ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আত্মশুদ্ধি, ইবাদতের প্রতি একাগ্রতা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ইতিকাফ সুপ্রাচীন ইবাদত হওয়ায় যুগে যুগে এর আমল হয়েছে। ইতিকাফ করার জন্য মসজিদকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নারীদের ইতিকাফের বিধান
শরিফ আহমাদ

ইতিকাফসংক্রান্ত জরুরি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো—
ইতিকাফের শর্ত
ইতিকাফের প্রধান শর্ত তিনটি—
এক. ইতিকাফের নিয়ত করতে হবে।
দুই. এমন মসজিদে ইতিকাফ হতে হবে, যেখানে নামাজের জামাত হয়—জুমার জামাত হোক বা না হোক। তিন. মহিলাদের ক্ষেত্রে হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র হতে হবে।
ইতিকাফের প্রকার
ইতিকাফ তিন প্রকার—এক. ওয়াজিব। এটা হলো মান্নতের ইতিকাফ। মান্নতের ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নত ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে গেলেও তার কাজা আদায় করা ওয়াজিব।
দুই. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। এটা হলো রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীরাও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন।
রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের আগে থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতিকাফের সময়। বড় গ্রাম বা শহরের প্রতিটি মহল্লা এবং ছোট গ্রামের পূর্ণ বসতিতে কেউ কেউ ইতিকাফ করলে সবাই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউই না করলে সবাই সুন্নত তরকের জন্য দায়ী হবে।
তিন. মুস্তাহাব বা নফল ইতিকাফ। এই ইতিকাফের জন্য কোন দিন বা সময়ের পরিমাপ নেই এবং রোজাও শর্ত নয়। অল্প সল্প সময়ের জন্যও তা হতে পারে।
মহিলাদের ইতিকাফের স্থান
পুরুষদের মতো মহিলাদের জন্যও রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ সুন্নত। এ জন্য বাড়িতে মহিলাদের নিজের ঘরে আগে থেকে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকলে সেখানে অথবা জায়গা নির্ধারিত করে সেখানে ইতিকাফ করা সর্বোত্তম। এটাই নিরাপদ এবং সওয়াব অর্জনের মাধ্যমে। তবে কোনো মহিলা যদি মসজিদে পূর্ণ পর্দার সঙ্গে ইতিকাফ করে তাহলে তা মাকরুহের সঙ্গে আদায় হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একাধিক স্ত্রী মসজিদে ইতিকাফ করতে চাওয়ায় তিনি তখন ইতিকাফ করেননি। পরে কাজা আদায় করেছেন। এখান থেকে বোঝা যায়, ইতিকাফের বিধানটি মূলত পুরুষদের জন্য মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, নারীদের জন্য নয়। (বুখারি, হাদিস : ১৯০৫)
ইতিকাফ ভাঙার কারণ
ইতিকাফ পালনের জন্য কিছু নিয়ম ও শর্ত আছে। এগুলো মেনে চলা আবশ্যক। যদি কেউ শর্তভঙ্গকারী কোনো কাজ করে তাহলে তার ইতিকাফ ভেঙে যাবে।
এক. স্ত্রী সহবাস করলে ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যায়। চাই বীর্যপাত হোক বা না হোক, ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে হোক। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। কাজেই এগুলোর নিকটবর্তী হয়ো না। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৭)
দুই. ইতিকাফের স্থান থেকে শরিয়তসম্মত প্রয়োজন বা স্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া বের হলে ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যায়। শরিয়তসম্মত প্রয়োজন হলে বাইরে যাওয়া যায়। যেমন—ফরজ গোসলের জন্য বের হওয়া ইত্যাদি। আর স্বাভাবিক প্রয়োজনেও বের হওয়া যায়। যেমন—পেশাব-পায়খানার জন্য বের হওয়া, খাদ্য-খাবার এনে দেওয়ার লোক না থাকলে খাওয়ার জন্য বের হওয়া ইত্যাদি।
যে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া হবে সে কাজ সমাপ্ত করার পর সত্বর ফিরে আসতে হবে। বিনা প্রয়োজনে কারো সঙ্গে কথা বলবে না। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে থাকাবস্থায় আমার দিকে মাথা বাড়িয়ে দিতেন আর আমি তা আঁচড়িয়ে দিতাম এবং তিনি যখন ইতিকাফে থাকতেন, তখন (প্রাকৃতিক) প্রয়োজন ছাড়া ঘরে প্রবেশ করতেন না। (বুখারি, হাদিস : ১৯০২)
সম্পর্কিত খবর

