সামরিক বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারাই মূলত এসব সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন।
শোষক, দখলদার হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলায় বাঙালি সেনা সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে গেরিলা অভিযান শুরু করেন। কৌশলগত সামরিক স্থাপনা ও যুদ্ধ-সরঞ্জাম ধ্বংস, রসদ সরবরাহ ব্যবস্থায় ভাঙন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক অকেজো করে দেওয়ার মাধ্যমে দখলদার হানাদার বাহিনীর সামরিক সক্ষমতা ও মনোবল দুর্বল করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অভিযানগুলো বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। যুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়েই ছিল অকুতোভয় বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ অবদান, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত।
একাত্তরের ২৫ মার্চের পরপরই দখলদার নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা ও নাবিকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সরাসরি বিদ্রোহ করে। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত হন। এরপর প্রথম ধাপে তাঁরা সরাসরি হামলা করেন দখলদার নৌবাহিনীর ওপর, দ্বিতীয় ধাপে সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনীকে।
নদী-খাল-বিল পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের আনাচকানাচে দখলদার হানাদার বাহিনীর রণতরি ও রসদবাহী জাহাজের ওপর একের পর এক আক্রমণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে আগস্ট মাসে ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রাম, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের বিভিন্ন বন্দরে একযোগে হামলা চালিয়ে দখলদার হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করে দেন। এ সময় বিভিন্ন নদী ও সমুদ্র উপকূলে ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হয়। এসব তৎপরতার মুখে যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে জাহাজ এসে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তেই পারছিল না। এ ছাড়া জলপথে অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক সরঞ্জাম, রসদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দল পরিবহনে নৌবাহিনীর সদস্যরা যে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন, তা হানাদারবিরোধী আক্রমণ জোরদার করার কাজে বড় অবদান রেখেছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। সামরিক স্থাপনাগুলোর সবই ছিল দখলদার হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানবাহিনীতে কর্মরত বেশির ভাগ মুক্তিকামী বাঙালি সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে যান এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (পরে স্বাধীন বাংলাদেশে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত) বিমান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শহীদ হন।
একাত্তরের মাঝামাঝি পাওয়া কয়েকটি বেসামরিক উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার বিমানবাহিনীর সদস্যরা নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে সামরিক আকাশযানে রূপান্তর করেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সেগুলোর সাহায্যেই বাংলাদেশের বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো সক্রিয় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলমের নেতৃত্বে ‘কাগমারী অপারেশন’ নামে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সেই অভিযানে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দখলদার হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাঁড়াশি আক্রমণ চালানো হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল বাড়াতে ওই অভিযানের কৌশলগত প্রভাব ছিল ব্যাপক। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তৎপরতায় বাংলাদেশের আকাশসীমায় দখলদার বিমানবাহিনীর উপস্থিতি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হয়। বিমানবাহিনীর সদস্যরা বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। দখলদার হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ও রসদ সরবরাহ কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে ওই হামলাগুলো খুবই কার্যকর ছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী তাদের অনবদ্য অবদানের সাক্ষ্য রেখে গেছে ইতিহাসের পরতে পরতে।
‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’, এই মন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও বহিঃশত্রুর হুমকি মোকাবেলা। এ ছাড়া সন্ত্রাস দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখার কাজেও বারবার এসেছে সেনাবাহিনীর নাম। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমনে তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়।
সামরিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রয়োজনের বাইরে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস, পাহাড়ধস, ভবনধস, বড় দুর্ঘটনা, মহামারির মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ পরিস্থিতিতেও তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ কার্যক্রম, জরুরি চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনের মতো মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও সামরিক বাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্থাপনা নির্মাণ, বিশেষ করে সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, রেলপথসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত বড় প্রকল্প স্বচ্ছতা ও পেশাদারির সঙ্গে বাস্তবায়ন করার কাজেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাম যুক্ত হয়েছে আস্থা ও ভরসার প্রতীক হিসেবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি কার্ড, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) ইত্যাদি স্পর্শকাতর ও মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নে অবদান রেখেছে সেনাবাহিনীই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিশেষ শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া তারা মানবসম্পদ উন্নয়নেও রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান।
‘শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’—এই মন্ত্রে দেশের জলসীমার অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের জলসীমা রক্ষা ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিস্তৃত নৌসীমান্তের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করছে। এ ছাড়া জলপথ ও উপকূলীয় অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা, চোরাচালান, মাদকপাচার, মানবপাচার, অবৈধ মৎস্য আহরণ, অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ, উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ নানা দায়িত্ব পালন করছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। দেশের জলসীমায় বড় নৌদুর্ঘটনা এবং দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে জরুরি উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি দুস্থ, দুর্গত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে নৌবাহিনীই ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রেও নৌবাহিনীর সামাজিক অবদান উল্লেখ করতে হয়।
বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশে আজ যে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে সগৌরবে, তার পেছনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অজস্র ত্যাগ রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বরাবরই ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানোর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর এই কৃতিত্ব সত্যিকার অর্থেই বিরল।
বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লিমিটেড, খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড, ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লোকসানি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার সশস্ত্র বাহিনীর কাছে ন্যস্ত হওয়ার পর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সেগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দেশের প্রয়োজনে পরিস্থিতির ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হয়েছে, ইতিহাসে এমন নজির অসংখ্য। ভবিষ্যতেও যতবার প্রয়োজন হবে, সশস্ত্র বাহিনী উপস্থিত থাকবে সঠিক সময়েই। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পেশাদার ও আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনন্য গতিতে এগিয়ে চলা আজকের বাংলাদেশের বড় আস্থা ও ভরসা হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীরও নিশ্চল থেমে থাকার সুযোগ নেই।
প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাহস ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। শান্তি রক্ষার জন্য সহানুভূতি ও ত্যাগ দেখিয়েছেন।
দেশপ্রেমের আদর্শে বলীয়ান হয়ে একাত্তরে যে অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছিল, সেই চেতনার ধারাবাহিকতায় দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় জনগণের সঙ্গে শরিক হতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সর্বোপরি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী একই সঙ্গে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণেও অবদান রেখে গেছে, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় সারথি হয়ে পাশে থেকেছে দেশবাসীর।
লেখক : সেনা কর্মকর্তা