<p>৪০ বছর বয়সী চার সন্তানের পিতা এলিরান মিজরাহি গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের নেতৃত্বাধীন মারাত্মক হামলার পরে গাজা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। এরপর একজন ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে ইসরায়েলে ফিরে এসেছিলেন। তার পরিবার জানিয়েছে, এলিরান মিজরাহি গাজা স্ট্রিপে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যা দেখেছিলেন, তাতে মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। </p> <p>এলিরান মিজরাহিকে প্রথমবার যুদ্ধে পাঠানোর ছয় মাস পর বাড়ি ফিরেছিলেন। তবে সেখান থেকে ফিরে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর সঙ্গে লড়াই করছিলেন। আবার তাকে গাজায় পাঠানোর কথা ছিল কিন্তু তার আগেই তিনি নিজের জীবন নেন।</p> <p>ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ জানিয়েছে, সংবাদপত্রের প্রাপ্ত সামরিক তথ্য অনুসারে ৭ অক্টোবর থেকে ১১ মে পর্যন্ত ১০ জন সেনা আত্মহত্যা করেছেন। যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলি সেনাদের আত্মহত্যার সংখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে একজন মনোবিজ্ঞানী এবং আইডিএফ-এর কমব্যাট রেসপন্স ইউনিটের কমান্ডার উজি বেচোর বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয় না এবং সামরিক বাহিনী আত্মহত্যার হারকে বড় করে দেখে।’</p> <p>বেচোর বলেন, ‘গত পাঁচ বা ছয় বছরে সেনাবাহিনীতে আত্মহত্যার হার কমবেশি স্থিতিশীল।’ তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি হলেও এখন পর্যন্ত অনুপাত আগের বছরের তুলনায় অনেকটা একই, কারণ আমাদের সেনা সংখ্যা বেশি।’<br /> তিনি সিএনএনকে আত্মহত্যার সংখ্যা বা তথ্য দেননি।</p> <p>আত্মহত্যা করা সেনা এলিরান মিজরাহির মা জেনি মিজরাহি বলেন, ‘এলিরান গাজা থেকে ঠিকই ফিরে ছিলেন কিন্তু তিনি যে গাজা দেখেছেন সেখান থেকে আর ফিরতে পারেননি।’ </p> <p>মিজরাহিকে গত বছরের ৮ অক্টোবর গাজায় মোতায়েন করা হয়েছিল। তাকে সেখানে একটি ডি-৯ বুলডোজার চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এটি একটি ৬২ টনের সাঁজোয়া যান। যানটি বুলেট এবং বিস্ফোরকের আঘাত সহ্য করতে পারে। </p> <p>এলিরান মিজরাহি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় একজন বেসামরিক নাগরিক হিসেবেই ইসরায়েলে বসবাস করতেন। ইসরায়েলি নির্মাণ কম্পানিতে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। হামাস হামলা চালানোর পড়ে তিনি লড়ায়ে যেতে চান বলে তার মা জেনি সিএনএনকে বলেন।</p> <p>গাজায় তিনি হাঁটুতে আঘাত পাওয়ার আগ ১৮৬ দিন সেখানে কাটিয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে রকেট চালিত গ্রেনেড (আরপিজি) গাড়িতে আঘাত করলে তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে তিনি ফেরত আসেন এবং এপ্রিল মাসে তার পিটিএসডি ধরা পড়ে। এক সাপ্তাহ ধরে থেরাপিও নিয়েছিলেন তিনি। তবে চিকিৎসায় কোনো লাভ হয়নি।</p> <p>দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি মা'লে আদুমিম বসতিতে বসবাসকারী মা জেনি বলেন, ‘ সেনারা এমন কিছু দেখেছে যা ইসরায়েলে তারা কখনও দেখেনি।’</p> <p>এলিরান মিজরাহি যখন ছুটিতে ছিলেন তখন রাগ ও অনিদ্রায় ভুগছিলেন। তিনি সামাজ থেকেও দূরে সরে যান বলে তার পরিবার জানায়। তিনি তার পরিবারকে বলেছিলেন, তার সঙ্গে যারা গাজায় ছিল তারাই বুঝতে পারে তার কী অবস্থা। মিজরাহির বোন শির সিএনএনকে বলেছেন, ‘এলিরান সবসময় বলতেন, আমি যা দেখেছি তা কেউ বুঝবে না।’</p> <p>মা জেনি ভেছিলেন তার ছেলে গাজায় কাউকে হত্যা করেছে, যা তিনি সামলাতে পারেনি। জেনি বলেন, ‘মিজরাহি অনেক ফিলিস্তিনিকে মরতে দেখেছে। হয়ত সে কাউকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানদের এই ধরনের কাজ করতে শেখাই না। সম্ভবত এটি তার জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।’