ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে
কলকাতার পথ ঘাট আমাদের অজানা। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুব দেওয়ার আগে ট্যাক্সি ক্যাবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পৌঁছে আমরা বিদেশি কোঠায় টিকিট কেটে নিলাম।
কলকাতা শহরে বৃটিশদের তৈরি অনেক ভবন আছে। মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি তাজমহলের আদলে তৈরি।
কেউ হঠাৎ দেখলে তাজমহল মনে করে গোলকধাঁধায় পড়ে যাবে। স্মৃতি সৌধটির মধ্যভাগে মসজিদের মতো বিশালাকার গম্বুজ। চারিধারে রয়েছে আরো চারটি ছোট গম্বুজ। বড় গম্বুজটির চূড়ায় পিতলে মোড়ানো পরী বসানো।
রবার্ট ক্লাইভ সিরাজুদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করতে সেনাপতি মীর জাফরকে ঘুষ দিয়েছিল, প্রতিশ্রতি দিয়েছিল পরবর্তী নবাব করার। মাকড়সার জালে পোকামাকড় আঁটকে পড়ার মতো লোভের ফাঁদে আটকে গিয়েছিল মীর জাফর। তার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হন সিরাজউদ্দৌলা। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮৭৬ সাল থেকে ১৯০১ সাল অবধি ভারতবর্ষে সম্রাজ্ঞীর দায়িত্ব পালন করেন রানি। রানির ক্ষমতার পরিধি ছিল দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। ১৯০১ ইং সালে রানী মৃত্যুবরণ করলে ব্রিটিশ শাসকরা রানীর স্মৃতি ধরে রাখতে নির্মাণ করেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। অত্যন্ত সুদর্শনা দেখাচ্ছে ব্রোঞ্জ দিয়ে নির্মিত রানিকে।
পৃথিবীর অনেক রাজা বাদশা, প্রজাদের কাছ থেকে লুন্ঠন করা ধনসম্পদ রানীকে খুশি করতে বখরা দিত।
সময়ের স্রোতে রানী আজ মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি বর্তমানে জাতীয় সংগ্রহশালা। গ্যালারিতে রয়েছে মহারানি ও তার পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ১৬৫০ সাল থেকে সংরক্ষিত আছে ইতিহাসের প্রতাপশালী ব্যক্তিদের পদক, অস্ত্রশস্ত্র, ভাস্কর্য, কস্টিউমস এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন। সেখানে খাপ থেকে তরবারি খুলে দাঁড়িয়ে আছেন লর্ড ক্লাইড। যার কুট বুদ্ধির কাছে হার মেনে ভারতবর্ষকে প্রায় দুইশো বছর পরাধীনতার গ্লানির স্বাদ নিতে হয়েছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে বিদায় নিয়ে যখন পথ চলতি সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল এর দিকে। তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে সামান্য ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। তেজহীন সূর্যটা যেন অন্ধকারের কাছে বিদায় চেয়ে নিচ্ছে।
সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল
সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল কলকাতার বৃহত্তম গির্জা। এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৮৩৯ সালে। নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয় ১৮৪৭ সালে। ক্যাথিড্রালে সকল ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার রয়েছে। যে কোন ধর্মীয় উপাসনালয় মনকে অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে দেয়।
টিকেট কেটে ক্যাথিড্রাল এর ভেতরে প্রবেশ করলাম। চোখে পড়ল যিশুর একটা ভাস্কর্য। প্রবেশ পথের ডানদিকে আছে বড় গ্রন্থাগার। পাশে রয়েছে স্মারক দ্রব্যের প্রদর্শশালা। ক্যাথিড্রালের বাম পাশে বিশাল উপাসনার স্থান। সুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। চেয়ারে বসে ধ্যানী বকের মতো কেউ অর্ধেক চোখ বুজে, কেউ চোখ অর্ধেক খুলে প্রার্থনায় মগ্ন।
ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়ে এলাম। ক্যাথিড্রালে প্রবেশের আগে প্রকৃতি চারদিকে অন্ধকারের যে প্রাচীর টেনে দিয়েছিল, বিদ্যুতের আলো সে অন্ধকারের স্থান দখল দিয়ে ঝিকিমিকি করে হাসছে। দিনের ঘুমন্ত জীর্ণ শীর্ণ নোংরা কলকাতা যেন রাতে জেগে উঠছে আলোর ঝলকানিতে। ধবধবে আলোয় বয়োজ্যেষ্ঠা কলকাতা যেন সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা ষোড়শীর যৌবন পেয়েছে। আমরা সামনের দিকে আসতেই চোখে পড়ল বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়াম। এটি ক্যাথেড্রাল ঠিক সামনেই অবস্থিত। ১৯৮৮ সালে নির্মিত এই প্ল্যানেটেরিয়ামটি এশিয়ার বৃহত্তম প্ল্যানেটেরিয়াম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাকাশের বিস্ময়কর দারুণ সব গ্রহ নক্ষত্র দেখা যায় এই সেন্টার থেকে। এটি রাতের আকাশে ভার্চুয়াল ভ্রমণ এবং মহাজাগতিক শো প্রদশন করে। এই
প্ল্যানেটেরিয়াম থেকে জ্যোতিবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান এবং গ্রহ নক্ষত্র সংক্রান্ত মহাবিশ্বের তথ্য জানতে পারে মানুষ ।
মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য অনেকেরই অজানা। আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহের আয়তন ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটার। সূর্য পৃথিবী থেকে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে সূর্য তের লক্ষ গুন বড়। শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও পৃথিবী সহ যে ৮ টি গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, আমরা একেই বলি সৌর জগৎ। সূর্য অবস্থান করছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে।
বিজ্ঞানীদের মতে, একশো থেকে চারশ বিলিয়ন সূর্যের মতো নক্ষত্র মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে। মহাকাশে দুই লক্ষ কোটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আছে যা আমরা রাতের আকাশে তারা হিসাবে দেখি। মহাসাগরের পানির কাছে এক বালতি পানি যেমন তুচ্ছ তেমনি মহাবিশ্বের তুলনায় ক্ষুদ্র আমাদের এ পৃথিবী। তাহলে স্রষ্টা কত বড় আর তার শক্তি কতুটুকু, এটা মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। সৃষ্টির বিশালত্বের কথা কেউ চিন্তা করলে সে কখনো ঠগবাজী, হানাহানি, খুনোখুনির কথা চিন্তা করবে না।
(চলবে...)