প্রশ্ন-উত্তর
ঋণ দেওয়া টাকার কি জাকাত দিতে হবে?
ইসলামী জীবন ডেস্ক

প্রশ্ন : আমি একজনকে পাঁচ লাখ টাকা ধার দিয়েছি এই চুক্তিতে যে তিনি তা দুই বছর পর পরিশোধ করবেন। আমাকে কি এই টাকার জাকাত দিতে হবে?
—ইহসাক, মাদারীপুর
উত্তর : নগদ টাকা ঋণ দিলে ওই টাকা নিসাব পরিমাণ হলে ঋণদাতাকে ওই টাকার জাকাত আদায় করতে হবে। ঋণের টাকা হাতে আসার পর বিগত বছরগুলোর জাকাত একসঙ্গে আদায় করবে। তবে টাকা হাতে আসার আগে আদায় করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে।
(বাদায়েউস সানায়ে : ২/১০, আল বাহরুর রায়েক : ২/২০৭, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৫/২৭১)
সমাধান : ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা

নতুন টাকা কেনাবেচা কি জায়েজ?
অনলাইন ডেস্ক

এসেছে ঈদ। আনন্দ আর সুখময়তায় মুখর হবে পরিবেশ। যারা রোজা রেখেছে তাদের আনন্দ সবচেয়ে বেশি। তারা দয়াময় আল্লাহর থেকে ঈদের দিন আজর বা প্রতিদান পাবেন।
ইসলামী আইন ও ফেকাহশাস্ত্রবিদরা এটাকে নাজায়েজই বলেছেন। ইসলামে এক প্রকারের দুটি জিনিস কমবেশি ক্রয়-বিক্রয় করা নাজায়েজ। কারণ, এ রকম লেনদেনে অতিরিক্ত অংশ সুদ হয়ে যায়।
তাই আলেমরা, একে সুদি কারবারের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেন। এ ধরনের ব্যবসায় জড়িত হওয়া কোনোভাবেই জায়েজ হবে না। কারণ টাকা বা কাগজের নোট পণ্য নয়, বরং এটি মূল্য, তাই এ নিয়ে ব্যবসা করার অনুমোদন নেই ইসলামে।
তবে অনেক উলামায়ে কেরাম নতুন টাকা সংগ্রহের একটা পদ্ধতিকে জায়েজ বলেন অপারগতার ক্ষেত্রে। একেবারে অপারগতার ক্ষেত্রে নতুন টাকা সংগ্রহ করার পরিশ্রম বাবদ কিছু টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
দেশি মুদ্রা একই প্রকারের হওয়ায় পরস্পর কমবেশিতে বেচাকেনা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। অতিরিক্ত অংশ সুদ হিসেবে গণ্য হবে। (আদদুররুল মুখতার ৫/১৭১-১৭২, বুহুসুন ফি কাজায়া ফিকহিয়্যা ১/১৬৩)

