জগন্নাথ হলে এখন প্রায় ৬৫টি কুকুর-বিড়ালকে খাওয়ান সুধন। ছবি : লুৎফর রহমান
মাঠের এক কোণে বসে কাঁদছেন একজন। তাঁর চারপাশে ঘুরঘুর করছে বেশ কয়েকটি কুকুর। তিনি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘তোদের জন্য কিছু করতে পারছি না রে! আমারে মাফ কইরা দিস।’
কৌতূহলবশে জানতে চাইলাম, এই মাফ চাওয়ার কারণ কী? এবার কান্নার ঢল নামল তাঁর চোখে।
একটা কুকুরের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘দেখেন না, খাবারের অভাবে বাবুটার হাড্ডি দেখা যাচ্ছে! আমার পরাণটা মানছে না। ওদের খাবারও দিতে পারছি না।’
খাবার দিতে সমস্যা কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করেছে। হলে নাকি কুকুর বেড়ে গেছে।
খাবার বন্ধ করে দিলে কুকুরগুলো অন্য কোথাও চলে যাবে। আমার তো হাত-পা বান্ধা!’
তিনি নিজেও না খাওয়া। জানালেন, কুকুরগুলো অভুক্ত থাকলে তাঁর মুখ দিয়ে কিছু নামে না।
এটা দিন দশেক আগের কথা।
গতকাল আবার তাঁর সঙ্গে দেখা। মুখে এবার আকর্ণ হাসি। সেই মাঠেই কুকুরদের খাওয়াচ্ছিলেন। বললেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্রদের একটা সংগঠন (অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার টিম) আছে। তারা প্রভোস্ট স্যারের সঙ্গে কথা বলেছে।
এখন আর খাবার দিতে বাধা নাই!’
আলাভোলা এই মানুষটার নাম সুধন চন্দ্র বর্মণ। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। পেশায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী। স্বল্প আয় হলেও রোজগারের একটা ভাগ ব্যয় করেন কুকুর-বিড়ালের খাওয়ার জোগাড়ে। অথচ এগুলো তাঁর পোষাও নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে এভাবে প্রায় দুই দশক ধরে কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াচ্ছেন সুধন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার টিমের সদস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী মিশকাত তানিশা বলেন, ‘সুধনদার সঙ্গে হল প্রশাসনের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। ওদের খাওয়ানোর জন্য কিছু জায়গা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই নিয়মিত খাবার দিচ্ছেন।’
টেনেটুনে দিন গুজরান
সুধনের জন্ম গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। চার ভাই-বোনের সংসারে তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরাত। তাই পড়াশোনায় বেশি এগোতে পারেননি। তেজগাঁওয়ে একটা অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। একসময় মিরপুর চলে যান।
জগন্নাথ হলে প্রথম আসেন ১৯৮৫ সালে। সেবার হলের টিভি রুমের ছাদ ধসে প্রাণ হারান অনেক শিক্ষার্থী। তখন ছাত্রসংসদের পিয়ন ছিলেন চিত্তরঞ্জন দেবনাথ। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে তাঁর মেয়ে মালতি রানীর সঙ্গে বিয়ে হয় সুধনের। এর পর আরো দুটি কারখানায় কাজ করে বছরখানেক পর আবার চলে আসেন জগন্নাথ হলে। তখন হলের প্রভোস্ট ছিলেন দুর্গাদাস ভট্টাচার্য। বদলি ডিউটির (কেউ ছুটিতে থাকলে তাঁর বদলি হিসেবে) জন্য সুধনকে নিয়োগ দেন তিনি। ২১ টাকা বেতন। সেই থেকে জগন্নাথ হলেই আছেন। এত দিন মাস্টার রোলে কাজ করেছেন। কিছু দিন আগে ‘সাময়িক কর্মচারী’ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এখন বেতন পান মোটে ১০ হাজার। এই টাকায় কোনোমতে টেনেটুনে চারজনের সংসার চালান।
