আমরা স্লটটি নিতে পারছি না। ওটিপি দিচ্ছে না। এ জটিলতার কারণে আমি দীর্ঘ চার মাস ধরে ভুক্তভোগী। পারমিট নিতে এখন পর্যন্ত আমার ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এটা আমি পরিবার থেকে জমি বেচে দিয়েছি। আমি এই ২৫ মার্চ পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত গেছি। যাওয়ার পর আমাকে বলে, আপনি পুনরায় শুরু করেন। সব কাজ সম্পূর্ণ করার পরও আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইনি।’
একই অভিযোগ করেন খুলনা শহরের বাসিন্দা রনি ইসলাম। ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত জানুয়ারিতে ১০ লাখ টাকা খরচ করে পারমিট আনেন তিনি। এর পর থেকে শুরু হয় তাঁর ভোগান্তি। কালের কণ্ঠকে রনি ইসলাম বলেন, ‘আমার পারমিট পাওয়ার তিন মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু ভিএফএসে কোনো ধরনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারিনি। এখন আমার তো ভিসা প্রয়োজন। কারণ, আমার পারমিটের মাত্র ছয় মাস সময় রয়েছে। সময় চলে গেলে আমার ভিসা বাতিল হয়ে যাবে। এখন কী করব, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। ভিএফএস থেকেও কোনো উত্তর পাচ্ছি না।’
আরেক ভুক্তভোগী রাসেল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেখানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে যাই, সেখানে বিভিন্ন দালালরা এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা চায়। মাঝে একবার একটি চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। ওরা বলল, প্রত্যেকে এক লাখ টাকা দেবেন। আপনাদের পাসপোর্ট জমা হয়ে যাবে। আপনারা ২০ থেকে ২১ দিনের মধ্যে ভিসা পেয়ে যাবেন। এখন ভেতরে যাওয়ার আগে টাকা দিতে বলছে। ভেতরের সিরিয়াল আপনিও পাবেন। আমরা বললাম, ভাই আমরা ভেতরে সিরিয়াল দিয়ে এসে আপনাকে টাকা দিচ্ছি। আপনি যদি চান, আমাদের থেকে একটা চেক রেখে দেন। তবু তারা রাজি হচ্ছে না। আমরা চিন্তা করলাম, একটা অপরিচিত লোককে এক লাখ টাকা দিয়ে দেব? তখন আমরাও রাজি হলাম না। জমি বেচে ও সুদে টাকা নিয়ে ইতালির পারমিটের অর্থ দিয়েছি। কিন্তু এখনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারছি না।’
২০২০ সালে ইতালিয়ান সরকার কৃষি ও নির্মাণকাজ, যান্ত্রিক খাত, গৃহকর্ম, বয়স্ক সেবা, বিদ্যুৎ খাত, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, রেস্তোরাঁ ও সুপারশপে বিদেশি কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে কৃষিতেই সবচেয়ে বেশি কর্মী নেওয়ার কথা ভাবে ইতালির সরকার।
২০২৩ সালে ১৫ থেকে ২০টি দেশের মধ্যে ৮২ হাজার ৭০৫ জনকে ভিসা দেওয়ার কথা জানায় ইতালির সরকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মরক্কো বেশির ভাগ ভিসা পায়। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ভিসা পেয়েছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশে ভিসা দেওয়ার পাশাপাশি সেই বছর আবেদন ও অনুমোদন বেশি ছিল। ২০২৩ সালে ৩০ হাজার বাংলাদেশির ভিসা দেওয়ার কথা জানায় ইতালির সরকার। এ ঘোষণার পর ওই বছরের ২৭ মার্চ ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশি ভিসা আবেদন করেন।
দীর্ঘদিন ইতালি বসবাস করছেন মানবাধিকার কর্মী ইমাম হোসাইন রতন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘গত বছরের ৭ আগস্টের পর থেকে কোনো ধরনের ভিসা দেয়নি ইতালির সরকার। এর আগ পর্যন্ত ভিসা দেওয়া হতো। এতে প্রায় ১০ হাজার পরিবারের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে। এমনকি এই ১০ হাজার শ্রমিক না আসায় মালিকপক্ষের পরিকল্পনা ও কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই শ্রমিকরা যদি ইতালিতে থাকত, তবে তারা প্রতি মাসে এক লাখ টাকা দেশে পাঠাতে পারত। এখন এর জন্য প্রয়োজন কূটনৈতিক তৎপরতা। কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেলেই এটি সম্ভব। এদিকে ভিসা আটকে পড়া কর্মীদের পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা করে খরচ হয়ে গেছে। এখানে ইতালি রাষ্ট্র ও দূতাবাসের সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়েছে।’
এ বিষয়ে ভিএফএস গ্লোবালের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভিএফএস গ্লোবাল কোনো ধরনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইস্যু করে না। এটি পুরোপুরি ইতালির সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ভিসা সাক্ষাৎকারটি বিনা মূল্যে এবং প্রথম আসা ভিত্তিতে দেওয়া হয়। করোনা মহামারির পরে কর্মী ভিসাসহ সব ধরনের ভিসা সাক্ষাৎকার সীমিত হয়ে গেছে। বিভিন্ন এজেন্সি এই পরিস্থিতির অপব্যবহার করে টাকার বিনিময় ভিসা সাক্ষাৎকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু তারা কখনোই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে পারবে না।
ভিএফএস গ্লোবালের মিডিয়া ব্যবস্থাপক সৌভিক মিত্র বলেন, ‘আমরা আমাদের সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বারবার জানিয়েছি যে এই সাক্ষাৎকার পেতে কোনো ধরনের অর্থের প্রয়োজন হয় না। বিনা অর্থে এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রচুর ভুয়া ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা আমাদের লোগো ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। আমরা একাধিকবার এ বিষয়ে প্রমাণ দিয়েছি। আমাদের কর্মীরা শিক্ষিত না হওয়ার কারণে এজেন্টরা তাদের যা বলে, তারা তা বিশ্বাস করে নেয়। এটা একটি বড় সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যা থেকে আমাদের বের হতে হবে।’