আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে হাবিব) আমি আপনাকে জগৎসমূহের প্রতি একমাত্র রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আল্লাহ ঈমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের মাধ্য, তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)
প্রিয় রাসুল (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় পবিত্র মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের হাশেমি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকরা তাঁর জন্ম ‘হাতির বছর’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
রাসুল (সা.) এর শুভাগমনের আগে বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলোকে বলা হয় ‘ইরহাস’। ইরহাস অর্থ হলো বুনিয়াদ বা ভিত্তি। রাসুলে পাক (সা.)-এর নবুয়ত প্রকাশের আগে সাধারণ বিবেকবহির্ভূত ঘটনাগুলোকেই ইরহাস বলা হয়ে থাকে।
রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের ৫০ অথবা ৫৫ দিন আগের একটি ঘটনা হলো আসহাবে ফিল বা হাতির ঘটনা। পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবাঘর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অত্যন্ত বরকতমণ্ডিত ও মর্যাদাপূর্ণ একটি নিদর্শন।
আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশির পক্ষ থেকে আবরাহা নামক এক ব্যক্তি ইয়ামেনের শাসক ছিল। সে দেখল প্রিয় নবী (সা.)-এর আম্মাজান যখন তাঁকে গর্ভে ধারণ করলেন তখন অগণিত আশ্চর্য ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল। এমনকি ৯ মাস পূর্ণ গর্ভকালীন তিনি কোনো কষ্ট অনুভব করেননি। মাতৃগর্ভে থাকাকালে মা আমিনা অনেক শুভ স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নযোগে তাঁকে নবীপাক (সা.)-এর পবিত্র নাম মুবারক বলে দেওয়া হয়। এমনকি এও বলা হয় যে হে আমিনা, তোমার গর্ভে আমানত আছেন দুই জাহানের সরদার ও সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
বহুদিন ধরে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি ও খাদ্যাভাবে আরবের সর্বত্রই হাহাকার চলছিল। নবীজি (সা.)-এর বরকতময় জন্মের বছর আরবের গাছপালা ফলে-ফুলে, পত্র-পল্লবে ভরপুর হয়ে ওঠে। দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে আরবে এক শুভ দিগন্তের সূচনা হয়। আরবের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে থাকে। যেহেতু এ বছর কুরাইশরা আবরাহার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল এবং দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল, তাই নবীজি (সা.)-এর শুভজন্মের এ বছরকে তারা ‘সানাতুল ফাতহ ওয়াল ইবতিহাজ’ (বিজয় ও আনন্দের বছর) হিসেবে নামকরণ করেছিল।
ফাতিমা বিনতে আবদিল্লাহ (রা.) বলেন, যখন প্রিয় নবীজি (সা.)-এর শুভ আগমন ঘটল, তখন আমি আমিনার কাছে উপস্থিত ছিলাম। আমি দেখলাম সব গৃহ উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেছে এবং এও দেখলাম, আসমানের তারকারাজি এত কাছে এসেছে যে আমার মনে হলো এই তারকা আমার ওপর পতিত হবে। (ফাতহুল বারি, ৬/৪২৬)
আমিনা আরো বলেন, আল্লাহ তাআলা ওই সময়ে আমার চোখের পর্দা উঠিয়ে নেন আমি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্ত দেখতে পেলাম।
ইরবাস ইবনে সারিয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্ম গ্রহণকালীন তাঁর সময়ে তাঁর মাতা এক নুর দেখেন, যাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়। (ইমাম হাকেম, আল মুসতাদরাক, মেশকাত-৫৭৫৯)
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি তোমাদের আমার প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে বলছি। আমি হলাম ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া ও ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ। আর আমার মায়ের স্বপ্ন, যা তিনি আমাকে প্রসব করার সময় দেখেছিলেন যে এমন এক নুর উদ্ভাসিত হয়েছে, যার দ্বারা আমার আম্মাজানের জন্য সিরিয়ার প্রাসাদও উজ্জ্বল হয়েছিল। (ইমাম বায়হাকি, দালায়েলুন নবুয়ত, পৃষ্ঠা ৩৫)
রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের সময় আশ্চর্য ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে হাসসান বিন সাবেত (রা.) বলেন, আমি সাত বা আট বছরের শিশু ছিলাম, আমি যা দেখতাম এবং শুনতাম তা অনুধাবন করতে পারতাম। একদিন সকালে এক ইহুদি চিৎকার করে বলতে লাগল, হে ইহুদি সম্প্রদায়, তোমাদের জন্য ধ্বংসের কথা হলো যে আহমদ এর তারকা উদিত হয়েছে, আজ রাতেই তার শুভাগমন ঘটেছে।
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মক্কা শরিফে এক ইহুদি বাস করত। যে রাতে প্রিয় রাসুল (সা.) তাশরিফ এনেছিলেন তখন সে বলল, হে কুরাইশ দল, আজ রাতে কি তোমাদের কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করেছে? তারা বলল, আমাদের জানা নেই। তখন সে বলল, দেখো, আজ এই উম্মতের নবী তাশরিফ এনেছেন। যাঁর দুই স্কন্দের মাঝে নবুয়তের চিহ্ন রয়েছে। তিনি দুই রাত পর্যন্ত দুধ পান করবেন না। লোকজন দ্রুত ওই সভা থেকে উঠে অনুসন্ধান শুরু করল। জানা গেল যে আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। ইহুদি বলল, তোমরা আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাও। ইহুদি তার দুই বাহুর মাঝখানে ওই মোহরে নবুয়ত চিহ্ন দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। জ্ঞান ফিরে আসার পর সে বলল, নবুয়ত বনি ইসরাঈল থেকে চলে গেছে। হে কুরাইশ সম্প্রদায়, শোনো, এই নবীর অসিলায় তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে তাঁর শুভাগমনের সংবাদ পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়েছে। (ইমাম হাকেম, আল মুস্তাদরাক, হাদিস : ৪১৭৭)
প্রিয় নবী (সা.)-এর পূর্বপুরুষরা আপন সময়ের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, বিজ্ঞ ও সম্ভ্রান্ত ছিলেন। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর দাদা, আব্দুল মুত্তালিবের অসিলা নিয়ে আরবের লোকেরা আল্লাহর কাছে দোয়াও করত। ইমাম শিহাব উদ্দিন কাস্তালানি (রহ.) বলেন, কুরাইশ গোত্রে যখন দুর্ভিক্ষ নেমে আসত তারা আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে ছবির পাহাড়ে নিয়ে যেত। তার উসিলা নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করত এবং বৃষ্টির জন্য দোয়া করত। (আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১/৮৮)
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা)
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