৬৫ কুকুর-বিড়ালের জন্য খাবার
কাউকে কিছু খেতে দেখলে কুকুর গিয়ে কাছে দাঁড়ায়। সুধনের মনে এটা নাড়া দেয়—আহা, ওদেরও তো ক্ষুধা লাগে! সেই থেকে কুকুরকে খাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হন। একই সঙ্গে বিড়ালকেও খাওয়াতে থাকেন।
জগন্নাথ হলে এখন ৫০টির মতো কুকুর ও ১৫টি বিড়াল আছে বলে জানালেন সুধন। হলের মাঠে, গ্যালারিতে, অক্টোবর ভবনের বারান্দায়, উত্তরবাড়িতে, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন, রবীন্দ্র ভবন, মেইন গেটে থাকে ওরা। একসঙ্গে অনেক খাবার জোগাড় করতে পারেন না তিনি। একসঙ্গে খাওয়াতে গেলে গোলমালও বাধে। তাই পালা করে সব কয়টিকে খাওয়ান।
মাছের কাঁটা, মাছের মাথা, মাংস, হাড্ডি, ভাত—কুকুর এগুলোই বেশি খায়। নিরামিষ মেস, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন ক্যাফেটেরিয়া, রবীন্দ্র ভবন ক্যাফেটেরিয়া থেকে এগুলো জোগাড় করেন সুধন। তবে ঈদের ছুটির কারণে এখন শুধু সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন ক্যাফেটেরিয়া খোলা। তাই খাবার কম পড়ে যায়। ঘাটতি পোষাতে অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার টিমের সহায়তায় তিনি নিজে পাঁচ কেজি চাল আর দুই কেজি মুরগির মাংস (মূলত মাথা, গিলা, কলিজা) রান্না করছেন।
তবে কুকুর বিস্কুট বেশি পছন্দ করে—জানালেন সুধন। বিশেষ পছন্দ ড্রাই কেক। সুধন বলেন, ‘ড্রাই কেক ভালো খায় ওরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে বেকারির লোক এলে তাদের কাছ থেকে নিই। যেদিন যেমন টাকা থাকে সেদিন তেমন কিনি। এক কেজি দিয়ে দুই দিনের মতো চালাই।’
হাতে টাকা না থাকলে বাকিতেও কেনেন সুধন। বললেন, ‘বেকারির লোকজন চেনা হইয়া গেছে। বাকিতে দেয়। আজকাই যেমন পুরো টাকা ছিল না। দুই শ টেকা কইরা কেজি। আইজ এক কেজি নিয়া ৫০ টাকা দিছি।’
ঘুরে ঘুরে খাবার জোগাড়
সাধারণত দিনে দুইবার খাবার দেন ওদের। সকালে বিস্কুট, দুপুরে ভাত, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড্ডি এসব। হলের খাবার দেওয়া শুরু হয় দুপুর ১২টার দিকে। দেড়টার দিকে একটা বালতি নিয়ে সেখানে হাজির হন সুধন। বলেন, ‘দাদা, আমার একটু এঁটো আর কাঁটাকুটা লাগব।’
রবীন্দ্র ভবন ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালক শংকর বিশ্বাস বলেন, ‘লোকটা বেশ সহজ-সরল। কুকুরগুলো যখন তাঁর পেছনে হাঁটে, দেখে বড় ভালো লাগে!’
সন্তোষ চন্দ্র ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালক মনির বলেন, ‘ক্যান্টিন বয়দের বলে দিয়েছি, ওরা এখন উচ্ছিষ্ট এক জায়গায় রেখে দেয় সুধনদার জন্য।’
আনন্দের মাঝে বিড়ম্বনা
কুকুর-বিড়ালকে নিয়মিত খাওয়ানোয় সুধনকে অনেকে সাধুবাদ জানান। কেউ কেউ সাধ্যমতো টাকাও দেন। কোনো কুকুর অসুস্থ হলে চিকিত্সায় অনেকে সহায়তা করেন।
তবে মাঝেমধ্যে এ জন্য ঝাড়িও খেতে হয়। বলে, ‘এই এক জিনিস নিয়া পইড়া আছ! খালি ঘ্যান ঘ্যান!’
