মাত্র সতেরো বছর বয়স। অথচ এই সময়ে দিনরাত কেশে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। কাশির কারণ জানতে ঘন ঘন চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে।
চিকিৎসকও ভুরি ভুরি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন কফের সিরাপ, আবার কেউ অ্যান্টি অ্যালির্জিক ওষুধ। তাতেও লাভ হয়নি। বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা যায় হার্টের অসুখ নয়, ‘পপকর্ন লাংস’-এর মতো ফুসফুসের বিরল রোগে ভুগছে সে। আর এই রোগই এখন চিন্তা বাড়াচ্ছে চিকিৎসকদের।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘পপকর্ন লাংস’ রোগটিকে ‘ব্রঙ্কিওলাইটিস অবলিটেরানস’ বলা হয়। ফুসফুসের বিরল রোগটি ‘পপকর্ন লাংস’ নামে পরিচিতির কারণ হচ্ছে, পপকর্ন মাইক্রোওয়েভে তৈরির সময় ডায়াসিটাইল নামে একটি রাসায়নিক নির্গত হয়। ওই রাসায়নিক শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুসের সংক্রমণ হয়।
তাই এই রোগটি ‘পপকর্ন লাংস’ নামে পরিচিত। চিকিৎসকদের মতে, যারা অতিরিক্ত ধূমপান করেন অথবা ধুলো-ধোঁয়া বেশি রয়েছে এমন জায়গায় থাকেন, তারা এই ধরনের সমস্যায় বেশি ভোগেন।
আরো পড়ুন
গাজর রান্না করে খাওয়া ভালো, নাকি কাঁচা
পপকর্ন ফুসফুসের লক্ষণ ও উপসর্গ
‘ব্রঙ্কিওলাইটিস ওব্লিটারানস’ (বিও) বা পপকর্ন ফুসফুসের উপসর্গ যেমন কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, বমিভাব, দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্ট, এগুলো যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তাই দেরি না করে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ। ভেপিংয়ের ফলে সৃষ্ট লাইপয়েড নিউমোনিয়া সাধারণ নিউমোনিয়া থেকে আলাদা।
এটি ফ্যাটি এসিড সংক্রমণের পরিবর্তে ফুসফুসে প্রবেশ করে।
এই রোগ হলে একজন ব্যক্তি ক্রমাগত কাশি, শ্বাস নিতে অসুবিধা এবং কাশি থেকে রক্ত বা রক্তযুক্ত শ্লেষ্মার মতো লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। নিউমোথোরাক্স, বা ফুসফুসের ক্ষতি তখনই ঘটে যখন ফুসফুসে একটি ছিদ্র থাকে, যা অক্সিজেনকে বেরিয়ে যেতে দেয়। ধূমপান ও ভেপিং এক্ষেত্রে ভীষণ ক্ষতিকর।
হার্ভার্ড হেলথের মতে, পপকর্ন ফুসফুসের সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, এবং কাশি যা হাঁপানি বা ঠান্ডা লাগার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এই রোগের দ্রুত নির্ণয় জরুরি।
আরো পড়ুন
৬০০ অতিথিকে খাওয়াতে পারবে না কনের পরিবার, বিয়ে ভেঙে দিলেন বর!
কিভাবে এলো এই রোগ
আমেরিকার নেভাডার বাসিন্দা ব্রায়ান কালেন। ১৪ বছর বয়স থেকে সে ই-সিগারেটের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তার ফলে প্রায় প্রতিদিনই সে ব্যাটারিচালিত যন্ত্রের সাহায্যে ভেপার নিত। ভেপিংয়ের ফলে অ্যাসিটালডিহাইড নামে এক যৌগ তার ফুসফুসে প্রবেশ করত। তার ফলে ক্ষতি হয়েছে ফুসফুসের। সে কারণে এমন বিরল রোগে কিশোরী আক্রান্ত হয়েছে বলেই জানা গেছে।
ফাইবার বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিচালিত ই-সিগারেটের মধ্যে একটি প্রকোষ্ঠ থাকে। তার মধ্যে ভরা থাকে বিশেষ ধরনের তরল মিশ্রণ। যন্ত্রটি গরম হয়ে ওই তরলের বাষ্পীভবন ঘটায় এবং ব্যবহারকারী সেই বাষ্প টেনে নেন ফুসফুসে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘ভেপিং’। এই বাষ্পেই মিশে থাকে অ্যাসিটালডিহাইড নামে এক ধরনের যৌগ, যা ফুসফুস ছারখার করে দেয়। ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণের (ই-লিকুইড) মধ্যে থাকে প্রপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, নানাবিধ ফ্লেভার এবং নিকোটিন, যা ফুসফুসের ক্যানসারের কারণও হয়ে উঠতে পারে।
বলে রাখা ভালো, এর আগে ওই কিশোরী করোনাতেও আক্রান্ত হয়েছিল। সে সময় চিকিৎসক তাকে ই-সিগারেট ছাড়তে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে সে পরামর্শ কানে নেয়নি। সে কারণেই সম্ভবত অতি দ্রুত ফুসফুসের সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করে বলেই দাবি চিকিৎসকদের। তাদের ধারণা, গত তিন বছর ধরেই নীরবে ফুসফুসে বাসা বেঁধেছিল এই বিরল রোগ। এটি কারো কারো ক্ষেত্রে প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। তাই চিকিৎসকদের মতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধূমপানের মতো কুঅভ্যাস ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
আরো পড়ুন
বৈশাখে পাতে রাখতে পারেন ভাপা সরষে ইলিশ
ঝুঁকি কাদের
ডায়াসিটাইল বা অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকের আশেপাশে থাকা ব্যক্তিরা, যাদের ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বা শ্বাসযন্ত্রের গুরুতর সংক্রমণ রয়েছে এবং যাদের অটোইমিউন রোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেই এই রোগের ঝুঁকি বেশি।
কখনো কখনো রাসায়নিক এক্সপোজার বা অটোইমিউন রোগসহ বিভিন্ন কারণে ফুসফুসের প্রদাহ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোট শ্বাসনালীকে ক্ষতি করে, যা পপকর্ন ফুসফুসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরো পড়ুন
সানস্ক্রিন খাবেন, নাকি মাখবেন? কোনটিতে উপকার
রোগ নির্ণয়
- পপকর্ন ফুসফুস রোগের চিকিৎসার জন্য প্রাথমিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- রোগ নির্ণয়ের সর্বপ্রথম ধাপ হলো রোগীর মেডিক্যাল হিস্ট্রি এবং শারীরিক পরীক্ষা শেষ লক্ষণ এবং ক্ষতিকারক পদার্থের সম্ভাব্য এক্সপোজার নিয়ে আলোচনা করা।
- ফুসফুসের কার্যকারিতা দেখে নিতে ফুসফুসের ক্ষমতা ও বায়ুপ্রবাহের মাত্রার দিকে খেয়াল রাখা।
- ফোর্সড অসিলোমেট্রি (এফওটি) বা ইমপালস অসিলোমেট্রি পরীক্ষা।
- ভেতরে কী চলছে, তা বোঝার জন্য বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান করা।
- বায়োপসির জন্য টিস্যুর নমুনা পরীক্ষা ও সংগ্রহ করতে শ্বাসনালি দিয়ে ক্যামেরাসহ একটি নমনীয় টিউব ঢুকিয়ে ব্রঙ্কোস্কোপি করা হয়।
আরো পড়ুন
ব্রিদিং এক্সারসাইজে কী উপকার
পপকর্ন ফুসফুসের চিকিৎসা
- চিকিৎসকরা বলছেন, ওষুধ থেকে শুরু করে অক্সিজেন থেরাপি পর্যন্ত বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে পপকর্ন ফুসফুসের রোগের চিকিৎসা করা যেতে পারে।
- ফোলা কমাতে প্রিডনিসোনের মতো ওষুধ লাগবে।
- অ্যালবুটেরলের মতো ইনহেলার রোগীকে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সাহায্য করে।
- অক্সিজেন থেরাপি রোগীকে নিঃশ্বাসের কষ্ট লাঘব করবে।
- খুব গুরুতর ক্ষেত্রে রোগীর ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু এটি শুধু রোগীর জীবনের শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়েই করা হয়।
আরো পড়ুন
পুরনো ও গুরুত্বপূর্ণ মেইল সহজে খুঁজে বের করবে জিমেইল
সূত্র : আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান টাইমস।