রকাশ করে থাকি। বাংলাদেশের সব সরকারের আমলেই এটা হয়ে এসেছে। নতুন কিছু না।’
‘তবে এখন আগস্টের পর থেকে প্রেক্ষিতটা বদলেছে। সে দেশে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সেখানকার সংবাদমাধ্যমেই খবর বেরোচ্ছে যে, সন্ত্রাসী কাজকর্মের অভিযোগে জেলে বন্দি ছিলেন, এমন অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে রকম কেউ সীমান্তবর্তী আমাদের রাজ্য বা আসামে কিংবা মেঘালয়ে ঢুকে পড়ছে কি না, তার ওপরে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো তো নজর রাখবেই। সে কারণেই হয়তো অনুপ্রবেশকারীরা ধরাও পড়ছে কিছুটা বেশি, খবরও হচ্ছে বেশি," বলছিলেন সুরবেক বিশ্বাস।
তিনি আরো বলছিলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়া মানেই বাংলাদেশকে ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। ওই ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিরা, যারা সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বন্দি ছিলেন অথবা অন্য কোনো সাধারণ অপরাধী ঢুকে পড়ছে কি না, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা উদ্বেগ কাজ করছে, তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে প্রকাশিত খবরেও।’
সমস্যা পুরনো, নজর পড়েছে এখন
বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের সমস্যা নতুন নয়। দুই দেশের সীমান্তের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও এই সমস্যা বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হওয়ার আগে থেকেই রয়েছে। বিএসএফ জানাচ্ছে যে এখনও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বহু জায়গাতেই নেই।
"কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের নজর এতদিন পশ্চিম সীমান্তেই পড়েছিল। এখন পাকিস্তান নিয়ে উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে। তাই হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে জাতীয় স্তরে খবর হচ্ছে বেশি করে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকেরা অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, কাঁটাতারহীন সীমান্তের খবর বহু বছর ধরে করে আসছে," বলছিলেন পুণের এমআইটি এডিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সম্বিত পাল।
তিনি জাতীয়-স্তরের গণমাধ্যমে সংবাদকর্মী হিসাবেও কাজ করেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘একটা সময়ে অনুপ্রবেশের খবর প্রকাশ করাতে গেলে আমাদের প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হতো। সম্পাদকরা গুরুত্বই দিতে চাইতেন না এ ধরনের খবরে।’
‘তবে বাংলা গণমাধ্যমে টুকরো খবর হিসেবে যেত এ ধরনের সংবাদ। কিন্তু জাতীয় স্তরের মিডিয়া এই নিয়ে উৎসাহ দেখায়নি। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। তার জন্য অবশ্য ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও দায়ী’, বলছিলেন মি. পাল।
তিনি বলেন, ‘দিল্লির নির্বাচনেও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বড় ইস্যু হচ্ছে। বলিউড অভিনেতা সাইফ আলী খানের উপর আক্রমণের ঘটনাতেও মূল অভিযুক্তকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই খবরের একটি অন্য প্রভাব রয়েছে।’
ফলে গণমাধ্যমগুলো এখন এ ধরনের খবর গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।