তাঁর স্ত্রী মালতি রানী বললেন, ‘কুত্তা-বিলাইরে খাবার দেয় বইলা লোকটার চাকরি নিয়াও টানাটানি। মাইনষেও কথা শোনায়। কতবার যে মানা করেছি। কে শোনে কার কথা!’
একটা আফসোস
এখন জগন্নাথ হলে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবনের পেছনে থাকেন সুধন। ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জনক। বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগে অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি পেয়েছেন।
ভোরের আলো ফোটার আগে ঘুম ভাঙে সুধনের। প্রথমে হলের পুকুরপারের লাইট নেভান। এর পর সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনে এসে ফ্লোর ঝাড়ু দেন। এভাবে সারা দিন কাটে পরিচ্ছন্নতার বিভিন্ন কাজে।
জীবনের এই বেলায় এসে একটা আফসোস রয়ে গেছে তাঁর—চাকরিটা আজও স্থায়ী হয়নি! বললেন, ‘চাকরি আজ আছে কাল নাই অবস্থা। চাকরিটা স্থায়ী হলে শেষ বয়সে পেনশনসহ কিছু সুবিধা পেতাম!’
স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী তাসরিন মুজিবের নামে থাকা ফ্ল্যাটসহ ৭৯ শতক জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁদের নামে থাকা ৩৪টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে এক কোটি ৪৪ লাখ ৯৯ হাজার ২০০ টাকা রয়েছে।
গতকাল রবিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম এই তথ্য জানিয়েছেন।
জব্দ হওয়া সম্পদের মধ্যে মুজিবুর রহমানের নিজ নামে থাকা মিরপুরের মাটিকাটায় চার হাজার ৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে থাকা একটি প্লটসহ চার দলিলে খিলক্ষেত, মিরপুর, সাভার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জমি এবং স্ত্রীর নামে থাকা ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের সাহারা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের বাউনিয়া এলাকায় সাত দলিলে জমি রয়েছে। এ ছাড়া অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাবের মধ্যে মুজিবুর রহমানের ২৪টি ও তাঁর স্ত্রীর ১০টি হিসাব রয়েছে।
এদিন দুদকের উপপরিচালক মো. সিরাজুল হক জব্দ ও অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন।
দুদকের পক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করেন। আবেদনে বলা হয়েছে, মুজিবুর রহমানের সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে ভোগদখলে রাখার অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন। তাঁর বিরুদ্ধে পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে অপরাধমূলক অসদাচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসাধু উপায়ে নিজ নামে এবং তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানা অর্জন করে দখলে রাখা এবং বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন করে মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ ‘দুর্নীতি ও ঘুষ’ সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে তা রূপান্তর, স্থানান্তর ও হস্তান্তর করার অভিযোগ রয়েছে।
তিনি অবৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদ অন্যত্র বিক্রয় বা হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার প্রচেষ্টায় রয়েছেন। এ কারণে তাঁর নিজ নামে, তাঁর স্ত্রী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন। তাঁদের স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাবসমূহ অবরুদ্ধ করা না গেলে বিচারকালে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না। এতে রাষ্ট্রের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত মুজিবুর রহমান এসএসএফের মহাপরিচালক ছিলেন।
এরপর তাঁকে ময়মনসিংহে আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি পদ থেকে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর মুজিবুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়। এর আগে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মুজিবুর রহমান সেনা সদর দপ্তরে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন।
হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রীর ৬৫ অ্যাকাউন্টে ৭২২ কোটি টাকা লেনদেন
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
হাছান মাহমুদ
