মহামারি করোনার মধ্যেই কয়েক মাস ধরে আমদানি ও রপ্তানি দুই-ই বাড়ছে। তবে আমদানি যে হারে বাড়ছে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম হারে বাড়ছে রপ্তানি। এতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সদ্যঃসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২৩ শতাংশ এবং চলতি মুদ্রানীতিতে নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রায় ৮ শতাংশ বেশি।
বড় বাণিজ্য ঘাটতির পথে দেশ
জিয়াদুল ইসলাম

চলতি মুদ্রানীতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাণিজ্য ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয় এক হাজার ৮৩৯ কোটি ডলার।
সাধারণত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়ে। আর চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলে বিদেশের সঙ্গে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়। তবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক অনুদান ও ঋণের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। গত ২৯ জুন প্রথমবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৬০০ কোটি ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে।
গত বছরের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করে। এর পর টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির কবলে পড়ে দেশ। ওই সময় কলকারখানাও বন্ধ রাখা হয়। এতে রপ্তানিতে বড় ধাক্কা আসার সঙ্গে আমদানিও কমে যায়। তার পরও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৭৮৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির কবলে পড়েছিল দেশ, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি ছিল। তবে সদ্যঃসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় অনেক বেশি ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে দেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট পাঁচ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে এ সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) বাংলাদেশ আয় করেছে তিন হাজার ৪৩৮ কোটি ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। এ হিসাবেই পণ্য বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৮৪ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬০৬ কোটি ডলার। এই হিসাবে ১১ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৩৭৮ কোটি ডলার বা ২৩.৫৩ শতাংশ।
যদিও এ সময়ে সেবা খাতে ঘাটতি কিছুটা কমেছে। গেল অর্থবছরের ১১ মাসে সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩০ কোটি ডলার, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৩৪ কোটি ডলার। এই খাতের বাণিজ্যে মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।
এদিকে গত অর্থবছরের ১১ মাসে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ১৮৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঘাটতি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৪৩ কোটি ডলার। মুদ্রানীতিতে চলতি হিসাবে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয় ৪৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ফলে অর্থবছর শেষে চলতি হিসাবের ঘাটতি লক্ষ্যের মধ্যেই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে রেকর্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এ সময়ে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত রয়েছে প্রায় ৮৫২ কোটি ডলার, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৪০ কোটি ডলারেরও কম।
সম্পর্কিত খবর

সব গাড়ির দাম বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রে
- খরচ বৃদ্ধির প্রায় পুরোটাই চাপবে সাধারণ মার্কিন ক্রেতাদের ওপর
আগামী ৩ মে থেকে গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানিতেও শুল্ক দিতে হবে
বাণিজ্য ডেস্ক

সারা বিশ্ব থেকে যত গাড়ি যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা হয় তার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গাড়ির ওপর ধার্য করা শুল্ক গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হচ্ছে। শুল্ক বসানোর ফলে দেশটিতে আমদানি করা গাড়ির দাম বেড়ে যাবে। আরো অনেক পণ্যের ওপরই শুল্কারোপ করেছেন ট্রাম্প।
গাড়ির ব্যবহার বেশি হলেও যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে। আগের তুলনায় তারা কম পরিমাণে গাড়ি উৎপাদন করছে। কর্মক্ষেত্র, কেনাকাটা, ভ্রমণ সব কিছুর জন্যই মার্কিনরা গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে গাড়ি বিক্রি হচ্ছে। নতুন একটি গাড়ির দাম গড়ে ৫০ হাজার ডলার।
গাড়িশিল্প নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণকারী নিউইয়র্কভিত্তিক কম্পানি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মোবিলিটি জানিয়েছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে মোট গাড়ি বিক্রির পরিমাণ ছিল এক কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে আমদানির পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি সরবরাহ করে মেক্সিকো। দেশটি গত বছর ২৫ লাখ গাড়ি পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
কানাডা থেকে ১১ লাখ গাড়ি আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও জার্মানি থেকে গাড়ি আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৭ লাখ। গাড়ির সরবরাহকারী, ডিলার ও ক্রেতার মধ্যে আরোপিত শুল্কের খরচ কিভাবে বণ্টন করা হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে বলে জানিয়েছেন গাড়ি কম্পানির এক নির্বাহী কর্মকর্তা।
সূত্র : সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস

শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি সহজ করতে চায় এনবিআর
- উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও সম্ভাব্য অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ
নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সবিহীন ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের করের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি ব্যবহার করে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈচিত্র্য ও ব্যবসা পরিচালনা সহজ হবে। প্রাথমিকভাবে বছরে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের কম রপ্তানিকারকদের জন্য এ সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করছে এনবিআরের শুল্ক বিভাগ। যা চলতি বছরের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে তিন সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশ তৈরির জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক উদ্যোক্তা এ সুবিধার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আমরা বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সের বিকল্প হিসেবে সব রপ্তানিকারকের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে এটা চালুর বিষয়ে ভাবছি।’
তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানির শুল্কের সমপরিমাণ ব্যাংক গ্যারান্টি নিশ্চিত করে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় কাঁচামাল ছাড় করা হবে।
কাঁচামাল আমদানি সহজ করতে সরকার শর্ত সাপেক্ষে শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দিচ্ছে। শর্ত হিসেবে উপকরণ নির্ধারিত গুদামে সংরক্ষণ ও রপ্তানির জন্য ব্যবহার করতে হবে।
রপ্তানিকারকরা এনবিআরের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এর সম্ভাব্য অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘কাস্টমস বর্তমানে বন্ড লাইসেন্সধারী কারখানাগুলোর অনিয়ম পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা তৈরি করছে। কিন্তু যদি বিপুলসংখ্যক নতুন কারখানাকে শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে কিভাবে নিশ্চিত করা হবে যে আমদানি করা কাঁচামাল রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, স্থানীয় বাজারে নয়? এনবিআরের সক্ষমতা শক্তিশালী করার পরই এ সুবিধা চালু করা উচিত।’
একই মত প্রকাশ করেছেন এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. লুৎফর রহমানও। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘যদি আমদানি-রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল না করা হয়, তাহলে কেবল প্রসিড রিয়েলাইজেশন সার্টিফিকেট (পিআরসি) যাচাই করেই রপ্তানির সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করে এ সুবিধা চালু করলে অপব্যবহারের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকবে।’
নাম প্রকাশ করা করার শর্তে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘পিআরসি থাকলেও রপ্তানি করা পণ্য আসলেই শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আমদানি করা কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।’
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি ভালো খবর, যদিও আমাদের এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স পেতে অক্ষম রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির একটি সহজতর ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে আসছি।’