প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা এবং ‘ডেভিল হান্ট’

  • অদিতি করিম
শেয়ার
প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা এবং ‘ডেভিল হান্ট’
সংগৃহীত ছবি

৫ ফেব্রুয়ারি ছিল স্বৈরাচার পতনের ছয় মাস পূর্তি। ওই দিন আকস্মিকভাবে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন। তার এই সিদ্ধান্ত মুহূর্তে ছাত্র-জনতা এবং জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ‘বুলডোজার অভিযান’।

ঘোষণা করা হয়, ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। রাত ৯টায় অনলাইনে শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। রাত ৯টার আগেই ছাত্র-জনতা জমায়েত হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার কর্মসূচিতে। ৯টায় শেখ হাসিনার ভাষণের আগেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ছাত্র-জনতা।
পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সব ক্ষোভ যেন আঁচড়ে পড়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। ভাঙাচোরা এবং আগুনে পোড়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া হয়। গভীর রাতে আসে বুলডোজার। রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ৩২ নম্বরের বাড়িটি।
এখানেই ঘটনার শেষ হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পরপর যেভাবে বিভিন্ন স্থাপনা এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর বাসায় আক্রমণ করা হয়েছিল, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাসায় আক্রমণ চালানো হয় আবারও। এর মধ্যে অনেক সুযোগসন্ধানী লুটপাটেও মেতে ওঠেন। তারা বিভিন্ন অপরাধ কর্মে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। অতি উৎসাহী কেউ কেউ সংখ্যালঘুদের হুমকি দেন।
সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সারা দেশে ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি জুড়ে চলে এই তান্ডব।

গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে তিন দিন কোনো সরকার ছিল না। পুলিশ বাহিনী কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। কাজেই সে সময় সারা দেশে যে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং নৈরাজ্য হয়েছিল তার একটি ব্যাখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। সরকার বিভিন্ন অবস্থায় একটি স্বৈরাচারের পতনের পর জনরোষ এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতেই পারে। কিন্তু এই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ বাহিনী ঠিকঠাক মতো কাজ করছে না। জনজীবনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটেনি। খুন, রাহাজানি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সীমাহীন অবনতি একটি নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক এরকম সময়ে ‘বুলডোজার অভিযানের’ নামে সারা দেশে যে তান্ডব এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, তাতে কার লাভ হলো? এর ফলে পতিত স্বৈরাচার এবং তার সহযোগী গোষ্ঠী প্রতিবিপ্লবের সুযোগ পেল। এরকম নিয়ন্ত্রণহীন কাজের ফলে ‘হিতে বিপরীত’ ফল হতে পারে, তার প্রমাণ ঘটল গাজীপুরে। নৈরাজ্যের সুযোগ নিল পরাজিত শক্তি। তারা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই ঘটনার পর সারা দেশে শুরু হয়েছে ‘ডেভিল হান্ট’ অপারেশন। ‘ডেভিল হান্ট’ কি পারবে সত্যিকারের ডেভিলদের আইনের আওতায় আনতে? অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট কি পারবে প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে? দুই দিন সারা দেশে নিয়ন্ত্রণহীন তান্ডবের পর প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে একটি দায়িত্বশীল বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির নেতা এবং অন্য কারও সম্পত্তিতে হামলা না চালানোর জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সম্পত্তি এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আর কোনো হামলা হবে না তা নিশ্চিত করা হবে। যে সব ব্যক্তি হামলা চালিয়েছে তাদের নিবৃত্ত হওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের ঠিক কিছুক্ষণ পরেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। এই বৈঠকে লন্ডন থেকে যুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া। এই বৈঠকে দেশজুড়ে চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির বিএনপির সমর্থন করে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পর এ ধরনের ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। এটা নির্বাচন প্রলম্বিত করার ষড়যন্ত্র। বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তায়। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে বলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়। ঠিক একই সময়ে দেশের ২৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তাঁরা বিবৃতিতে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনার পরবর্তীতে একটি বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপরই অনেকাংশে বর্তায়। এসব ঘটনার বিচার দাবি করেন বুদ্ধিজীবীরা।

প্রশ্ন উঠেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পর যখন দেশ একটি নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তখন সারা দেশে এরকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে কার লাভ হলো? এ ধরনের ঘটনা দেশকে কোন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে? এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ভারতে বসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করছেন। তিনি এবং তার লুটেরা বাহিনী সীমাহীন লুটপাট এবং দুর্নীতি করে বিদেশে আরাম-আয়েশের জীবনযাপন করছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করে তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। নিরীহ কর্মীদের উসকে দিচ্ছেন। একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের কোনো শীর্ষ নেতাই এখন দেশে নেই। যারা দেশে ছিলেন তারা প্রায় সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এরকম পরিস্থিতিতে নিজের আত্মসমালোচনা এবং আত্মশুদ্ধি ছাড়া আওয়ামী লীগ যেভাবে আবার নতুন করে দেশে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। বোঝাই যায়, আওয়ামী লীগ বাস্তবতা থেকে বহুদূরে। গুজব আর অপপ্রচারে ভর করে দেশে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে মরিয়া। এজন্য তারা যে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে সেই পাতা ফাঁদে কি তাহলে বুঝে না বুঝে পা দিচ্ছে অতি উৎসাহীরা?

আমরা যদি একটু নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করি, ৫ ফেব্রুয়ারি বুলডোজারের এই কর্মসূচি এবং সারা দেশে বহু নৈরাজ্য ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ তান্ডবের ফলে কার লাভ হলো? আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মীর বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই দেশে নেই। অধিকাংশ বাড়ি ৫ আগস্টে আক্রান্ত হয়েছিল। এবার দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হলো। শুধু তোফায়েল আহমেদসহ দু’একজনের বাড়ি নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে। এ রকম আক্রমণে যাদের বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে, তাদের খুব একটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ৫ আগস্টেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরও ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নতুন করে ‘বুলডোজার কর্মসূচি’ দেওয়ার অর্থ কী? এর ফলে সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছে, যারা গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের একদলীয় ফ্যাসিস্ট শাসনে বিরক্ত ছিলেন, যারা আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, যারা আওয়ামী লীগকে রীতিমতো ঘৃণা করতেন, তাঁরাও বিরক্ত হয়েছেন। তাঁরাও এই নৈরাজ্য পছন্দ করেননি। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ যাঁরা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অকুতোভয় সৈনিকের মতো রাস্তায় নেমে এসেছিলেন এবং স্বৈরাচারের পতনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তারা এই ঘটনায় বিরক্ত, হতবাক।

৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বিষয় প্রচার করার চেষ্টা করছে, তা হলো বাংলাদেশে জঙ্গিরা সরকার দখল করেছে। দেশে এখন জঙ্গিদের কর্তৃত্ব চলছে। জঙ্গিরাই দেশে অঘোষিত নিয়ন্ত্রক। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ধরনের প্রচারণা একটু খোঁজ নিলেই চোখে পড়ে। ভারতের কিছু কিছু গণমাধ্যমও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে বলে নিরন্তর প্রচারণা করছে। এই বাস্তবতায় যখন ৫ ফেব্রুয়ারিতে এ ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হলো তখন এই বার্তাগুলোই শক্ত ভিত্তি পেল। ৫ ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে ৩২ নম্বরে বুলডোজার আক্রমণ করা হয়েছে, যেভাবে সারা দেশে হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে তাতে আওয়ামী লীগের প্রচারণারই একটি শক্ত ভিত্তি পেল কিনা ভেবে দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা- গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে একটি বিপুল জনপ্রিয়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সবার আস্থার প্রতীক হিসেবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পেয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি যে ঘটনা ঘটল তাতে সরকারের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমনিতেই নাজুক। তারপরও পুলিশ, সেনা বাহিনীর উপস্থিতিতে যেভাবে দিনভর তান্ডব চলল এবং পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল, তাতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হলো। তারা দেখল, কিছু লোক জড়ো হয়ে যে কোনো জায়গায় হামলা-ভাঙচুর করা করা যায়। এই ধারায় যদি প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসা প্রবণতায় উন্মাদ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ব্যক্তিগত ক্ষোভ এবং আক্রোশ মেটানোর জন্য একে অন্যের সম্পদ ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠে; তাহলে এই সরকার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। যার একঝলক দেখলাম গাজীপুরে।

এখন যে কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন হঠকারিতা প্রতিবিপ্লবের পথ উন্মুক্ত করবে। ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারির নৈরাজ্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি করল গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে। দেশকে দ্রুত নির্বাচন করে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়াটা এই সরকারের প্রধান কাজ। এমনিতেই কাজটি করতে গিয়ে নানারকম সমস্যা এবং দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। তার মধ্যে এ ঘটনা গণতন্ত্রের পথকেই বন্ধুর করে তুলল বলে অনেকেই মনে করেন। সবচেয়ে বড় কথা, এই ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন উঠল সরকারের দক্ষতা নিয়ে। এটি সরকারের জন্য বড় ধরনের একটি নেতিবাচক দিক বলে আমি মনে করি। এই নৈরাজ্য থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো লাভ হয়নি। জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতারও লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে আওয়ামী লীগের। এই বোধদয় আমাদের যত দ্রুত হবে, তত আমাদের মঙ্গল।

যেকোনো বিপ্লবের পর একটি প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা হয়। কোথাও সফল হয়, কোথাও ব্যর্থ হয়। আরব বসন্ত সফল হয়নি। ২০১০ সালে তিউনিশিয়ার গণবিপ্লবের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তা ছড়িয়ে পড়ে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ বহু দেশে। কিন্তু এসব অনেক দেশেই বিপ্লবের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মিসরে ঘটে প্রতিবিপ্লব। প্রতিবিপ্লব সফল হলে বিপ্লবের নায়কদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। গলাটিপে হত্যা করা হয় বিপ্লবের স্বপ্ন। তাই অনেকে বলেন, বিপ্লব সংঘটনের চেয়ে প্রতিবিপ্লব ঠেকানো, বিপ্লবকে সংহত করা বেশি চ্যালেঞ্জিং। ৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ঘটনাবলী দেখে আমার মনে হয়েছে, আমরা কি একটি প্রতিবিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে? বাংলাদেশে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি বিপ্লব। এটি কেবল একটি সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না, ছিল একটি ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এটি ছিল রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা, একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে জীবন দিয়েছিল হাজারো ছাত্র তরুণ। কিন্তু বিপ্লবের ছয় মাস পর অজানা শঙ্কায় দেশ। চারপাশে প্রতিদিন নানা আন্দোলন। চারপাশে নানা গুঞ্জন, গুজব। এর মধ্যেই পরাজিত শক্তি সংঘটিত হচ্ছে, মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নতুন করে। সাধারণ মানুষ অস্থির, রীতিমতো দিশাহারা। দেশে কি একটি প্রতিবিপ্লব আসন্ন? অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ কি পারবে ডেভিল বধ করতে?

লেখক: নাট্যকার ও কলাম লেখক

ইমেইল: auditekarim@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

চাপে চ্যাপটা শিল্পে খাঁড়ার ঘা

    মোস্তফা কামাল
শেয়ার
চাপে চ্যাপটা শিল্পে খাঁড়ার ঘা

হোক রুগ্ণদশা, পুঁজিপাট্টা ঠিক থাক না থাক, ঈদে কর্মচারীদের বেতন-বোনাস লাগবেই। শিল্পকারখানার মালিকদের তা শোধ করতেই হবে। এবার তাঁদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ একই সময়ে দুই মাসের (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) মজুরি এবং ঈদ বোনাস নিয়ে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর আশঙ্কা এ বছর ৫০-৬০টি কারখানার মালিক মজুরি পরিশোধ নিয়ে আচ্ছা ঝামেলা পোহাচ্ছেন।

শ্রমিকনেতাদের কাছে এ-সংক্রান্ত আরও আপডেট তথ্য থাকলেও মাঠ গরম করার কাজে কোনো ছাড় দিতে নারাজ তাঁরা। এরই মধ্যে ২০ রমজানের মধ্যে বোনাস ও ঈদের ছুটি এবং এর আগে ওভারটাইমের পাওনা টাকা পরিশোধের বেদম চাপ তৈরির ক্যারিশমা দেখিয়েছেন তাঁরা।

এ প্রবণতা বেশি তৈরি পোশাকশিল্পে। হালবাস্তবতা জানার পরও শ্রমিকনেতাদের দাবি, এটি মালিকদের চাতুরি-কারসাজি।

উৎপাদন ব্যয়, বৈশ্বিক ক্রেতার চাহিদা এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকলেও উৎসবের সময় এলে শ্রমিকদের জিম্মি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন শিল্পমালিকরা। কর্মসংস্থানের কথা বলে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা হাতান। মাঠকাঁপানো না হলেও শ্রমিকদের খ্যাপাতে যথেষ্ট তাঁদের এ যুক্তি। তাঁরাও জানেন, রাজনৈতিক ঘটনার অনিবার্যতায় বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকগুলোতে প্রোডাকশন তলানিতে নেমে গেছে, তবে তা বিষয় নয় তাঁদের কাছে।
বিবেচ্যও নয়। ছোট বড় সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই ঈদে বেতন-বোনাস দেওয়ার বাধ্যবাধকতা অবধারিত। গার্মেন্ট, নির্মাণসহ বিভিন্ন শিল্পে যার যার জায়গায় সমস্যার সমাধানে দিশাহারা অবস্থা। ঈদ সেখানে একটা ধাক্কা দিয়েছে।