প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৭২২ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী নূরান ফাতেমার বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) মামলা দুটি করা হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রথম মামলায় হাছান মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এক কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৩১৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা দখলে রাখা এবং ৯টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫৬৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আর দ্বিতীয় মামলায় নূরান ফাতেমা ও তাঁর স্বামী হাছান মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় পরস্পর যোগসাজশে জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ৭৬ হাজার ৯০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা দখলে রাখা এবং ৫৬টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৬৮৩ কোটি ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫৪ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) (৩) ধারা; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলা দুটি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়, তাতে তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর আগের সরকারে তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হাছান মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছিল আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
ওই নির্দেশ সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিএফআইইউর নির্দেশে বলা হয়েছিল, মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী নূরান ফাতেমা ও মেয়ে নাফিসা জুমাইনা মাহমুদের ব্যক্তিগত ও ব্যাবসায়িক হিসাব জব্দ করতে হবে। ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় ওই নির্দেশ দেওয়া হয়।
পতিত আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল মাত্র পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতকে গভীর খাদে নিক্ষেপ করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়ন, তাঁর সময় ব্যাংকে নিয়ম-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে ব্যাংকঋণ প্রদানের ঘটনা ঘটেছে অহরহ। সেসব ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। যা ছিল মোট ঋণের ১০.৩০ শতাংশ। আর তিনি যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অবসরে যান তখন ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটিতে।
এর মধ্যে স্বল্প টাকায় ঋণ পুনঃ তফসিল, ঋণের টাকায় ঋণ পরিশোধ, ঋণ পরিশোধ না করেও নিয়মিত গ্রাহক থাকাসহ নানা রকম সুযোগ-সবিধা দিয়েছেন তিনি। তাঁর অর্থমন্ত্রী থাকার সময় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৫১ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন তিন লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি নিজ দপ্তরে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।
কিন্তু নিজেই ঋণখেলাপি হয়ে বসে ছিলেন। ব্যাংকের তথ্য মতে, সোনালী ব্যাংকের গ্রাহক লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের মালিক আ হ ম মুস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল এবং স্ত্রী কাশমেরী কামাল। কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল মুস্তফা কামালের হাতে। সোনালী ব্যাংক থেকে কম্পানিটির ঋণের পরিমাণ এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর মাসিক কিস্তি ২৭ লাখ টাকা।
সে কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ না করায় ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়ে। তার পরও নিয়ম ভঙ্গ করেই কম্পানিটিকে ভালো গ্রাহক হিসেবে দেখিয়ে আসছিল সোনালী ব্যাংক। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিষয়টি নজরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিমের। শুধু লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত গ্রাহক বা আন-ক্লাসিফায়েড হিসেবে দেখানো হচ্ছিল আরো অনেক কম্পানিকে।