</p> <p>মিজরাহির বন্ধু ও বুলডোজারের সহচালক গাই জাকেন গাজায় তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা খুব, খুব, খুব কঠিন জিনিস দেখেছি। যে জিনিসগুলো মেনে নেওয়া কঠিন।’ </p> <p>এই সাবেক এক সেনা গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক আঘাত সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। জুনে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের কাছে দেওয়া এক সাক্ষ্যে গাই জাকেন বলেছিলেন, ‘অনেক অনুষ্ঠানে সেনা দের শতশত মৃত এবং জীবিত যোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হত। অনেক পচা-গলা লাশ দেখেছি।’</p> <p>জাকেন জানান, তিনি আর কোনোদিন মাংস খেতে পারবেন না। মাংস তাকে গাজায় তার বুলডোজার থেকে প্রত্যক্ষ করা বিভীষিকাময় দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না, তার মাথায় বিস্ফোরণের শব্দ বেজে ওঠে।</p> <p>তিনি মৃতদেহকে ‘মাংস’ হিসেবে উল্লেখ করে সিএনএনকে বলেছিলেন, ‘যখন আপনি বাইরে অনেক মাংস দেখতে পান, রক্ত দেখতে পান... আমাদের এবং তাদের (হামাস), তখন আপনি যাই খাবেন তা আপনার মনে পড়বেই।’</p> <p>এলিরান মিজরাহির পিটিএসডি থাকা সত্ত্বেও আবার ডাকা হলে তিনি গাজায় ফিরে যেতে রাজি হয়েছিলেন। তাকে পুনরায় মোতায়েন করার  দুই দিন আগে আত্মহত্যা করেন। আইডিএফ তাকে সামরিক দাফনের অনুমতি না দেওয়ায় মিজরাহির পরিবার তার মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে। সেনাবাহিনী বলছে, ঘটনার সময় তিনি ডিউটিতে ছিলেন না। </p> <p>যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা সেনাদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে। আগস্টে এক বিবৃতিতে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ বলেছে, প্রতি মাসে এক হাজারে বেশি নতুন আহত সেনাকে চিকিৎসার জন্য যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। ২৭ শতাংশের মানসিক সমস্যা বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ধরা পরে।</p> <p>তারা আরো যোগ করেছে, বছরের শেষ নাগাদ ১৪ হাজার আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হবে। যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। </p> <p>ইসরায়েলে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে এবং প্রতি বছর ৬ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুসারে, উল্লেখিত সংখ্যার মধ্যে প্রায় ২৩ শতাংশ এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ দায়ের করে না।  </p> <p>২০২১ সালে আইডিএফ সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যা ছিল মৃত্যুর প্রধান কারণ। টাইমস অফ ইসরায়েল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সামরিক তথ্য অনুয়ায়ী, ওই বছর কমপক্ষে ১১ জন সেনা তাদের জীবন নিয়েছিল।</p> <p>এই বছরের শুরুর দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৭ অক্টোবর থেকে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিল ইসরায়েল। তারা বলেছিল, প্রতিবেদন করা করা ঘটনাগুলো ‘মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। </p> <p>সংখ্যা প্রদান না করে দেশটির মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একই মাসের তুলনায় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলে আত্মহত্যার ঘটনা হ্রাস পেয়েছে।’</p> <p>সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু সেনা বলছে তারা ভয় পাচ্ছে আরো একটি সংঘাতে তারা জড়িয়ে পড়েছে। গাজায় চার মাস ছিলেন এমন একজন আইডিএফ চিকিৎসক তার নাম প্রকাশ না করে সিএনএনকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেকেই এখন আর সরকারকে বিশ্বাস করি না। লেবাননে যুদ্ধের জন্য আবার খসড়া হওয়ায় আমাদের অনেকেই এখন খুব ভীত হয়ে পড়েছেন।’ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ গাজায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বা সেখানে অবস্থানরত সেনাদের অভিজ্ঞতা জানা কঠিন হয়ে পড়েছে। </p> <p>যুদ্ধর এক বছর পর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে এক হাজার ২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫০ জনেরও বেশি জিম্মি করে। এরপর শুরু হওয়া যুদ্ধটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরায়েলের দীর্ঘতম যুদ্ধ। বর্তমানে তা লেবাননজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।</p> <p>ওই চিকিৎসক আরো বলেছেন, ‘গাজায় মোতায়েন চলাকালীন এবং পরে সেনাবাহিনীর প্রতিটি ইউনিটে মনোনীত একজন মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রয়েছেন। যুদ্ধের প্রভাব তবুও অব্যাহত রয়েছে। </p> <p>তিনি বলেন, গাজায় ১৮ বছরের কম বয়সী সেনারা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তারা প্রায়ই কান্নাকাটি করবে বা মানসিকভাবে অসাড় হয়ে পড়বে।</p> <p>ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, যুদ্ধের পর থেকে ট্রমাজনিত পিটিএসডি বা মানসিক রোগে ভুগছে এমন বহু সেনাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) মানসিক রোগে ভোগা সেনাদের সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি বা কতজন তাদের নিজের জীবন নিয়েছেন সেই সংখ্যাও উল্লেখ করেনি। </p> <p>ছিটমহলে লড়াই করা ইসরায়েলি সেনারা সিএনএনকে জানিয়েছে, তারা এমন ভয়াবহতা দেখেছে, যা বাইরের বিশ্ব কখনই বুঝতে পারবে না। সমালোচকরা যাকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘চিরকালের যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাতে প্রতিদিন যে ফিলিস্তিনিরা নিহত হচ্ছে, সেই বর্বরতার দায়ভার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের ওপর পড়ছে। </p> <p>অনেক সেনাদের জন্য গাজার যুদ্ধ হল ইসরায়েলের বেঁচে থাকার লড়াই এবং যেকোনো উপায়ে জয়ী হতে হবে। তবে এই  যুদ্ধ তাদের মানসিক আঘাতও দিচ্ছে, যা মূলত দৃষ্টিগোচর হয়। </p> <p>সিএনএন-এর সঙ্গে বেনামে কথা বলা আইডিএফ চিকিৎসকের মতে, যখন সেনারা বেসামরিক লোকদের মুখোমুখি হয় তখন অনেকেই নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি হন। গাজায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি সেনাদের অবিশ্বাস ছিল, বিশেষ করে যুদ্ধের শুরুতে। একটি ধারণা ছিল, বেসামরিক নাগরিকসহ গাজাবাসীরা খারাপ। তারা হামাসকে সমর্থন করে, তারা হামাসকে সাহায্য করে, তারা গোলাবারুদ লুকিয়ে রেখেছিল। ওই চিকিৎসক আরো বলেন, ‘এই মনোভাবগুলোর মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়েছে।’</p> <p>আইডিএফ বলেছে, তারা গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে, ফোন করে এবং হামলার আগে বেসামরিক নাগরিকদের সতর্ক করার জন্য লিফলেট বিলি করেছে। তা সত্ত্বেও গাজায় বেসামরিক মানুষ মরছেই। গাজার মানুষও মানসিক সমস্যায় ভুগছে। সেই সংখ্যা বিশাল হতে পারে। ত্রাণ গোষ্ঠী এবং জাতিসংঘ বারবার গাজার বেসামরিক নাগরিকদের বিপর্যয়মূলক মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলছে।  </p> <p>আহরন ব্রেগম্যান কিংস কলেজ লন্ডনের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধসহ ছয় বছর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, গাজা যুদ্ধ অন্য যেকোনো যুদ্ধের মতো নয়। তিনি বলেন, ‘এটি খুব দীর্ঘ, যার অর্থ সেনারা অনেক লোকের মধ্যে লড়াই করছে। তাদের বেশিরভাগই বেসামরিক।’ </p> <p>ব্রেগম্যান বলেছেন, বুলডোজার অপারেটররা তাদের মধ্যে অনেকে সরাসরি যুদ্ধের বর্বরতার মুখোমুখি হয়েছেন। তারা বহু মৃত মানুষ দেখেছে এবং তারা ধ্বংসাবশেষ থেকে মৃতদেহ পরিষ্কার করেছে বা মৃতদেহের ওপর দিয়েই বুলডোজার চালিয়েছেন।’</p> <p>অনেকের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেসামরিক জীবনে ফিরে আসা সহজ হবে না, বিশেষ যে যুদ্ধ যেখানে হাজার হাজার নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ব্রেগম্যান বলেন, ‘আপনি কীভাবে আপনার সন্তানদের ঘুম পাড়াবেন, যখন যখন আপনি জানেন, আপনি গাজায় শিশুদের মরতে দেখেছেন?’</p> <p>সূত্র : সিএনএন <br />  </p>