ঈদের আগে চলতি মার্চ মাসের বেতন ও বোনাসের চাপ থাকা স্বাভাবিক।

শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ২০ রোজার মধ্যে পুরো মাসের বেতন, ২৫ রোজার মধ্যে বোনাস পরিশোধের দাবি তোলা বেতন-বোনাসহয়েছে। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিকরা নানা ইস্যুতে তেজি হয়ে উঠছেন। আর তেজি হওয়া মানে কাজ ক্ষান্ত রেখে রাস্তা আটকে কিছুক্ষণ হট্টগোল বাধানো। ততক্ষণে সড়ক-মহাসড়কে যে অবস্থা তৈরি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের পক্ষে উপলব্ধি অসম্ভব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ না করে বুঝিয়েশুনিয়ে তাঁদের কাজে ফেরাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করুক, গন্ডগোল পাকুক- সেই অপেক্ষা মহলবিশেষের। সরকার সেই সুযোগটা দিতে চায় না।

ঈদের আগে অস্থিরতা সৃষ্টির একটি আয়োজন সম্পর্কে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক-বিনিয়োগকারীরাও ওয়াকিবহাল। তাঁরা এ ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে শক্ত পদক্ষেপ চান। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত সেই পথে যেতে নারাজ। বিষয়টির সঙ্গে টাকার প্রশ্ন। শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন টাকার জন্য। টাকা দিলে আন্দোলন করবে না- তা সরকার জানে। বিজনেস কমিউনিটিও জানে। তারা ঈদের আগে বেতন-বোনাসের চাপে চ্যাপটাা থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে নগদ সহায়তা চেয়েছে। সরকারের দেওয়া প্রণোদনার বড় অঙ্ক এখনো আটকে রয়েছে। সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে চুপ থাকার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ সংকটে ব্যাংকগুলোকেও পাশে চান ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেশির ভাগ শিল্পকারখানা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কমে গেছে উৎপাদন। সরকারি প্রকল্পগুলোও স্থবির হয়ে পড়ায় আয়-রোজগার কমে গেছে এসব প্রকল্পে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্তদের। বাঘা বাঘারা পালিয়েছেন রাজনৈতিক কারণে। তাঁদের মাধ্যমে টাকার যে ঘূর্ণি ঘটত সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তৈরি পোশাকশিল্প কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও তাঁরা চ্যাপটা হয়ে চলছেন কাঁচামাল আমদানি ও জ্বালানিসংকটে। পোশাকশিল্পে অর্ডার বাড়লেও কিছু কারখানা লসে ডেলিভারি দিচ্ছে এমন তথ্য জানান দিচ্ছে বায়ারদের কাছে। এতে বিভিন্ন কারখানায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এটিও একধরনের অসুস্থতা। যে পরিমাণ রপ্তানি হয়, সেই পরিমাণে টাকা আসছে না। তাই লাভের মার্জিন ঠিক থাকছে না। যন্ত্রণা সব দিকেই। কারখানা চালু রাখতে কর্মী দরকার। জ্বালানি বিশেষ করে গ্যাসও দরকার। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে প্রতি ইউনিট ১১ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এর পরও গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। গ্যাসসংকটে ডিজেল দিয়ে ডায়িং কারখানায় উৎপাদন করা গেলেও স্ট্যান্ডার্ড ও ড্রাক করা যাচ্ছে না। আর ফ্যাব্রিকস ডায়িং করাতে না পেরে সুইং, ফিনিশিং, নিটিং অ্যান্ড প্রিন্টিং সেকশনের শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। ভারতের আগ্রাসন ও সুতা অ্যান্টিডাম্পিং করার ফলে চলতি বছর রোজার ঈদে স্থানীয় বাজারে প্রায় দেড় শ কোটি ডলারের পণ্য অবিক্রীত থাকবে। ভারত সরকার তাদের উদ্যোক্তাদের সুতা উৎপাদনে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে ৩০ শতাংশ বেশি সুতা আমদানি করেছেন। এতে ডাম্পিং হচ্ছে দেশীয় সুতা। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। এই খাতের প্রায় দুই লাখ শ্রমিকের নিয়মিত মজুরিই পরিশোধ করা যাচ্ছে না। কেবল প্রবৃদ্ধি নয়, যেকোনো খাতের গতিশীলতা ধরে রাখতে শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। নতুন বিনিয়োগ পরের ব্যাপার।

বিদ্যমান বিনিয়োগই হুমকিতে পড়লে আর ভরসা থাকে না। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর। প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। হোক তা ব্যক্তি খাতে বা রাষ্ট্রীয় খাতে। সাম্প্রতিক বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট বড় মাঝারি সব ব্যবসায়ীই কমবেশি আক্রান্ত। দেশের গোটা অর্থনীতিই নানা চ্যালেঞ্জে খাবি খাচ্ছে। ছোট-বড় সব ব্যবসাই বাড়তি ঝুঁকিতে। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ- সবকিছুই স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। স্বাভাবিকতা ফেরাতে ঋণের সুদহার কমানো, ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা, ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাসহ একগুচ্ছ দাবিতে অনেক দিন থেকে মাথা ঠুঁকছেন ব্যবসায়ীরা। গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চয়তাও পায়নি। ঋণের সুদের হার বাড়ানোর ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের খরচ বেড়ে গেছে। এতে পণ্যের দামও বাড়ছে। ফলে বিক্রি কমে গেছে। এখনো এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে চাচ্ছে না। এলসি খোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হচ্ছে। দেশের বাইরে ব্যবসায়িক কার্যালয় স্থাপন করতে গেলেও কঠোরতা। বিদ্যমান নীতিমালা কিছুটা হলেও শিথিল করা দরকার। এতে আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগ বাড়বে। এ ছাড়া দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়বদ্ধতা বাড়ানোর বিষয় রয়েছে।

দেশের টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, প্লাস্টিক এক্সেসরিসসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা সেদিন কিছুটা  নির্ভয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের কিছু যন্ত্রণার কথা বলেছেন। বৈঠকে তাঁরা আমদানি-রপ্তানিতে নানা প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি ভ্যাট-ট্যাক্স ও আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর প্রস্তাব দেন। বন্ড জটিলতা, চোরাচালানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কাস্টমসের হয়রানি বন্ধ করার দাবিও জানান। জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অনিয়মের দুরারোগ্য ব্যাধি এত সহজে দূর হবে না। তবে কাজ উদ্ধারে ব্যবসায়ীদের এনবিআরের কর্মকর্তাদের অন্যায় আবদার না মানার পরামর্শ দেন তিনি। একপর্যায়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ না দিয়ে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। দুর্নীতির প্রমাণসহ কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লে তদন্ত ছাড়াই এনবিআর কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার হুঁশিয়ারিও দেন। ব্যবসায়ীরা এনবিআর বা কোনো দপ্তরের কর্মকর্তাকে ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে কেন? এটা তাঁদের কাজ নয়। তাঁরা চায় স্বস্তিতে-আনডিস্টার্বে বিনিয়োগ করতে। আর রাষ্ট্রর কাছে তাঁদের চাওয়া সেই বিনিয়োগ তথা পুঁজির নিশ্চয়তা।

