পাইপলাইনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল আসার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে আগামী এপ্রিল মাস থেকে। তবে পরীক্ষামূলক তেল আসা শুরু হচ্ছে এই মাস থেকেই। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এখন পাইপলাইনে তেল সরবরাহ কার্যক্রমের উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে ৩০ লাখ টন তেল আসবে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে। পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিবহন ব্যয় ও তেল অপচয় ঠেকানোসহ বছরে অন্তত ২৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল আসে নদী ও সড়কপথে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মাঝেমধ্যেই তেল পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়।
এ ছাড়া নদী ও সড়কপথে তেল পরিবহনের কারণে খরচ যেমন বেশি, তেমনি তেল চুরির অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে নৌপথে নাব্যতা কমে যাওয়ায় তেল পরিবহন করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এসব সংকট নিরসনেই ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন’ নামে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। বিপিসির পদ্মা অয়েল কম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হয়। শুরুতে পাইপলাইন প্রকল্পটির ব্যয় দুই হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা ধরা হয়। পরে সংশোধিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পটির কাজ আরো দুই বছর আগে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় বিলম্ব হয়েছে।
জ্বালানি তেল পরিবহনে পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিপিসি।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আমিন উল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষামূলক তেল আনার কার্যক্রম চলবে। এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিবহন ব্যয় ও অপচয় অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন প্রকল্পের পরিচালক আমিনুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই পাইপলাইনের মাধ্যমে পুরোপুরি তেল সরবরাহ শুরু হলে বিপুল পরিমাণ পরিবহন ব্যয় ও অপচয় রোধ করা যাবে। এর মাধ্যমে আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যেই প্রকল্পের ব্যয় উঠে আসবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের জ্বালানি তেলের ৯০ শতাংশ পরিবাহিত হয় নৌপথে। তেল বিপণন কম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রায় ২০০টি অয়েল ট্যাংকার এসব জ্বালানি তেল পরিবহন করে। নৌপথে জ্বালানি তেল পরিবহনে সিস্টেম লসের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে। তা ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেল পরিবহনে সংকট তৈরি হয়। অপরদিকে বেসরকারি খাতের প্রায় ৩০ হাজার ট্যাংক লরির পাশাপাশি রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে সড়ক ও রেলপথেও জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৪ লাখ মেট্রিক টন। মোট চাহিদার প্রায় ৪০ থেকে ৪২ শতাংশই জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয় ঢাকা বিভাগে। চাহিদা পূরণে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো থেকে নৌপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, ফতুল্লা ও চাঁদপুর ডিপোতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে পরিবহন ও রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
বিপিসির দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন প্রকল্পটি দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এটি চালু হলে জ্বালানি তেল সরবরাহে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এর মাধ্যমে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে মজুদ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে নৌপথের ওপর তেল পরিবহনের নির্ভরশীলতা ও পরিবহন ঝুঁকি এবং অপারেশনাল লস কমে আসবে।’
পাইপলাইন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত সাতটি স্টেশনসহ ২৪১.২৮ কিলোমিটার ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ, গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত দুটি স্টেশনসহ ৮.২৯ কিলোমিটার ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন নদীর তলদেশ দিয়ে অন্তত ৯ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় কুমিল্লার বরুড়ায় নতুন একটি ডিপো স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে খুব সহজে কুমিল্লাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে।