বাংলাদেশে বিগত ১৬ বছরে যে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বললেই চলে। যেমন দেশের ভেতর থেকে, তেমনি দেশের বাইরে থেকেও এসব নির্বাচনের ব্যাপক সমালোচনা ছিল। এসব নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন, রাতের নির্বাচন, ভোট চুরির নির্বাচনসহ আরো অনেক নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই দেশের মানুষ প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হোক
- ডিসেম্বরে নির্বাচন

নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো শুরু থেকেই কথা বলে আসছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে নির্বাচনের আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা দরকার। জাতিসংঘ মহাসচিবের সাম্প্রতিক সফরের সময়ও নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। গত ১৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে কিংবা আগামী বছরের জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যত দেরি হবে তত বেশি বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে পরাজিত করতে ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথাচাড়া দিতে শুরু করবে। একই সঙ্গে জঙ্গি ও উগ্র মনোভাব পোষণকারীরাও এই সুযোগগুলো নেওয়ার চেষ্টা করবে। নির্বাচন কমিশনও চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন করার সময়সীমা অতিক্রম করতে চায় না। সময়সীমা যাতে পার না হয় সে জন্য ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদনও আহ্বান করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে দ্রুতই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
সব কিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে তা হলো নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরের শেষ মাসে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। নির্বাচনকে মানুষ উৎসব হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসুক—এটি সবারই কাম্য। আমরা চাই, দ্রুত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দেশ এগিয়ে যাক এবং দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হোক।
সম্পর্কিত খবর

শুল্ক-কর কমানো প্রয়োজন
- সংকটে নির্মাণশিল্প

দেশের অর্থনীতিতে এখন নানামুখী সংকট চলছে। সংকট উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অনেক সংকট থেকেই গেছে। আগে থেকেই অর্থনীতির স্থবিরতা, এরপর ক্ষমতার পালাবদলের রেশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ব্যবসা-উদ্যোগে আস্থাহীনতা, ডলার সংকট, উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি—সব মিলিয়ে অর্থনীতি ঠিকমতো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এসবের প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত নির্মাণশিল্পেও।
সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বাস্তবায়িত হয়েছে। তা ১৭ শতাংশের কাছাকাছি। এর অর্থ হলো দেশের সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বলতে গেলে স্থবির।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) ও বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) নির্মাণ খাতকে এগিয়ে নিতে এ খাতের শুল্ক-কর কমানোর আহ্বান জানায়। তারা চায় আসছে বাজেটে সিমেন্টের মূল উপকরণ ক্লিংকারের শুল্ক প্রতি মেট্রিক টনে ৫০০ থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করা হোক। একইভাবে নির্মাণশিল্পের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপকরণ স্টিলের নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার ও শুল্কহার কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণেরও প্রস্তাব উদ্যোক্তাদের।
আমরা মনে করি, নির্মাণ খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে এ খাতের সঙ্গে জড়িত শতাধিক উপখাতকে টিকিয়ে রাখা, ব্যবসা চাঙ্গা করা এবং নতুন বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান করতে হলে উদ্যোক্তাদের দাবিগুলো সদয় বিবেচনায় নিতে হবে। আসছে বাজেটে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করা হলে অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে, তা অনেকটাই কেটে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে
- মাদকের ভয়াবহ বিস্তার

শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই মাদকের ছোবল ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তরুণরা তো বটেই, কিশোর-কিশোরীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এর প্রধান কারণ মাদকের সহজলভ্যতা। হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য মতে, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়ে এখন দেড় কোটির কাছাকাছি।
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, সারা দেশে অনেক জায়গায়ই নিয়মিত মাদকের হাট বসে। রাজধানীতেও বেশ কিছু স্পটে মাদক বিক্রি হয়। অভিযোগ আছে, পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবৈধ যোগসাজশেই সেগুলো পরিচালিত হয়। কথিত ‘সোর্সের’ মাধ্যমে বিরাট অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবৈধ যোগসাজশের কারণেই মাদকের কারবার বিস্তার লাভ করছে। আরেকটি বড় কারণ সীমান্ত পেরিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক আসা রোধ করতে না পারা। পাশাপাশি মাদক মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তের দুর্বলতা, জামিন পেয়ে কারবারিদের পুনরায় কারবারে নামা মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর ও সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। মাদকের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। গডফাদারসহ ছোট-বড় সব কারবারিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদকসেবীদের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে হবে।

অর্থনীতিতে আরো গতি আসুক
- যমুনা রেল সেতুর উদ্বোধন

যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একসময় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছিল সবচেয়ে অনুন্নত। ফেরিতে যমুনা নদী পার হতে ১০-১২ ঘণ্টাও লেগে যেত। শুষ্ক মৌসুমে ফেরি আটকে যেত চরে।
সড়কপথের তুলনায় রেলপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব।
আমরা আশা করি, যমুনা রেল সেতুর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক বেশি গতি পাবে এবং ওই অঞ্চলের মানুষও উন্নত সেবা পাবে।

সুশাসন ফেরাতেই হবে
- ব্যাংক খাতে মূলধন ঘাটতি

ব্যাংক খাত মানুষের আস্থা, ভরসা ও নির্ভরতার প্রতীক। বিনিয়োগ-ব্যবসা-বাণিজ্য ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক হলো এই ব্যাংক খাত। কোনো দেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহ হিসেবেও এই খাতকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত কঠিন সংকট পার করছে।
মূলত খেলাপি ঋণ কিভাবে ব্যাংক খাতকে মূলধন ঘাটতির চোরাবালিতে নিয়ে যাচ্ছে সেই চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ভালো ও মন্দ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রভিশন রাখতে পারছে না সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১০টি ব্যাংক। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৫৬ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত জুনে এটি ছিল ৩১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। অর্থাত্ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ২৪ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। ১৬টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিও ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর এবং এই খাত থেকে লুটে নেওয়া টাকা ফেরানোর চেষ্টা করছে। একইভাবে পাচার হওয়া লাখ লাখ কোটি টাকা ফেরাতেও বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এসব পদক্ষেপ আরো ফলপ্রসূ ও জোরদার করতে হবে। ব্যাংক খাতে কঠোর নজরদারি করতে হবে। বিশেষ করে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। লুটেরা ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। মোটকথা, ব্যাংক খাতকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে মানুষ আস্থা ফিরে পায় এবং তারা যেন ব্যাংকমুখী হয়। ব্যাংক খাতে আস্থা না ফিরলে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য গতি পাবে না। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আরো বেশি কৌশলী ও জনবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে।