সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১

বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ

হায়দার আলী ও ফরিদ আহমেদ
হায়দার আলী ও ফরিদ আহমেদ
শেয়ার
বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ভাঙ্গা চৌরাস্তা থেকে টেকেরহাট হয়ে সামনে এগোলেই গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রাম। নিভৃত এই পল্লীর মাঝে গড়ে তোলা হয়েছে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামের এক অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র, যেখানে এক রাত থাকতে গেলে গুনতে হয় অন্তত ১৫ হাজার টাকা। রিসোর্টের ভেতরে ঘুরে দেখা গেছে একই সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর হাতে গড়া আভিজাত্যের অপরূপ মিশেল। বিশাল আকৃতির ১৫টি পুকুরের চারপাশে গার্ড ওয়াল, দৃষ্টিনন্দন ঘাট, পানির কৃত্রিম ঝরনা ও আলোর ঝলকানি।

পার ঘেঁষে রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ। বিদেশি শিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি হয় এসব স্থাপত্য নকশা। কটেজের ভেতর থেকে পুকুর পর্যন্ত এমন পথ নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে মাটিতে পা ফেলার প্রয়োজন নেই; সরাসরি কটেজ থেকে কাচে ঘেরা আবরণ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় শান-বাঁধানো ঘাটে।

বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগসাভানা ইকো রিসোর্টের পরিধি এতটাই বড় যে সাহাপুর গ্রামের নাম লিখে গুগলে সার্চ দিলে এই রিসোর্টটিই আগে ভেসে ওঠে পর্দায়।

প্রায় এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই ইকো রিসোর্টের বিভিন্ন জায়গায় মাটি ভরাট করে বানানো হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও রয়েছে এখানে। আছে হাজারের বেশি ভিয়েতনামি নারকেলগাছসহ বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ। রয়েছে উন্নতমানের সাউন্ড সিস্টেমসহ বিশাল আকৃতির কনসার্ট হল।

দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একক পরিবারের জন্য বানানো এসব কটেজের পেছনে ব্যয় হয়েছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি। যুগলদের কাছে কটেজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রিসোর্টের ভেতরে এখন আরো ৫০টি কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এত সব আয়োজন যেখানে, সেই রিসোর্টের নিরাপত্তায় পাশেই বসানো হয়েছে বিশেষ পুলিশ ফাঁড়ি। যাতায়াতের জন্য সরকারি খরচে বানানো হয়েছে সাত কিলোমিটারের বেশি পাকা সড়ক।

দেশে এ রকম নজিরবিহীন আভিজাত্যে ঘেরা পর্যটন স্পটটির মালিকপক্ষ কারা জানেন? অবিশাস্য হলেও সত্য যে রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের পরিবার।

সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বেনজীরের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এবং পরিচালক ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর।

শুধু এই এক ইকো রিসোর্টই নয়, পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের নামে অন্তত ছয়টি কম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে কালের কণ্ঠর অনুসন্ধানে। এর পাঁচটিই নিজ জেলা গোপালগঞ্জে। জেলা সদরের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে রয়েছে বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদ। দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছেই দামি এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার। পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় আছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরো ১০ বিঘা জমি।

এই বিপুল সম্পদের মালিক পরিবারের কর্তা পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ সরকারি বেতন-ভাতা থেকে কত টাকা উপার্জন করেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ৩৪ বছর সাত মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট আয় করেছেন এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা। এর বাইরে পদবি অনুযায়ী পেয়েছেন আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। বাংলাদেশ পুলিশের ৩০তম মহাপরিদর্শক ছিলেন তিনি। ২০১১, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম)। অবসরে যাওয়ার আগে ২০২১ সালে ভূষিত হন শুদ্ধাচার পুরস্কারেও। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার পর বেরিয়ে আসে সাবেক এই পুলিশকর্তার থলের বিড়াল।

 

সম্পদের মালিকানায় স্ত্রী ও দুই মেয়ে

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুকৌশলী বেনজীর আহমেদ নিজের নামে কোনো সম্পদ করেননি, করেছেন তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে। গোপালগঞ্জে সাভানা ফার্ম প্রডাক্টস, সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড, সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা ইকো রিসোর্ট, সাভানা কান্ট্রি ক্লাব বানিয়েছেন বেনজীর আহমেদ। বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি কম্পানিতে বড় মেয়ে ফারহিনের নামে এক লাখ, আর ছেটে মেয়ে তাহসিনের জন্য কেনা হয়েছে আরো এক লাখ শেয়ার। এম/এস একটি শিশির বিন্দু (রেজি. পি-৪৩০৩৬) নামের ফার্মের ৫ শতাংশের মালিকানায় নাম রয়েছে বড় মেয়ের। আরো ৫ শতাংশের মালিকানা রয়েছে ছোট মেয়ের। একই প্রতিষ্ঠানে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার রয়েছে ১৫ শতাংশ অংশীদারি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিতে মোট ২৫ শতাংশের মালিকানা রয়েছে বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও মেয়েদের।

যৌথ মূলধনী ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে একটি নথি কালের কণ্ঠর হাতে এসেছে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাবেক পুলিশ ও র‌্যাব কর্তা বেনজীর আহমেদ তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাভানা অ্যাগ্রো। ২০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনধারী সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেডের পরিচালক তিনজন। ১০টি শেয়ারধারী স্ত্রী জীশান মীর্জা চেয়ারম্যান, সমপরিমাণ শেয়ারের অধিকারী ২৯ বছর বয়সী বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এমডি। আর মাত্র ২৪ বছর বয়সী ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর আছেন পরিচালক হিসেবে। প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে সরেজমিনে যায় কালের কণ্ঠ। সেখানে দেখা গেছে, ২০ কোটি নয়, সাভানা অ্যাগ্রোর রয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা।

বেনজীর আহমেদের পরিবারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো সাভানা ন্যাচারাল পার্ক প্রাইভেট লিমিটেড। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানির (আরজেএসসি) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই কম্পানির অনুমোদিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকা। সাভানা অ্যাগ্রোর মতো এই কম্পানির মালিকানায়ও আছেন স্ত্রী ও দুই মেয়ে। যথারীতি এখানেও স্ত্রী চেয়ারম্যান এবং মেয়েদের একজন এমডি, অন্যজন পরিচালক। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে এক লাখ করে মোট তিন লাখ শেয়ার। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই পার্কের আয়তন প্রায় ৬০০ বিঘা। পার্কটি বড় করতে পাশে আরো ৮০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এখন ভরাট করা হচ্ছে।

যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে পাওয়া নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাভানা অ্যাগ্রোর নিবন্ধনে ঠিকানা হিসেবে দেওয়া হয়েছে ২২৮/৩, শেখপাড়া রোড, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঠিকানাটি বেনজীরের শ্বশুরবাড়ি। বেনজীরের শ্বশুরের নাম মীর্জা মনসুর উল হক ও শাশুড়ির নাম লুত্ফুন নেসা মনসুর।

নথির তথ্য মতে, বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার জন্ম ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই। বড় মেয়ের জন্ম ১৯৯৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। ছোট মেয়ে জন্মেছেন ২০০০ সালের ১২ এপ্রিল। দুই মেয়ে মাত্র ২৯ ও ২৪ বছর বয়সেই কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন প্রভাবশালী পুলিশকর্তা বাবার অবৈধ আয়ের ওপর ভর করে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্ত্রী জীশান মীর্জারও তেমন কোনো বৈধ আয়ের উৎস না থাকা সত্ত্বেও বিপুল বিনিয়োগে গড়ে তোলা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি। জীশান মীর্জার পৈতৃক সূত্রে এত পরিমাণ সম্পদ পাওয়ার সুযোগ নেই। একইভাবে বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বিয়ে হলেও ছোট মেয়ের এখনো বিয়েই হয়নি। বড় মেয়ের বিয়ের প্রায় ১২ বছর আগে থেকেই বেনজীর কম্পানিগুলোর জন্য জমি কেনা শুরু করেন এবং মেয়েকে কম্পানির এমডি বানান।

 

সরেজমিনে বেনজীরের রিসোর্ট

বেনজীরের সম্পদের খোঁজে সরেজমিন অনুসন্ধানে গোপালগঞ্জ যায় কালের কণ্ঠর অনুসন্ধানী দল। বৈরাগীটোল এলাকায় সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কটিকে স্থানীয়রা বেনজীরের চক নামে চেনে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র‌্যাবের ডিজি থাকাকালে এলাকাটিতে স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে প্রায় এক হাজার ৪০০ বিঘা জমি কেনেন তিনি। এসব জমির বিঘাপ্রতি ক্রয়মূল্য ছিল তিন থেকে আট লাখ টাকা।

এলাকাবাসী জানায়, বেনজীর জমিগুলো কেনার পর অন্ততপক্ষে ১৫ ফুট ভরাট করে রিসোর্ট বানিয়েছেন। কারণ এগুলো ছিল বদ্ধ জলাশয়। নিচু হওয়ায় বেনজীরের রিসোর্টটি আগে ছিল মাছের অভয়ারণ্য।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাভানা রিসোর্টে ১৫টি কটেজ বানানো শেষ করে পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। এগুলো কাপলদের কাছে শুধু দিন হিসাবে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা, রাত হিসাবে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত একই দামে, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। রিসোর্টে চাকরিরত দায়িত্বশীলরা জানান, যেকোনো বয়সী ছেলেমেয়ে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই এসব কটেজে থাকতে পারে। চাইলে রাত যাপন করতে পারে। বেনজীর বিলাসবহুল এই রিসোর্ট চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন থাইল্যান্ডসহ পশ্চিমা বিশ্বের আদলে।

রিসোর্টটির আলোকসজ্জা করতে কোনো মিটার ছাড়াই কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বিদ্যুতের সরকারি তার সরবরাহ করা হয়েছে কোনো খুঁটি ছাড়াই। মাটির ওপর দিয়ে নেওয়া এসব বৈদ্যুতিক তার যে কারো জন্যই প্রাণনাশের হুমকিস্বরূপ। সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও রয়েছে এখানে। আছে হাজারের বেশি ভিয়েতনামি নারকেলগাছসহ বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ।

শুধু তাই নয়, রিসোর্টটির নিরাপত্তায় পাশেই বসানো হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নতি না হলেও এই রিসোর্টে প্রবেশ স্বাচ্ছন্দ্য করতে সাত কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে সরকারি খরচে। রিসোর্টের ভেতরেও সর্বত্র করা হয়েছে ঢালাইয়ের রাস্তা। রিসোর্টের সব রাস্তার হিসাব করলে দেখা যায়, প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক পিচ ঢালাই করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, বেনজীরের নিজ প্রতিষ্ঠানের এসব রাস্তাও করা হয়েছে সরকারি খরচে।

জানতে চাইলে রিসোর্টের ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠর অনুসন্ধানী টিমকে বলেন, বেনজীর আহমেদ এটিকে সাজাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে বড় ইকোপার্ক ও বিলাসবহুল রিসোর্টের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে। এ জন্য যা যা দরকার, তা-ই করা হচ্ছে।

বেনজীরের কেনা জমির কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্রমাগত চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন বেনজীর। ভয়ভীতিতে কাজ না হলে ভেকু দিয়ে জমির মাটি নিয়ে যেতেন। গভীর গর্ত করে শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে বাধ্য করতেন। পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদে থাকায় তাঁর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি জমির মালিকরা।

 

ঢাকা ও পূর্বাচলে বিপুল টাকার সম্পদ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর গুলশানে সুবিশাল অভিজাত একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বেনজীর আহমেদের। গুলশান ১ নম্বরের ১৩০ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়িটির নাম র‌্যাংকন আইকন টাওয়ার লেক ভিউ। ভবনের ১২ ও ১৩তম তলায় আট হাজার ৬০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে তাঁর। সূত্র জানায়, আট হাজার ৬০০ বর্গফুটের এই অ্যাপার্টমেন্টের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।

ভবনটি নির্মাণ করে র‌্যাংকন ডেভেলপমেন্টস। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯.৭৫ কাঠা জমিতে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের আয়তন দুই হাজার ১৫০ বর্গফুট। এখানে রয়েছে ১৩টি ফ্লোর এবং দুটি বেইসমেন্ট। সত্যতা নিশ্চিত করতে সরেজমিনে গেলে ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মো. সবুজ কালের কণ্ঠকে জানান, ১২ ও ১৩তম তলায় রয়েছে বেনজীরের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট।

এ ছাড়া রাজধানীর মগবাজার আদ-দ্বীন হাসপাতাল সংলগ্ন ইস্টার্ন প্রপ্রার্টিজের একটি বহুতল ভবনে চার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বেনজীর আহমেদ।

পূর্বাচলে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেছেন বেনজীর আহমেদ। আনন্দ হাউজিং সোসাইটির দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় পোড়া মোড়ের পাশের এলাকায় অন্তত ৪০ কাঠা জমির ওপর গড়েছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। জমি ও বাড়ির মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা বলে ধারণা স্থানীয়দের।

ওই এলাকার বাসিন্দা মো. শাহাদাত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই এলাকা ডোবা ও বিল হিসেবে আমরা দেখেছি। কিছুদিন আগেও এসব এলাকায় আমরা মাছ ধরেছি। পুলিশের কর্মকর্তারা আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার পরপরই বেনজীর আহমেদ এই জায়গায় মাটি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

দীর্ঘদিন ধরেই আনন্দ হাউজিং সংলগ্ন এলাকায় অটো চালান মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, সোসাইটির ভেতরে সবচেয়ে দামি বাড়ি এটি। আনন্দ হাউজিং এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে বেনজীরের ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেখার জন্য মাঝেমধ্যে ভিড় জমায় সাধারণ মানুষ।

রাজধানীর পূর্বাচলের ফারুক মার্কেটের পেছনের দিকে ১৭ নম্বর সেক্টরের ৩০১ নম্বর রোডের জি ব্লকে ১০ নম্বর প্লটের মালিক পুলিশের সাবেক এই আইজি। স্থানীয়রা বলছেন, ১০ কাঠা পরিমাণের এই প্লটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২২ কোটি টাকা। বেনজীর আহমেদ পুলিশের আইজি থাকাকালে এই প্লট কেনেন। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, পুলিশের এই সাবেক আইজি তাঁর ১০ কাঠার প্লটটি বিক্রির পরিকল্পনা করছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু ক্রেতার সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। ওই এলাকার মোহাম্মদ নাঈম, আব্দুল কাদের ও মোহাম্মদ মোহসিন নামের তিন ব্যক্তি পুলিশের সাবেক এই আইজির ১০ কাঠার প্লটটির বিষয়ে কালের কণ্ঠর সঙ্গে আলাপকালে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নাওড়ায় বেনজীর আহমেদের রয়েছে দুই বিঘা জমি, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।

বেনজীরের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

বেনজীর আহমেদ পুলিশের একজন প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, এ ক্ষেত্রে দুদক কতটুকু কী করতে পারবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে। সুতরাং যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে।

জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই অনুসন্ধান করা হবে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, কারো বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে পর্যাপ্ত সাপোর্টিং পেপারস আমাদের কাছে থাকতে হয়।

তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট ও সঠিক তথ্য পেলে দুদক বেনজীর কেন, যে কারো বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান করবে। আর সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পরও যদি অনুসন্ধান না করা হয়, তাহলে দুদকের বিরুদ্ধেই তো রিপোর্ট হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে কালের কণ্ঠর পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়ে নিউজের বিষয়ে বক্তব্য প্রয়োজন বলে জানানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চলছে প্রস্তুতি

শেয়ার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চলছে প্রস্তুতি
পহেলা বৈশাখে বাঙালি মেতে উঠবে বর্ষবরণে। বাংলা বছরের প্রথম দিনকে স্বাগত জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চলছে প্রস্তুতি। শিক্ষার্থীদের কেউ ব্যস্ত রঙিন মুখোশ বানাতে, কেউ মাটির সরা রাঙাতে। আবার কেউ গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলছেন তুলির আঁচড়ে। গতকাল তোলা। ছবি : ফোকাস বাংলা
মন্তব্য
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

সাধারণ মানুষ চায় এই সরকার আরো পাঁচ বছর থাক

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
শেয়ার
সাধারণ মানুষ চায় এই সরকার আরো পাঁচ বছর থাক
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, সাধারণ মানুষ চাচ্ছে এই সরকার আরো পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ থানা পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের থানাগুলোর নিজস্ব অনেক হাতিয়ার হারিয়েছে। এগুলো উদ্ধারে কাজ চলছে।

হারানো হাতিয়ার উদ্ধার হলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে।

শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এসব প্রশ্ন পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে করবেন। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের অপরাধীদের আনার চুক্তি আছে। সেটার আলোকে ফেরত আনার চেষ্টা চলবে।

হাওরের কৃষির উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, হাওরসহ সারা দেশে অনেক জমি পড়ে আছে। আমরা এই জমি চাষের আওতায় আনতে ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছি। যার মাধ্যমে পতিত জমি চাষের আওতায় আনা হবে।

থানা পরিদর্শনের পর স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরে ধানকাটা কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা উন নবী, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মুশফেকুর রহমান, জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া প্রমুখ।

লালগালিচা দেখে রেগে গেলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিদর্শনে আসবেন তাই সিলেট বিমানবন্দর থানায় তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার দেওয়ার আয়োজন করে পুলিশ প্রশাসন। এসব আয়োজন দেখে রেগে আগুন হয়ে যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

ঢাকা থেকে বিমানে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এরপর সেখান থেকে তিনি যান বিমানবন্দর থানা পরিদর্শনে।

উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষে বিমানবন্দর থানায় বিছানো হয় লালগালিচা। আয়োজন করা হয় গার্ড অব অনারের। এসব দেখে রেগে গিয়ে পুলিশ কমিশনারসহ কর্মকর্তাদের ভর্ত্সনা করেন তিনি। রেগে গিয়ে তিনি বলেন, যেটা না করি সেটা আকামটা করো। কামটা না করে আকামটা করো।

মন্তব্য

শেখ হাসিনা-পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
শেখ হাসিনা-পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

রাজধানীর পূর্বাচলে দশ কাঠার প্লট জালিয়াতির ঘটনায় করা মামলায় পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার এই আদেশ দেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৪ মে তারিখ ধার্য করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা-পুতুল ছাড়াও অপর ১৬ জন আসামি হলেন জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের পিএ মো. আনিছুর রহমান মিঞা, রাজউকের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, কবির আল আসাদ, তন্ময় দাস, মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, মো. নুরুল ইসলাম, পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম, উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান ও হাবিবুর রহমান এবং তদন্তে প্রাপ্ত আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন ও সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ।

এর আগে গত ১২ জানুয়ারি দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া বাদী হয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর মেয়ে পুতুলসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। একই সঙ্গে মামলার অভিযোগপত্রে ১৬ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মালিকানায় ঢাকা শহরে রাজউকের এখতিয়ারাধীন এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরও সেটি গোপন করে পূর্বাচল নতুন শহর আবাসন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত আইন, বিধি ও নীতিমালা এবং আইনানুগ পদ্ধতি লঙ্ঘন করে মা শেখ হাসিনার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