বিনিয়োগ-ব্যবসা মিলিয়ে অর্থনীতির শিরায় রক্তপ্রবাহ না থাকলে রাজনীতি-গণতন্ত্র গতিময়তা পায় না। যুগে যুগে তা প্রমাণের বাকি নেই। আধুনিক বিশ্বে অর্থনীতি-গণতন্ত্র দুই চাকার সাইকেলের মতো। যেকোনো এক চাকায় সাইকেল চালানো যায় না। দেশ অর্থনীতিবান্ধব না হলে রাজনীতি গণতন্ত্রবান্ধব হবে না। কেবল বাংলাদেশ নয়, এটি গোটা বিশ্বের বাস্তবতা। নির্বাচনসহ চলমান রাজনীতি নিয়ে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের কারণ খোঁজা তাই জরুরি। এরপরই না বাদবাকি অন্য কিছু। ভঙ্গুর আর্থিক খাত, বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে এমনিতে বিপাকে অন্তর্বর্তী সরকার। তার ওপর রয়েছে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান। ছোট-বড় মিলিয়ে বিজনেস কমিউনিটিতে এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। সরকার ও রাজনৈতিক মহলে নিশ্চয়ই এ বিশ্লেষণের মাত্রা যোগ আরও বেশি। বিশেষ করে অর্থযোগে চাপে চ্যাপটা হওয়ার লক্ষণ দেশ, রাজনীতি, গণতন্ত্রের জন্য আরও বেশি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
 

মন্তব্য

আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে সেনাবাহিনীর অবদান

কর্নেল এ এস এম নাছের, পিএসসি, জি+
কর্নেল এ এস এম নাছের, পিএসসি, জি+
শেয়ার
আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে সেনাবাহিনীর অবদান

‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’— এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কাজের গুণগত ও কারিগরি মান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ওপর অর্পিত প্রকল্পগুলো বরাদ্দকৃত বাজেটের মধ্যে এবং প্রাক্কলিত সময়ের আগেই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয় বিধায় দেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে সেনা সদস্যদের সম্পৃক্ততার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

শিক্ষার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুল, কলেজ (সাধারণ, চিকিৎসা ও ক্যাডেট) ও বিশ্ববিদ্যালয় (সাধারণ, কারিগরি ও বিশেষ) প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশকে আলোকিত করতে অবদান রাখছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৪৪টি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ এবং ১৯টি ইংলিশ মিডিয়াম/ভার্সনসহ সারা দেশে ১২টি ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও ক্যাডেটরা জাতীয় পরীক্ষাগুলোতে ঈর্ষণীয় সাফল্যের পাশাপাশি চৌকস ও নেতৃত্বদানে পারদর্শী দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠছে।

উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চার জন্য মিরপুর সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস। প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং কুমিল্লা, সৈয়দপুর ও কাদিরাবাদ সেনানিবাসে তিনটি আর্মি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পেশায় দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করছে।

এ ছাড়া ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে শিক্ষা প্রসারে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাভার ও সিলেট সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেনা পরিবার কল্যাণ সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ১০টি বিশেষায়িত স্কুল (প্রয়াস) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। 

বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় আইকনিক মেগাপ্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণ চলাকালে সেনাবাহিনী জাজিরা ও মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, নদীশাসন ও নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি ব্রিজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ সার্ভিস এরিয়ার কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

বর্তমানে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য সুপারভিশন পরামর্শক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে সেনাবাহিনী। পদ্মা রেলওয়ে সেতু বাস্তবায়নের পর দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। 

বর্তমানে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর উন্নয়নমূলক কাজ, ব্রিজ, ওভারব্রিজ, নদী ড্রেজিং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর মহিপাল ফ্লাইওভার, ঢাকা শহরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, বনানী লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ৩০০ ফিট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, ১০০ ফিট খাল খনন প্রকল্প, মেঘনা-গোমতী ব্রিজের মেরামতকাজ, পদ্মা নদী ড্রেজিং প্রকল্প, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা এলাকার নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক উন্নয়ন নির্মাণের কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এ সবই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাস্তবায়ন করা জাতি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম উদাহরণ।

 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় বিভিন্ন সড়ক নির্মাণ করার কারণে পাহাড়ি জনপদে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, বাজার অর্থনীতি ও বিপণন সফলতার মুখ দেখেছে, স্বাস্থ্যসেবায় সূচক উন্নত হয়েছে, চাষাবাদ বেড়েছে, জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে এবং কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার কমেছে। সর্বোপরি পার্বত্য তিন জেলায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ে এসেছে উন্নয়ন ও প্রাণের স্পন্দন। বর্তমানে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের দুর্গম সীমান্ত এলাকায় এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি যোগাযোগব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য-প্রযুক্তি, পর্যটন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র মেগাপ্রজেক্টটি হাতে নেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ, রক্ষণাবেক্ষণ, পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহন এবং প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে দেশের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। সেনাবাহিনী অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র তথা ভোটার আইডি কার্ড, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এবং মেশিন রিডেবল ভিসা তৈরির ব্যাপারে সরকারের গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেশে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রকল্পটি চলমান। প্রজেক্টটি সফল হলে জ্বালানি তেলের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। 

২০১৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রকল্পটি সেনা সদস্যরা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে চট্টগ্রাম নগরবাসী মুক্তি পাবে। উপরোক্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ দেশের উন্নয়নে অগ্রগামী ভূমিকা রাখারই উদাহরণ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, দেশের জনগণের জান-মাল ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধানের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে দেশের ৬২টি জেলায় সেনা সদস্যরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

অপারেশন উত্তরণের আওতায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পাশাপাশি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে পাহাড়ি জনপদ একটি উন্নত জীবনযাত্রার দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী কক্সবাজার জেলায় মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকায় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, চিকিত্সাসেবাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করে দেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে।

জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শান্তিরক্ষী পরিবারের সদস্য হন। আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, কর্মদক্ষতা, মানবিক মনোভাব ও পেশাদারির মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন সম্মান ও মর্যাদা। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করে শুধু সেসব দেশে শান্তি ফিরিয়েই আনেননি, আর্থ-সামজিক ক্ষেত্রসহ পুনর্বাসনক্ষেত্রে এনেছেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অত্যন্ত উজ্জ্বল করেছে। বিশ্বশান্তি রক্ষায় অদ্যাবধি সেনাবাহিনীর ১২৫ জন সদস্য প্রাণ দিয়েছেন।

চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সিএমএইচ ঢাকা সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের (ক্যান্সার সেন্টার, বার্ন ইউনিট, ফার্টিলিটি সেন্টার) ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা সিএমএইচ থেকে বেসামরিক ব্যক্তিদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এবং চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ (এএফএমসি) এবং পাঁচটি আর্মি মেডিক্যাল কলেজ বগুড়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও রংপুর সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সেবিকাদের ঘাটতির বিষয় বিবেচনায় এনে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা খাতে সুদক্ষ ও মানসম্পন্ন নার্স তৈরির জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাঁচটি আর্মি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করার প্রশাসনিক অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়েছে এবং এরই মধ্যে দুটি আর্মি নার্সিং কলেজে এই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। 

বর্তমানে বিশ্ব বাস্তবতাকে অনুধাবন করে নারীশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী অফিসার এবং পরবর্তী সময়ে নারী সৈনিক নিয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নারীর সামর্থ্য ও যোগ্যতাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বর্তমানে সেনাবাহিনীতে নারী অফিসাররা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন। এ ছাড়া আর্মি মেডিক্যাল কোরের নারী অফিসাররা অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। এর ফলে একদিকে যেমন নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন, অন্যদিকে তাঁরা তাঁদের মেধা ও প্রতিভা দিয়ে সামরিক বাহিনীর চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করছেন।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আর্তমানবতার সেবায় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমি/পাহাড়/ভবন ধস, মহামারি ইত্যাদি বিভিন্ন দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধকল্পে সেনাবাহিনী যেভাবে আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তা দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারি চলাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা ও বিভিন্ন টহলদল সারা দেশে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, চিকিত্সাসামগ্রী বিতরণ, লকডাউন নিশ্চিতকরণ, কোয়ারেন্টিন সুবিধা স্থাপন, কভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সা পরিচালনা করেছে। 

২০২৪ সালে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনা সদস্যরা আটকে পড়া বন্যাকবলিত মানুষের উদ্ধারকাজ পরিচালনা, ত্রাণ কার্যক্রম, খাদ্য ও পানি বিতরণ, চিকিত্সাসেবা পরিচালনা, বাঁধ নির্মাণে সহায়তা এবং পুনর্বাসনের মতো মানবিক সহায়তা প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ও অতি সম্প্রতি আম্ফানের সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকা হয়েছে জনগণের কাছে প্রশংসিত। ২০১৭ সালের জুন মাসে পাহাড়ধসে পার্বত্য তিন জেলার যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সেনাবাহিনী কঠোর পরিশ্রম করে যোগাযোগব্যবস্থা পুনরুদ্ধার অভিযান, পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার, পানি ও চিকিত্সাসেবা প্রদান করে জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে জাতীয় পরিমণ্ডলে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশ যেমন— মায়ানমার, চীন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, হাইতি, তুরস্ক, মিসর ও মালদ্বীপে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকবেলায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবেলা করে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রমে পার্বত্য তিন জেলায় যোগাযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং রাত্রিযাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় সৌন্দর্যপিপাসু হাজারো মানুষ এখন পার্বত্য তিন জেলায় বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নির্মিত নীলগিরি, সাজেক, থানচি, রাঙামাটি ও কাপ্তাই লেকে রিসোর্ট এবং ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ অতি গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভটি পর্যটনশিল্প বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। রেমাক্রী, বড়পাথর, নাফাখুম জলপ্রপাত, শুভলং জলপ্রপাত, বগা লেক, আলুটিলা, চিম্বুক, স্বর্ণমন্দির প্রভৃতি এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তাবিধানের মাধ্যমে পর্যটনশিল্প অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে।

জাতীয় পর্যায়ে লোকসানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) ২০০০ সালে এবং বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লিমিটেড ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পর কাজের গুণগত ও কারিগরি মান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যথাযথ তদারকির কারণে সেগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত সেনা কল্যাণ সংস্থা নির্ভেজাল দ্রব্য বাজারে সরবরাহ করে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অবদান রাখছে। দরিদ্র ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্বল্প বাজেটের মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ব্যারাক নির্মাণ করে সুষ্ঠুভাবে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করায় জাতীয় পরিমণ্ডলে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রায় অবদান রাখার জন্য দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা বদ্ধপরিকর ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এরই মধ্যে আপামর জনসাধারণের হূদয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর জন্য আছে দৃঢ় বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসা। এ অর্জন সত্যিই অতুলনীয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের অংশীদার হতে পেরে সেনা সদস্যরা গর্বিত ও আনন্দিত। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের প্রার্থনা, আমাদের উত্তরসূরিদের মতো জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আমরা যেন হতে পারি জাতীয় আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক।

লেখক : কর্নেল এ এস এম নাছের, পিএসসি, জি+, সেনাবাহিনী কর্মকর্তা

মন্তব্য

পূর্বসূরিদের মতো ভুল নীতিতেই চলছে ট্রাম্প প্রশাসন

শেয়ার
পূর্বসূরিদের মতো ভুল নীতিতেই চলছে ট্রাম্প প্রশাসন

চীন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আসা পণ্যে একতরফা অযৌক্তিক শুল্কারোপের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার তাদের পূর্বসূরির ভুল নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এ ধরনের পদক্ষেপগুলো কেবল সত্যকে বিকৃত করে এবং সাদা-কালো বিভাজন সৃষ্টি করে, বরং একতরফা অত্যাচারের উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়। বিশ্বের একটি দায়িত্বশীল শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে চীন সবসময় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) কেন্দ্রে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে রক্ষা করেছে। এটি সব ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা ও অত্যাচারের কৌশলের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও বহুপাক্ষিকতার মূলনীতি থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্যুত। একতরফা শুল্কারোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতি এবং বাণিজ্য নীতিমালাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এমনকি তারা বাজারের নীতিমালা এবং মুক্ত বাণিজ্যের মনোভাবকে অগ্রাহ্য করে এবং বৈশ্বিকীকরণের প্রবণতার বিরুদ্ধে যায়।

বহু বছর ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ অজুহাতে ‘দীর্ঘমেয়াদী এখতিয়ার’ এবং একতরফা নিষেধাজ্ঞার অপব্যবহার করেছে, অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।

এ ধরনের পদক্ষেপগুলো কেবল ডাব্লিউটিও-এর বৈষম্যবিহীনতার নীতিকে লঙ্ঘন করে না, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোরকে সুষ্ঠু বাণিজ্যের মাধ্যমে উন্নতি অর্জনের অধিকারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

চীন সবসময় আন্তর্জাতিক নিয়মের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে এবং শূন্য-সমষ্টির প্রতিযোগিতার পরিবর্তে পার্থক্যগুলো আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে সমাধান করার পক্ষপাতী। বহুপাক্ষিকতা হচ্ছে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করার একমাত্র পথ এবং কোনো দেশই আন্তর্জাতিক নিয়মের উপরে নিজেকে রাখতে পারে না। মার্কিন কর্মকর্তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো বৈশ্বিক শিল্প ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে।

