‘পূর্ব বাংলার মানুষ (দুঃখ কষ্ট যতই দুঃসহ হোক না কেন, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাকে সহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতা এদের আছে। দুঃখ জয় করার গৌরব তাদের জীবন ইতিহাসকে মহিমোজ্জ্বল করে রেখেছে। বিপদে ধৈর্য ও সাহস, দুঃখে সহনশীলতা এই মানুষগুলির রয়েছে অপরিসীম।’ (স্বভূমির মানুষকে এমনটিই দেখেছেন আতাউর রহমান খান।
তাঁর অভিজ্ঞতায় দীর্ঘ সময় ধরে এই ভূমির মানুষের সঙ্গে সরলতার সুযোগে প্রতারণা চলেছে; মিঠা বুলিতে করে তোলা হয়েছে বিহ্বল। অবশ্য মায়া-মরীচিকার বুলি বিশ্বাস করে করে প্রতারিত হওয়া মানুষ একসময় আত্মপরিচয়ের সন্ধানে শিকল ভাঙে; অনিবার্য হয়ে আসে মুক্তি—এ কথাও তিনি বলেন স্পষ্টত।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনীতিক আতাউর রহমান খানের জন্ম ধামরাইয়ের বালিয়া গ্রামে। পেশাগত জীবন শুরু করেন আইনজীবী হিসেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স করার পর আইনজীবী হওয়ার প্রত্যয়ে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৭-এ ঢাকা জেলা কোর্টে শুরু হয় তাঁর আইনজীবী পেশা। মেধাবী আইনজীবী ও চৌকস রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। প্রজা সমিতি দিয়ে শুরু করেছিলেন রাজনৈতিক জীবন। তারপর আর থেমে থাকেনি রাজনৈতিক অভিযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ এবং উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রগতিশীলতা লালন করেন বরাবরই। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি ছিলেন; ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্যও।
একটি অস্থির পরিস্থিতির সাহসী সন্তান আতাউর রহমান খান। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ক্ষত তখনো শুকায়নি, অথচ দেশ বিভাগের আয়োজন জমে ওঠে।
নির্ধারিত হয় ধর্মাবরণে পাকিস্তান-ভারত। এমনকি পাকিস্তানও দ্বিখণ্ডিত পরিচয়ে পরিচিত হয় পূর্ব ও পশ্চিম অভিধায়। পূর্বাঞ্চলীয় ভাষাসংগ্রামের ইতিহাস আমাদের জাতীয় জীবনে যুক্ত হয়। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি সব। অতঃপর স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব মুক্তিসংগ্রামরূপে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানই যে আজকের বাংলাদেশ—এরূপ বাস্তবায়ন এমনি এমনিই আসেনি; তা একটি দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলের মানুষজনের ভাষা-স্বাধীনতা অর্জিত হয়। মুসলিম লীগের পরাজয় নেমে আসতে থাকে। অতঃপর চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হয়ে আসে। ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের উপনির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে মুসলিম লীগ হেরে যায়। এরপর প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আর কোনো নির্বাচন মোকাবেলা করতে সাহস করে না। তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলাম মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলমান আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২১৫টি, মুসলিম লীগ ৯টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি ১টি, স্বতন্ত্র ১২টি আসন লাভ করে। এই নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অংশ নেননি। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারে প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের কারো নাম না থাকলেও ১৫ মে তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে গঠিত হয় কোয়ালিশন সরকার। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তাতে নেতৃত্ব দেয়। গণতন্ত্রী দল, আওয়ামী মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু দল নিয়ে গঠিত এই কোয়ালিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান। ১৯৫৬-র ৬ সেপ্টেম্বর তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির পূর্ব পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২-তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে গঠন করেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ১৯৬৯-এর ২০ জুলাই তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি এবং পাঁচ মাস পর মুক্তি পান। ১৯৭৩ ও ১৯৭৯-তে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। বাকশাল বিলুপ্তির পর আবার জাতীয় লীগে তত্পর হয়ে ওঠেন। ১৯৮৩-৮৪-তে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। পরে ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ থেকে ১৯৮৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৯১ তাঁর মৃত্যু হয়।
স্বৈরশাসনবিরোধী এই মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশের এরশাদ সরকারের শাসনামলে ৯ মাস প্রধানমন্ত্রিত্ব করেন
পুরো রাজনৈতিক জীবনে তিনি মাটি ও মানুষকে দেখেছেন সর্বাগ্রে। দুই বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বের কালে একদিকে চিহ্নিত করেছেন রাষ্ট্রচক্রের স্বরূপ আর অন্যদিকে প্রচিহ্নিত করেছেন নিজেদের দুর্বলতার কারণগুলো। বৃত্তের ভেতর থেকে দেখেছেন বাঙালির দুর্বলতাসমূহ। ছিলেন স্পষ্টবাদী। কোনো রকম রাখঢাক রাখেননি; ভয়ডরও ছিল না মোটেই। আইয়ুবি শাসনের কালে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত প্রথম গ্রন্থ ‘ওজারতির দুই বছর’ (১৯৬৩)। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিদ্বেষমূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করেন, পূর্ব বাংলার মানুষের দাবির কথা জানতে পারেন এবং ভেতরের বিদ্বেষ পরিস্থিতিই যে স্বায়ত্তশাসনের সোপান তা প্রমাণ করেন।
তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘স্বৈরাচারের দশ বছর’ (১৯৬৯) রাজনৈতিক সাহিত্যের স্বাক্ষর; আইয়ুবি দশক নিয়ে লেখা। আইয়ুব খান থেকে মোনেম খাঁ পর্যন্ত ১০ বছরের স্বৈরশাসনের স্বরূপ তাতে প্রতিফলিত। এই ১০ বছরের স্বৈরশাসনের ইতিহাস সবার জানা সত্ত্বেও তাঁর কথায় অনেক অজানা ইতিহাস জানা হয়। অটল ব্যক্তিত্বপরায়ণ স্বৈরশাসনবিরোধী এই মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশের এরশাদ সরকারের শাসনামলে ৯ মাস প্রধানমন্ত্রিত্ব করেন। এই সময়ের সমুদয় জীবন-অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন তৃতীয় গ্রন্থ ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের নয় মাস’ (১৯৮৭)। ১৯৮৪ সালের মার্চ থেকে ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই সময়কাল এ গ্রন্থেও ভূমি। আর বাংলাদেশের নব্বইয়ের বাস্তবতা নিয়ে লিখেছেন চতুর্থ গ্রন্থ ‘অবরুদ্ধ নয় মাস’ (১৯৯০)। চারটি গ্রন্থেই ঘরের খবর সবার হয়ে আসে তাঁর কথায়। শাসনতন্ত্রের ভেতরকার বাস্তবতা পাঠ হয়ে যায় সাধারণের; সৃষ্টি হয় যৌক্তিক সচেতনতা ও যথার্থ নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি। মুক্তি অন্বেষায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে মানুষ। তিনি শাসক হয়েও শোষিতের পক্ষে কথা বলেছেন। সব সময়ই একটি গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর মধ্যে। পেশায় আইনজীবী আর মানসিকতায় মাটি-মানুষমুখী প্রগতিবাদী হওয়ায় যুক্তি ও মননের যৌথক্রিয়ায় নির্মিত তাঁর নেতৃত্ব। ফলে লোকপ্রিয়তা কমেনি কখনো। স্বতন্ত্র চিন্তার সারথি হয়ে কাটিয়েছেন সারা জীবন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় কথা থাকতেই পারে, কিন্তু প্রগতিবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনো রকম সংশয় নেই। এখানেই তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় নিহিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাই তিনি স্মরণীয় আপন পরিচয়ে।