সরকারের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে বহাল থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে প্রকল্পের বরাদ্দ বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত গণকর্মচারীদের প্রভাবিত করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইনসম্মত পারিশ্রমিক না হওয়া সত্ত্বেও, আইনমতে বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর যোগসাজশে নিজেরা লাভবান হয়ে ও অন্যকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার ১৭ নম্বর প্লট সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন। প্রতারণামূলক অবৈধ পারিতোষিক দেওয়া ও নেওয়া এবং অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গ ও বেআইনি অনুগ্রহ প্রদর্শনের মাধ্যমে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে দণ্ডবিধি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে দণ্ডযোগ্য অপরাধ করেছেন।

 

মন্তব্য
মানবতাবিরোধী অপরাধ

চূড়ান্ত পর্যায়ে চার মামলা তদন্তে আরো ৩৫টি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
চূড়ান্ত পর্যায়ে চার মামলা তদন্তে আরো ৩৫টি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ পর্যন্ত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ৩৩০টি অভিযোগ জমা পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৩৯টি অভিযোগের তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের খবর সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ, মামলার তদন্ত ও আসামিদের গ্রেপ্তারের হালনাগাদ তথ্যের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ২২টি মিসকেস (বিবিধ মামলা) করা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত ১৪১ জন। প্রসিকিউশনের আবেদনে তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরোয়ানা জারির পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৪ জনকে।

বাকি ৮৭ জন পলাতক।

অভিযুক্ত ১৪১ জনের মধ্যে বেসামরিক ব্যক্তি রয়েছেন ৭০ জন, পুলিশ সদস্য ৬২ জন এবং সামরিক বাহিনীর ৯ জন সদস্য রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে ৮ আগস্ট গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

এই সরকারে আইন উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক আসিফ নজরুল ঘোষণা দেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। সে ঘোষণা অনুযায়ী প্রথমে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠনের পর ১৪ অক্টোবর রাতে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৭ অক্টোবর বিচারকাজে বসেন পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল। বিচারিক কাজের প্রথম দিনই শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরে বিভিন্ন সময় ৯৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

 

চার মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে

তদন্তকাজের অগ্রগতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলাসহ মোট চারটি মামলার তদন্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে।

স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হতে পারে। এই চার মামলার মধ্যে অন্য তিনটি হলো সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলা, রাজধানীর চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা এবং রাজধানীর রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা ব্যক্তির ওপর গুলির ঘটনায় হওয়া মামলা। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এতে আরো বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত এক হাজার জনের বেশি ব্যক্তির সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ভিডিওসহ ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, যার মধ্যে এক হাজারের বেশি ভিডিও ক্লিপ রয়েছে। এ ছাড়া গুমবিষয়ক তদন্ত কার্যক্রমে ঢাকা শহরের তিনটি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় গুমের তিনটি কেন্দ্র (আয়নাঘর, হাসপাতাল, এলআইসি ইত্যাদি বিভিন্ন কোড নেমে পরিচিত) পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা, সিলেট, রংপুরসহ ১৫টি জেলায় তদন্তকাজ চালানো হয়েছে। তদন্তকাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা পর্যায়ে চারটি গণশুনানি হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পতিত সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করছে। থানা, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্র পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পলাতক সুবিধাভোগীরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তদন্ত কার্যক্রম এবং বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।

 

বোমা হামলা-ষড়যন্ত্র

গুমের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে আয়নাঘর নামে পরিচিত গোপন বন্দিশালা বা নির্যাতনকক্ষে টাইমারসহ বোমা উদ্ধারের কথা চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের আগেই জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউশন টিমের ওপর সরাসরি প্রাণঘাতী বোমা হামলার চেষ্টা হয়েছে। প্রসিকিউটরদের সম্পর্কে গুজব ও ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে জনমনে, বিশেষ করে শহীদ পরিবারগুলোকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। তদন্ত ও বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করতে বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনতে বিপুল টাকা ব্যয়ে ব্রিটেনের বিখ্যাত ডটি স্ট্রিট চেম্বার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মতবিনিময়সভায় প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার, মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম, আবদুল্লাহ আল নোমান, সাইমুম রেজা ও আব্দুস সাত্তার পালোয়ান উপস্থিত ছিলেন।

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