বৈশ্বিক শিল্প ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিস্থাপকতা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সকল জাতির সম্মিলিত স্বার্থে কাজ করে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে, শান্তি বজায় রাখা, উন্নয়নকে উৎসাহিত করা এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি প্রধান দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, কিছু মার্কিন নীতি নির্ধারক ‘শক্তির অবস্থানে’ থেকে প্রযুক্তিগত বিনিময় বাধাগ্রস্ত করতে ‘একটি ছোট উঠানে উঁচু বেড়া’ নির্মাণের নীতি অনুসরণ করে চীনের শিল্প উন্নয়নকে ‘অতিরিক্ত ক্ষমতার’ ভিত্তিহীন অভিযোগের মাধ্যমে কলঙ্কিত করছেন, এবং ‘ডিকাপলিং এবং সরবরাহ চেইন বিচ্ছিন্ন করার’ নীতি জোরপূর্বক অনুসরণ করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপগুলো বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি এবং তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন করেছে, যা তাদের ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার’ প্রতি আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ বিরোধী।

চীন ধারাবাহিকভাবে এবং উন্মুক্ততার সাথে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণ করেছে, মানবতার জন্য একটি যৌথ ভবিষ্যৎ নির্মাণের পক্ষে কথা বলেছে এবং প্রতিবেশীদের প্রতি দয়া, সততা, পারস্পরিক লাভ এবং অন্তর্ভুক্তির নীতি অনুসরণ করেছে যা বৈশ্বিক শিল্প ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতার জন্য অবদান রেখেছে।

এই পদ্ধতিটি নতুন মার্কিন প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত, যা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে ব্যাহত করে। এ ধরনের দ্বিমুখী কাজ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিংবা পারস্পরিক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভালো নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বাস্তবমুখী সহযোগিতা বৃদ্ধি কথা জনসম্মুখে দাবি করে, অন্যদিকে একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা পারস্পরিক বিশ্বাসকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে।

চীন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রকৃতি হচ্ছে পারস্পরিক সুবিধা এবং বিজয়ী-বিজয়ী সহযোগিতা। একপক্ষ সবসময় হেরে যাবে এবং অন্যপক্ষ সবসময় লাভবান হবে এমনটা হবে না। তথ্য-উপাত্ত সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করে যে, শুল্কের মাধ্যমে ‘দেয়াল তৈরি করা’ বাজারের আইন পরিবর্তন করতে বা সহযোগিতার গতি থামাতে পারবে না। ২০২৪ সালে চীন-মার্কিন বাণিজ্য ৬৮৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০১৭ সালের তুলনায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে যে অর্ধের বেশি মার্কিন প্রতিষ্ঠান ২০২৫ সালে চীনে তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে চায়। সহযোগিতা হচ্ছে চীন-মার্কিন সম্পর্কের জন্য একমাত্র সঠিক পথ। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভুল পথে চালিয়ে যায়, চীন সবসময় যথাযথ জবাব দিতে প্রস্তুত।

আজকের পৃথিবী অস্থিরতা এবং দুর্বল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্মুখীন। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে একতা এবং সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। চীন এবং বাংলাদেশ উভয়ই বৈশ্বিকীকরণের উপকারভোগী এবং অবদানকারী, এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতার উপর বিস্তৃত সহমত রয়েছে। গত বছর, উভয় দেশের নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা এবং জনগণের দৃঢ় সমর্থনে, চীন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সংকটপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা এবং প্রাণশক্তি প্রদর্শন করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিতে আরও অধিক নির্ভরযোগ্যতা প্রদান করেছে।

চীন এবং বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই লাভজনক সহযোগিতা এবং মুক্ত বাণিজ্যের অনুকরণীয় সমর্থক হিসেবে কাজ করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীন এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, চীন ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে রয়েছে। চীনা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৬০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। 

এছাড়া বাংলাদেশ আগামী মে মাস থেকে চীনে তাজা আম রপ্তানি করবে, যা বাংলাদেশের ফল শিল্পে শক্তিশালী প্রেরণা সৃষ্টি করবে, এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও সুষম হবে। চীন বাংলাদেশকে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা রক্ষা করতে, একপাক্ষিকতার বিরোধিতা করতে, চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা ত্বরান্বিত করতে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহযোগিতায় বাস্তব ফলাফল প্রচারের জন্য কাজ করবে। আমি জানি অনেক বাংলাদেশী উদ্যোক্তা চীনে ইলিশ মাছের মতো পণ্য রপ্তানি করতে চায় এবং আমরা দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কাঠামোর মধ্যে তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারি। চীন বাংলাদেশের উচ্চমানের পণ্যকে স্বাগত জানায় এবং চীনের দরজা আরো বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হবে।

চীন এবং বাংলাদেশ শিল্প এবং সরবরাহ চেইনে বিনিয়োগ উত্সাহিত করতে এবং সহযোগিতা ত্বরান্বিত করতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে। চীনের সুবিধাগুলি যেমন অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, টেক্সটাইল, পোশাক এবং সবুজ অর্থনীতি বাংলাদেশে উন্নয়ন কৌশল, শিল্প কাঠামো এবং জনগণের চাহিদার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলে, যা চীনকে অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় এক অমূল্য অংশীদার করে তোলে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী এবং এখানে তাদের সম্পৃক্ততা গভীর করতে আগ্রহী। চীনা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে, বাংলাদেশে চীনের বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা চীনে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের
উৎস।

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে অন্তত ১৪টি চীনা প্রতিষ্ঠান টেক্সটাইল ও পোশাক, সুটকেস, জুতা, পরচুলাসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশে ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। চীন এই সময়কালে বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিণত হয়েছে। এপ্রিল মাসে, বাংলাদেশ ২০২৫ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করবে। আমরা আরো চীনা প্রতিষ্ঠানকে এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করব এবং আরও ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের সমর্থন করব। চীন এবং বাংলাদেশ একে অপরের রাজনৈতিক পারস্পরিক বিশ্বাস এবং পারস্পরিক লাভের ভিত্তিতে প্রকল্প সহযোগিতার একটি সুন্দর উদাহরণ স্থাপন করতে পারে। রাজনৈতিক পারস্পরিক বিশ্বাস হলো সব প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের জন্য মূল ভিত্তি।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে চীনের সহযোগিতায় চলমান এবং নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলিকে চালু রাখার বিষয়ে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছে যে চীনের সহযোগিতায় চলমান এবং নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি অপরিবর্তিত থাকবে এবং ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলি কার্যকর থাকবে। এটি স্পষ্টতই দুই দেশের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক পারস্পরিক আস্থার প্রতিফলন ঘটায়, সেইসাথে আমাদের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের প্রতি বিস্তৃত সামাজিক ও জনসাধারণের সমর্থনও প্রতিফলিত করে। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তঃসরকারি সহযোগিতা প্রকল্পগুলি সুষ্ঠুভাবে এবং কোনও বাধা ছাড়াই ত্বরান্বিত হচ্ছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এবং ডাবল পাইপ লাইনসহ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপন প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের জন্য চীন-সহায়তা প্রকল্প এবং ঢাকা উত্তর শহরে ডব্লিউটিই পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পও সফলভাবে শুরু হয়েছে। চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চল প্রকল্প শুরু হতে চলেছে। আগামীতে চীন বাংলাদেশের উন্নয়নকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আরও বেশি যুগান্তকারী প্রকল্প এবং ‘ছোট এবং সুন্দর’ জীবিকা প্রকল্প বাংলাদেশে নিয়ে আসবে। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য অংশীদার থাকবে।

ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে, দেয়াল নির্মাণ কেবল একজনকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে, অন্যদিকে উন্মুক্ততা ভাগাভাগি করে সমৃদ্ধি বর্ধন করবে। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের বছরটি উদযাপন করে, চীন বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক সমর্থন বজায় রাখবে, একে অপরকে সমানভাবে বিবেচনা করবে এবং লাভজনক সহযোগিতা চালিয়ে যাবে। 

লেখক: বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত

মন্তব্য

বিপ্লব থেকে রাজনৈতিক দল

    সামান্তা শারমিন
শেয়ার
বিপ্লব থেকে রাজনৈতিক দল
সামান্তা শারমিন

যে নতুন দেশ আমরা পেয়েছি সেটাকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তৈরি করে যেতে চাই। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নামটা যেনো থাকে জ্বলজ্বলে প্রদীপের মতো সেটাই আমার, আমাদের একমাত্র চাওয়া...

ছাত্রজীবনে আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা এসেছে বারবার। পিছপা হইনি।

এরইমধ্যে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা ছাত্র-গণপ্রতিরোধের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা পালাতে বাধ্য হন। এতে নতুন এক বাংলাদেশ গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেটাকে পথ দেখাতে সম্পৃক্ত হয়েছি নতুন দলে। দেশ গঠনে আমাদের পথচলা মাত্র শুরু হয়েছে।
তাই জানি সামনের পথও মসৃন নয়। এসব মাথায় রেখেই এগিয়ে যেতে চাই। যে নতুন দেশ আমরা পেয়েছি সেটাকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তৈরি করে যেতে চাই। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নামটা যেনো থাকে জ্বলজ্বলে প্রদীপের মতো সেটাই আমার, আমাদের একমাত্র চাওয়া।

আমার আজকের পথচলার স্পৃহা ছাত্রজীবন থেকেই। জন্ম ও বেড়ে উঠা ঢাকায় হওয়ায় অনেক আন্দোলনে নিজেকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্ররাজনীতির পথচলা শুরু সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কর্মী হিসেবে।

পরবর্তীতে দলীয় রাজনীতি থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য যৌথ আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সমন্বিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার চেষ্টা করি। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ও ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানার দুটির অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করি। ২০১১-২০১৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণসহ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করি। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘটিত প্রতিটি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিচারের দাবিতে লড়াই করেছি। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, তনু হত্যা প্রতিবাদে ঢাবির প্রতিবাদ কর্মসূচি এবং প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলোর প্রধানতম সংগঠক হিসেবে কাজ করি। ২০১৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপের দিনগুলোতে আওয়ামী-ভারতীয় প্রকৃতিবিনাশী আগ্রাসী উন্নয়ননীতির বিরুদ্ধে অব্যাহত আন্দোলন চালিয়ে গেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ২০১৬ সালে চারুকলা অনুষদে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের আগমনের প্রতিবাদে রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরের সামনে বিক্ষোভ মিছিল। প্রাণ প্রকৃতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক অধিকার আদায়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মঞ্চ ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তির’ অন্যতম সংগঠক ছিলাম। হল প্রশাসনের অবহেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লার মৃত্যু, ছাত্রলীগ কর্তৃক এহসান রফিকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মুখ্য অবদান রাখার চেষ্টা করি। ২০১৮ সালে ঢাবিতে ছাত্রলীগের যৌন নিপীড়নের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক নির্মম আক্রমণের শিকার হই। ডাকসু নির্বাচনের দাবিতেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যতম একজন সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করি। ২০১৭ সালে ঢাবির উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দিন ডাকসু প্রতিনিধিবিহীন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে সিন্ডিকেট ভবনের গেইটে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনকালে আমিসহ আরও অনেক শিক্ষার্থী আওয়ামীপন্থি শিক্ষার্থীদের হামলার শিকার হই। আওয়ামী লীগের গুম-খুন ও সন্ত্রাসের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে আপোসহীন মনোভাবের কারণে ২০১৪ থেকে ২০১৮- এ সময়কালে ঢাবির গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র নেতৃবৃন্দের একজনে পরিণত হই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন-পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের দিকে কিছুকাল চাকরি করা হয়।। ওই সময়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ কিছুটা কমলেও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা আন্দোলন এবং আবরার ফাহাদ হত্যা প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনগুলোতে নানাভাবে সহযোগিতা করি। এ সময় রাষ্ট্রসংস্কারের তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে নিবেদিত চিন্তাসংগঠন ‘রাষ্ট্রচিন্তা’র সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীনও এদেশের আপামর জনতার সঙ্গে মাঠে ছিলাম। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণায় গঠিত ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। পরে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছি।

আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সবকিছুর ঊর্ধ্বে কোনো কিছুকে স্থান দেওয়া। এবারের আন্দোলনে আমরা সেটা করতে পেরেছি। বাংলাদেশকে আমরা বার বার বলছি এটা একটা আধুনিক রাষ্ট্র। কিন্তু এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে কি না? এ জায়গাটা যদি আমরা ফোকাস করি তাহলে দেখব আমাদের যে নাগরিক মর্যাদা সেটা নেই এবং কখনো হওয়ারও ছিল না...

