সবার সহযোগিতা নিয়ে আমরা আবারও জলদস্যু মুক্ত করব।’
সূত্র জানায়, গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর জলদস্যুরা আবারও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে শুরু করে। সুন্দরবনে বর্তমানে অন্তত ১০টি বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে কলিম শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মজনু বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবিউল বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, মাসুম বিল্লাহ ও ভাগ্নে বাহিনীসহ ১০টি বাহিনী। এসব বাহিনীর নেপথ্যে কাজ করছে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের অনেকে।
বর্তমানে যা ঘটছে
গত বুধবার সকালে মাছ ও কাঁকড়া আহরণে খুলনার কয়রা থেকে সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা করেন ছয় নারীসহ ৩৩ জন জেলে। পথে তাঁদের অপহরণ করে জলদস্যু কলিম শরীফ বাহিনী। তাঁদের জিম্মি করে প্রতি জনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে এ খবর জানতে পেরে ওই দিনই বাগেরহাটের কোস্ট গার্ড সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। পরে করকরি নদীর মাল্লাখালী এলাকা থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। অভিযানের সময় কোস্ট গার্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতদল ফাঁকা গুলি ছুড়ে বনের মধ্যে পালিয়ে যায়।
এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি দুবলার চরসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জেলেদের অপহরণের চেষ্টাকালে তিন জলদস্যুকে মারধর করে আটক করেন জেলেরা। পরে আটক ব্যক্তিদের কোস্ট গার্ডের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কোস্ট গার্ড তাদের শরণখোলা থানায় হস্তান্তর করে।
শরণখোলা থানার ওসি মো. শহিদুল্লাহ গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, মজনু বাহিনী বাগেরহাটের দুবলার চর থেকে জেলেদের অপহরণ করতে চাইলে জেলেরা একত্রিত হয়ে তিন জলদস্যুকে ধরে ফেলে।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামের জেলে মো. ইয়াসিনকে গত ৪ মার্চ রাতে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনে শরীফ বাহিনী অপহরণ করে। তিনি সুন্দরবনের শ্যালার চর শুঁটকি পল্লীর মৎস্য ব্যবসায়ী খুলনার মিঠু কমিশনারের ট্রলারের মাঝি। দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সদস্য মৎস্য ব্যবসায়ী মিঠু কমিশনার জানান, রাত সাড়ে ১১টার দিকে সশস্ত্র জলদস্যুরা একটি ট্রলারে এসে জেলেদের ট্রলারে হানা দেয়। জলদস্যুরা প্রথমে মারপিট শুরু করে। পরে ট্রলারের মাঝি মো. ইয়াসিনকে তুলে নিয়ে যায়।
গত ২ এপ্রিল বরগুনা পাথরঘাটা এলাকা থেকে চারটি ফিশিং ট্রলারে ৬৭ জন জেলে মাছ শিকারের জন্য গভীর সমুদ্রে যায়। ৯ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে বরগুনার তালতলী উপজেলাধীন সকিনার মোহনাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুরা ট্রলারগুলোতে আক্রমণ করে। এতে দুজন জেলে গুলিবিদ্ধ হন এবং চলে যাওয়ার সময় জলদস্যুরা ট্রলারগুলোর ইঞ্জিন বিকল করে দিয়ে যায়। পরে গত বৃহস্পতিবার ট্রলার মালিক সেলিম চৌধুরী বিষয়টি কোস্ট গার্ডকে অবহিত করে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের অদূরে সাগরে মাছ ধরার সময় জলদস্যুর কবলে পড়ে একটি মাছ ধরার ট্রলার। এ সময় ওই ট্রলারের জেলে বেলালের হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে দস্যুদল। এরপর অন্য জেলেদের হত্যার হুমকি দিয়ে ট্রলারটিতে থাকা মাছ, ব্যবহৃত মোবাইল ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে ইঞ্জিন ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যায় দস্যুদল। পরে দস্যুদলের কবলে পড়া জেলেরা ৯৯৯-এ কল দিলে কক্সবাজারের উপকূলবর্তী সোনাদিয়া দ্বীপ সন্নিহিত সাগরে অভিযান চালিয়ে লুট করা মাছসহ ১৮ জলদস্যুকে আটক করে কোস্ট গার্ড।
গত ৬ এপ্রিল হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়নের বয়রার চর টাংকির ঘাট এলাকার জলদস্যু আব্দুর রব ও তাঁর সহযোগী আহছান উল্লাহকে (৫২) আটক করেছে হাতিয়া থানা পুলিশ।
গত ২৮ মার্চ নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরগাশিয়ার কুখ্যাত জলদস্যু ফখরুল ইসলামের (ফকরা ডাকাত) প্রধান সহযোগী নাসির উদ্দিনকে (৩৪) আটক করেছে হাতিয়া কোস্ট গার্ড। পরে তাঁদের হাতিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়।
আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের অনেকে ভিন্ন পেশায়
তবে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের কেউ কেউ সৎপথেও আছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাঁদের কেউ কেউ মাছ শিকার, লবণ চাষ ও নাইট গার্ডের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ আবার জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। আত্মসমর্পণকারী জলদুস্যদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
সূত্র জানায়, একসময় আত্মসমর্পণকারীরা সুন্দরবনের শিবসা নদীসংলগ্ন বিভিন্ন খাল ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের কাটেশ্বর ও সাপখালীসংলগ্ন অঞ্চলের বনজীবী ও জলজীবী সাধারণ মানুষকে নিশানা করে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করত। এ ছাড়া অপহরণ করাও ছিল তাদের কাজ। এ অবস্থায় ২০১৬ সালে জলদুস্যরা র্যাবের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেয়। এরপর ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু শান্ত বাহিনী ও আলম বাহিনীর প্রধানসহ ১৪ সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বরিশাল র্যাব-৮-এর কার্যালয়ে ১৪ বনদস্যু ২০টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার আট রাউন্ড গোলাবারুদও জমা দেয় সেদিন।
এরপর ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনীর ২০ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এরপর চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া উপকূলীয় এলাকায় ২০১৮, ২০২০ ও ২০২৪ সালে আত্মসমর্পণ করে ১২৭ জন জলদস্যু। তাঁরা একসময় বঙ্গোপসাগরের পেশাদার জলদস্যু হিসেবে পরিচিত ছিল। তাঁদের মধ্যে রহিমা বেগম নামের এক নারীও ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার এলাকার আত্মসমর্পণ করা ১২৭ জনের বেশির ভাগ কক্সবাজার অঞ্চলে মাছ শিকার, লবণ চাষ, নাইট গার্ডসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে সুন্দরবন ও কক্সবাজার এলাকার আত্মসমর্পণকারী জলদুস্যুদের কেউ কেউ গোপনে নতুন করে জলদস্যুদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। তাদের দলকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দারা তৎপরতা চালাচ্ছেন।
চলতি বছর গত ২৩ মার্চ সকাল ১১টার দিকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা পরিষদ হলরুমে র্যাবের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ করা জলদুস্যদের ঈদ উপহার দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জলদুস্য রানী খ্যাত রহিমা বেগম বলেন, অনেক মামলার আসামি হয়েছি, মামলাগুলো এখনো চলমান রয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে।
আত্মসমর্পণ করা জলদস্যু আবদুল হাকিম বাইশ্যা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০২০ সালে আত্মসমর্পণের পর আমাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১১ মাস পর কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছি।’
তিনি জানান, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়। এলাকার লোকজন তাঁকে মেম্বার পদে নির্বাচনের জন্য বলে। তিনি বাশখালী সনুয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জীবিকা হিসেবে তিনি ও তাঁর মতো অনেকে এখন মাছ ধরার কাজ করেন।’ তিনি বলেন, ‘ভালো মানুষ হয়ে যাওয়ার পর এখন অনেক সুখে দিন চলছে আমাদের।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুনেছি কক্সবাজার এলাকায় আত্মসমর্পণকারীদের মাঝে কেউ কেউ নতুন করে জলদস্যুতায় জড়াচ্ছে।’
বাগের হাটের এসপি তৌহিদুল আরিফ বলেন, ‘জলদস্যুরা আবারও সংগঠিত হচ্ছে—এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি রোধ করার জন্য।’
সাতক্ষীরার এসপি মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবন বিশাল এরিয়া। শুধু পুলিশ নয়, র্যাব ও কোস্ট গার্ড দায়িত্ব পালন করে। আমরা চেষ্টা করছি কোনো জলদুস্য যাতে কোনো কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে।’