রমজানের শেষ মুহূর্তে আল্লাহর ডাক, আপনি কি প্রস্তুত
আইয়ূব হুসাইন

রমজান বিদায়ের পথে, সময়ের চাকা দ্রুত ঘুরে চলছে। কিন্তু এখনো আপনার জন্য দুয়ার খোলা। হয়তো আপনি এখনো গভীরভাবে রমজানের মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারেননি, ইবাদতে একাগ্রতা খুঁজে পাননি, অন্তরে প্রশান্তির পরশ লাগেনি। চারপাশে মানুষ ইবাদতে মশগুল, কেউ কোরআন তিলাওয়াতে রত, কেউ লাইলাতুল কদরের সন্ধানে রাত জাগরণে মগ্ন।
অথচ আপনার হৃদয় যেন শূন্য, আবেগহীন, কাঠিন্যে মোড়ানো! তবে সুখবর হলো—আল্লাহর রহমত এতটাই বিশাল যে তিনি মুহূর্তের মধ্যে আপনার অবস্থান বদলে দিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।
এই আয়াত কি যথেষ্ট নয় আমাদের জন্য—যেখানে মহান রব নিজেই ডাকছেন, ‘তোমরা নিরাশ হয়ো না!’ তাহলে আমরা কেন তার রহমত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব?
লাইলাতুল কদর—এক রাতের ইবাদতে ৮৪ বছরের সওয়াব
এখন রমজানের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ রাতগুলো পার হচ্ছে। হতে পারে, এটাই লাইলাতুল কদর! যে রাত সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন : ‘নিশ্চয়ই আমি কদরের রাতে কোরআন নাজিল করেছি। আর তুমি কী জানো কদরের রাত কী? কদরের রাত হলো এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম!’ (সুরা : আল-কদর, আয়াত : ১-৩)
ভাবুন, এই রাতে যদি আপনি নফল নামাজ পড়েন, একটি তাসবিহ বলেন, একটি দোয়া করেন—আপনার আমলনামায় ৮৪ বছরের ইবাদতের সওয়াব লেখা হবে! এমন সুবর্ণ সুযোগ আর কোথায় পাওয়া যাবে?
তাওবার দরজা এখনো খোলা
হয়তো আপনি ভাবছেন—‘আমি অনেক গুনাহ করে ফেলেছি, আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবেন?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—‘যে ব্যক্তি অন্তর থেকে খাঁটি মনে তাওবা করে, আল্লাহ তার গুনাহ এমনভাবে মাফ করে দেন, যেন সে কখনো সেই পাপ করেনি।’ (ইবন মাজাহ, হাদিস : ৪২৫০)
সুতরাং, আপনি যতই পাপ করে থাকুন না কেন, এই মুহূর্তে যদি আল্লাহর দরবারে ফিরে আসেন, তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন।
শেষ সময়ে বিজয়ীর মতো ছুটুন
আমাদের পূর্বসূরিরা রমজানের শেষ দশকে নিজেদের আরো বেশি ইবাদতে ডুবিয়ে দিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) যখন রমাদানের শেষ দশকে প্রবেশ করতেন, তখন তিনি রাত জাগতেন, পরিবারের সবাইকে জাগাতেন এবং ইবাদতে অধিক মনোযোগী হতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৪)
আমরা কি সেই সুন্নাহকে অনুসরণ করব না?
এখনো সময় আছে—আল্লাহর কাছে ফিরে যান। অনেকেই মনে করেন, ‘আরেকটা বছর আসবে, তখন ভালোভাবে ইবাদত করব।’ কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি আরেকটি রমজান পাবেন?
রাসুল (সা.) বলেছেন : ‘সুযোগ থাকতেই পাঁচটি জিনিসকে গ্রহণ করো—(১) বৃদ্ধ হওয়ার আগে তোমার যৌবনকে, (২) অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে, (৩) দরিদ্র হওয়ার আগে তোমার সম্পদকে, (৪) ব্যস্ত হওয়ার আগে তোমার অবসরকে, (৫) মৃত্যুর আগে তোমার জীবনকে।
এখনো সময় আছে! আল্লাহর দিকে ফিরে যান, তাহাজ্জুদের মিহরাবে দাঁড়ান, হাত তুলে দোয়া করুন, অশ্রু ঝরান, কোরআনে মনোযোগ দিন।
এই রমজান হতে পারে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ রমজান
রমজান শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই শেষ সময়ে আপনি যে আমল করবেন, সেটাই হতে পারে আপনার জান্নাতের চাবিকাঠি। হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি শেষ সময়ে ভালো আমল নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, সে ভালো পরিণতি লাভ করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৪১)
এখনো সময় আছে—নিজেকে বদলানোর, আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার, কদরের রাতের সর্বোচ্চ ফায়দা নেওয়ার।
উঠুন, ফিরে আসুন! রমজান চলে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার সুযোগ এখনো শেষ হয়নি। ইতিহাসে অনেক মানুষ জীবনের শেষ সময়ে আমল বাড়িয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আপনি কি সেই তালিকায় থাকতে চান না?
আল্লাহ আপনাকে ডাকছেন। আপনি কি সাড়া দেবেন?

কোরআন থেকে শিক্ষা
দ্বিন পালনে অনীহা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়
ইসলামী জীবন ডেস্ক

আয়াতের অর্থ : ‘আমি সুস্পষ্ট নিদর্শন অবতীর্ণ করেছি, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করেন। তারা বলে, আমরা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান আনলাম এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করলাম। কিন্তু তারপর তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়; বস্তুত তারা মুমিন নয়... যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৪৬-৫২)
আয়াতগুলোতে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. কোরআন অনুধাবনের জন্য ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা যথেষ্ট নয়, এ জন্য আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ আবশ্যক।
২. যারা মুখে নিজেকে মুসলিম দাবি করে কিন্তু অন্তরে কুফরি বিশ্বাস ও মতবাদ লালন করে কোরআনের ভাষায় তারা মুমিন নয়।
৩. নিফাকের একটি প্রমাণ হলো যাপিত জীবনে দ্বিন পালনে অনীহা এবং মানবজীবনের যেকোনো স্তরে শরিয়তের বিধান ও সমাধান গ্রহণে অস্বীকৃতি।
৪. দ্বিন-শরিয়তের ওপর অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া এবং কোনো কিছুকে ইসলামের চেয়ে উত্তম মনে করা নিফাকের নিদর্শন।
৫. মুসলিম শাসক যদি দ্বিন ও শরিয়তের বিরুদ্ধাচরণ না করে তবে তার আনুগত্য করা উচিত এবং অবাধ্য হওয়া অনুচিত। তারা আল্লাহর অবাধ্য হলে তাদেরও অবাধ্য হওয়া যাবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪৬-৫২)