বলা যায়, ছাত্রজীবনের পুরোটাই একটা বিপ্লবী জীবনের মধ্য দিয়ে পার করেছি। এখন একটা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকায় সুযোগ এসেছে এতদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে দেশকে গড়ার। গতানুগতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করার। আমি মনে করি, ১৫ বছরের শাসনের জগদ্দল পাথর থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। তাই এখনই সময় দেশকে বদলানোর। এখনই সময় তরুণদের স্বপ্ন দেখানোর। এখনই সময় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদাকে সমুন্নত করার।

আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সবকিছুর ঊর্ধ্বে কোনো কিছুকে স্থান দেওয়া। এবারের আন্দোলনে আমরা সেটা করতে পেরেছি। বাংলাদেশকে আমরা বার বার বলছি এটা একটা আধুনিক রাষ্ট্র। কিন্তু এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে কি না? এ জায়গাটা যদি আমরা ফোকাস করি তাহলে দেখব আমাদের যে নাগরিক মর্যাদা সেটা নেই এবং কখনো হওয়ারও ছিল না...অনেক ধরনের জুলুমের মধ্য দিয়ে আমরা এসেছি। জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এসেছি। আমাদের অনেকেরই দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই আছে। আমাদের অতীত দেখলে দেখা যাবে পুরোটাই ছিল অ্যান্টি ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে উঠে আসা। প্রথমত, এটাকে একটা পরিক্রমা হিসেবে দেখছি। আমার রাজনৈতিক যে সংগ্রাম সেখানে এটাকে একটা দায়িত্ব হিসেবে দেখছি। স্বাভাবিকভাইে একটা পদের সঙ্গে জড়িত কিছু দায়িত্ব থাকে। রাষ্ট্রের দায়িত্বকে এখানে ক্ষমতা হিসেবে দেখা হয়। এই যে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এটাকে পরিবর্তনের চেষ্টায় আছি। রাষ্ট্রের যে ক্ষমতা সেটাকে দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি। তাহলে আমাদের যে পোস্ট বা পদবি আছে সেটাকেও ক্ষমতা হিসেবে না দেখে দায়িত্ব হিসেবে দেখতে চাচ্ছি। আমাদের এখন যে রাজনৈতিক কাঠামো আছে সেটাকে বলা হয় যে একদলকেন্দ্রিক। কিন্তু মোটা দাগে সেটা আসলে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এ কাঠামোটা পুরোপুরি জনবিরোধী। জনগণের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আমাদের ওপর চাপ রয়েছে। এ কাঠামো আমূল পরিবর্তন করতে হবে। ৩৬ জুলাই আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের একটা দায় আমাদের ওপর রয়েছে। সেই দায়টাও বোধ করি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বড় ধরনের মেরুকরণ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটের বাইরে গিয়ে নাগরিক পার্টি নতুন একটি রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে বিবেচিত। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সবকিছুর ঊর্ধ্বে কোনো কিছুকে স্থান দেওয়া। এবারের আন্দোলনে আমরা সেটা করতে পেরেছি। বাংলাদেশকে আমরা বার বার বলছি এটা একটা আধুনিক রাষ্ট্র। কিন্তু এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে কি না? এ জায়গাটা যদি আমরা ফোকাস করি তাহলে দেখব আমাদের যে নাগরিক মর্যাদা সেটা নেই এবং কখনো হওয়ারও ছিল না। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ, গ্রহণযোগ্য কোনো কর্মসূচি, পরামর্শ কোনো দলই ওই অর্থে নেয়নি। প্রতিবেশী ভারতের সমস্ত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ওয়ার্কেবল। তারা পুরো বিশ্বের মানচিত্রে নিজেদের স্টেট হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের যে ভোটিং পাওয়ার অর্থাৎ কোন ইস্যুতে ভারত কী ভূমিকা নিচ্ছে সেটা বড় করে দেখা হয়। এখানে ভারত যে বড় দেশ সে হিসেবে নয় এরকম ছোট অনেক দেশ রয়েছে যাদের ভোটিং পাওয়ার থাকে।

আমাদের চেষ্টা থাকবে  এবার থেকেই যে লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলো আনা দরকার সেটা এবারের নির্বাচন থেকেই হবে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ তিনটা অবৈধ নির্বাচন দেখেছে, সেই ট্রমা এখনো যায়নি। আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এদেশের মানুষ সহ্য করতে পারবে না...

বাংলাদেশ এত স্ট্রাগলিং একটা দেশ, বিশেষ করে সাউথ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু পুরো বিশ্বে আমাদের দেশের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। রাজনৈতিকভাবে ও জিও পলিটিক্যালির কোনো গুরুত্ব নেই। পুরো রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন করতে হলে ঐক্যবদ্ধতা খুবই জরুরি। আমার জায়গা থেকে এটা অবশ্যই একটা গুরু দায়িত্ব বলে মনে করি। পড়ন্ত প্রায় দুর্বল প্রকৃতির এ রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্য দিয়ে ছাত্ররা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। এ অদম্য স্পিরিট শুধু জুলাই অভ্যুত্থান না, তার আগেও দেখা গেছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেয়নি। এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই সুযোগটা এসেছে। তাদের নিয়ে পরিকল্পনা করা, তাদের রাজনৈতিক দিশা দেখানো, তারা যেন রাজনীতিতে আসে, তাদের মতামতগুলো যেন আমরা পাই সেটা নিশ্চিত করা আমাদের টপমোস্ট প্রায়োরিটি। দলগত হিসেবে তাদের গুরুত্ব আমাদের কাছে আরও বেশি। তরুণদের যদি মূল্যায়ন করতে না পারি তাহলে আমরা ব্যর্থ হব। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম। কঠোর মতাদর্শ মেনে চলার পরিবর্তে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের অংশীদার জনগণকে একত্রিত করা আমাদের লক্ষ্য। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে তা আছে, এমনকি তাদের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থাকলেও। নতুন দল হিসেবে চাই এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকুক। তাহলে পার্লামেন্টে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে না। দলগুলোর ভিতরে দক্ষতার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না, রাজনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আমরা এ জায়গাগুলোতে পরিবর্তনের কথা বলছি। আমাদের এ কথার প্রতিফলন সংসদে গিয়েও পড়বে যদি মানুষ আমাদের বিশ্বাস করে দেখে। পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। এটা পরিবর্তন করে তারা মানুষের কাতারে আসুক। প্রান্তিক এলাকায় আমাদের দলটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করতে হবে। এ কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী হব। বাংলাদেশের মানুষের কাছে যে অপশন এসেছে বা সম্ভাবনা এসেছে সেটা যেন সবার কাছে পৌঁছে। আমরা গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছি। সংবিধান পরিবর্তন করা প্রয়োজন সেটা আমাদের সবাইকে একনলেজ করতে হবে। যারা এটা করছেন না, তারা অভ্যুত্থানকে একরকম অস্বীকার করছেন বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। যদি এবার গণপরিষদ নির্বাচন না হয় তাহলে আমরা এসে সেটা করব। আমাদের চেষ্টা থাকবে এবার থেকেই যে লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলো আনা দরকার সেটা এবারের নির্বাচন থেকেই হবে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ তিনটা অবৈধ নির্বাচন দেখেছে, সেই ট্রমা এখনো যায়নি। আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এদেশের মানুষ সহ্য করতে পারবে না। সামনের যে নির্বাচন হবে সেটা এবসুলেট ফেয়ার হবে সেটা বার বার বলছি। সামনের নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতি নতুন ধারায় এগোবে।  

লেখক : সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