সূত্র জানায়, লোটাস কামালের বিরুদ্ধে যাতে ব্যবস্থা না নেওয়া হয় সে জন্য শাসানো হতো তদন্ত কর্মকর্তাদের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুসন্ধানী দলের কর্মকর্তা শাজু এস হোসোইল ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ঘটনা ঠিক কভিডের আগে। সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ইন্সপেকশনে গিয়েছিলাম ২০২০ সালের জানুয়ারির ১৯-২০ তারিখের দিকে। সেখানে লোন ক্লাসিফিকেশনের কনসোলিডেটেড সিএলের এক্সেল শিটে ফিল্টার করে দেখি অবজেক্টিভ ক্রাইটেরিয়ায় ক্লাসিফায়েড হওয়া লোন আন-ক্লাসিফায়েড বানানো হয়েছে। প্রায় ১.৫-২ হাজার কোটি টাকার এই লিস্টে অনেক কম্পানির নাম। এই লিস্টের একটা কম্পানি ছিল ‘লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং’, যার অফিশিয়াল মালিক তখনকার অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের মেয়ে ও স্ত্রী। ঋণের বকেয়া ১.৭৫ কোটি টাকা, আর কিস্তি মাত্র ১৮ লাখ টাকার মতো। মাত্র ১৮ লাখের কিস্তি, তা-ও তিনি নিয়মিত পরিশোধ করেন না বলে সেটা সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা অন্তত তিন মাস (অথবা ৯ মাস পরের সার্কুলার অনুযায়ী, মনে নেই) ধরে বকেয়া ছিল। মেমো দেওয়ার পর সোনালীর লোকজন অনেক হম্বিতম্বি করেছে, সময়ক্ষেপণ করেছে জবাব দেওয়ার। টিম লিডার বহলুল স্যারকেসহ আমাদের চেম্বারে ডেকে তখনকার এমডি ধমকের সুরে বলেছিলেন, ‘এই বহলুল, এগুলা কি শুরু করলেন।’
তিনি আরো লেখেন, ‘কামাল সাহেবকে এর পরে খেলাপি ঋণ নিয়ে মিডিয়াতে বড় বড় কথা বলতে দেখতাম। এমনকি খেলাপি আর এক টাকাও বাড়বে না এমন বক্তব্যও দিতে শুনতাম। ওই সময়টায় আমি বলতাম, যে দেশের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের টাকা দেন না, সে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার কথা সত্যি হতে বেশি সময় নেয়নি। পালানোর তালিকায় উনার নাম সবার আগে দেখলাম। কেন? আপনারা এখন জানেন।’
শেয়ারবাজার কারসাজি : ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় লোটাস কামালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে। তিনি তখন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। নানা অভিযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি লোটাস কামালকে। অনেকের অভিযোগ, তাঁর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিঃস্ব হয়েছেন শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। লোপাট করে নেওয়া হয়েছে তাঁদের পুঁজি।
২০১০ সালের শেয়ারবাজার কারসাজিতে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামালের পকেটে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা গেছে বলে বিভিন্ন তদন্তে জানা যায়। শেয়ার জালিয়াতি করে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালের ওই কেলেঙ্কারির পর কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।
ব্যাংক হিসাব জব্দের আগেই সরানো হয় টাকা : গত ২২ আগস্ট আ হ ম মুস্তফা কামাল, তাঁর স্ত্রী কাশমেরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামালের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে তাঁদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়। সূত্রের দাবি, দেশে-বিদেশে মুস্তফা কামাল ও তাঁর স্বজনের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। সরকার পতনের আগেই কামাল ব্যাংক, রাজধানীর বাসা-অফিস থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার সরিয়ে নিয়েছেন।
লোটাস কামালের বর্তমান দায় : জানা যায়, এখনো সোনালী, পদ্মা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে দায়-দেনা পরিশোধ বকেয়া রয়েছে মুস্তফা কামালের। দেনা পরিশোধ না করার পরও তাঁকে খেলাপি দেখাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের এখনো লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাঁচ হাজার ১৯৩ টাকা পাওনা রয়েছে। কিন্তু এই তথ্য মানতে নারাজ সোনালী ব্যাংক লোকাল অফিস। ব্যাংক জানায়, ঋণ পরিশোধ হয়ে গেছে।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখায় এখনো ৯৯ লাখ টাকার এলসি বকেয়া রয়েছে মুস্তফা কামালের। ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর এলসি পরিশোধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ঋণটি বকেয়া রয়েছে। পদ্মা ব্যাংকে পর পর দুটি এলসি করে কোনো টাকা পরিশোধ করেননি সাবেক এই অর্থমন্ত্রী। প্রথম এলসিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ। যেখানে বকেয়ার পরিমাণ চার কোটি ৫০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় এলসি পরিশোধের শেষ তারিখ ছিল ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল। এখানেও চার কোটি ৫০ লাখ টাকা বকেয়া রেখেছেন কামাল। বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য চলতি দায়িত্বে থাকা পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কাজী মো. তালহা জানান, তাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা ছিল অনেক আগে। এখন কোনো ব্যবসাও নেই, আর বকেয়াও নেই। হয়তো কোথাও কোনো তথ্যগত ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।