দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপ পোলট্রি খাতে আরো বড় বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। বাজারে ডিম ও মুরগির মাংসের চাহিদা ক্রমে বাড়ার প্রেক্ষাপটে সম্ভাবনাময় এ খাতে ২০২৭ সালের মধ্যে আরো ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে গ্রুপটি।
গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির লেয়ার ফার্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পোলট্রি খাতে প্রবেশ করে প্রাণ। শুরুতে প্রতিদিন এক লাখ পিস ডিম উৎপাদন করলেও এখন সেই সক্ষমতা পাঁচ লাখ পিসে দাঁড়িয়েছে।
দেশে প্রথম অটোমেটেড এবং স্বয়ংক্রিয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এ কারখানাটি গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে প্রাণের নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরাই প্রথম ইউরোপিয়ান প্রযুক্তির সম্পূর্ণ অটোমেটেড ‘এনভায়রনমেন্টাল কন্ট্রোল হাউস’ প্রযুক্তির ডিমের কারখানা স্থাপন করেছি। আগামীতে যে কারখানাগুলো হবে সেগুলোও সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত। পণ্য পরিবহনের আগ পর্যন্ত হাতের কোনো স্পর্শ নেই।
নেই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারও। ব্যবহার করা হচ্ছে মানসমৃদ্ধ খাবার। এর ফলে সহজেই সর্বোচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ ডিম উৎপাদন করা যাচ্ছে। কারখানার ভেতরে মানব স্পর্শ না থাকা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার না হওয়ায় মুরগির রোগবালাই হওয়ার ঝুঁকি তেমন থাকে না। এতে উৎপাদন সক্ষমতার হার সারা বছর প্রায় একই থাকে এবং এটি অনেকটা ব্যয়সাশ্রয়ী।
তিনি বলেন, প্রচলিত খামারগুলোতে গরম কিংবা খুব শীতের সময় ডিম উৎপাদন কমে যায়। এর প্রধান কারণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় মুরগি মারা যাওয়া। এর ফলে বাজারে ডিমের জোগান কমে যায়। ডিমের দামও বাড়ে।
তাই এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় খামার বেশি গড়ে তুলতে পারলে ডিমের উৎপাদন হার সারা বছর স্বাভাবিক রাখা যাবে।
ডিমকে বলা হয় সহজলভ্য প্রোটিন এবং সুপার ফুড। দিন দিন মানুষের ডিম খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে ২০২০ সালে মাথাপিছু বার্ষিক ডিমের ব্যবহার ছিল ১০৪টি। বর্তমানে তা প্রায় ১৩৫টি। ২০৩০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৬০টি। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্পে ডিমের ব্যবহার বেশ বেড়েছে। এতে এ খাতের বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘নেয়াখালী, শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে আমরা আরো চারটি সর্বাধুনিক লেয়ার ফার্ম তৈরির জন্য বিনিয়োগ করতে যাচ্ছি। ২০২৭ সালের মধ্যে এসব কারখানা চালু হলে প্রতিদিন আরো ২০ লাখ পিস ডিম উৎপাদন করা যাবে। এখন জমি ক্রয়ের বিষয়ে কাজ চলছে। নতুন চারটি কারখানা নির্মাণের জন্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এতে ক্রমবর্ধমান ডিমের চাহিদা পূরণে প্রাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
ডিমের পাশাপাশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে ব্রিডার ফার্ম ও ব্রয়লার ফার্ম নির্মাণে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে প্রাণ। চলতি বছরেই ব্রিডার ফার্মে বাচ্চা উৎপাদন এবং আগামী বছর ব্রয়লার ফার্মের কাজ শুরু হবে। ফার্ম দুটিতে আরো ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে।
প্রাণের চিফ অপারেটিং অফিসার (লাইভস্টক) মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা ব্রয়লার মুরগি লালন-পালনের জন্য একটি বড় খামার গড়ে তুলব। পাশাপাশি বাচ্চা উৎপাদনের জন্য একটি অত্যাধুনিক মানের ব্রিডার ফার্ম গড়ে তুলতে কাজ করছি। এ জন্য যন্ত্রপাতি আনার কাজ চলমান। এটি করতে পারলে আমরা এ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারব। এ খাতে প্রায় দুই হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত ডিম থেকে আমরা সর্বোচ্চ মানের প্রোটিন পাচ্ছি কি না কিংবা পণ্যটি অ্যান্টিবায়োটিক ও হেভি মেটালমুক্ত কি না সেটি নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য, নিরাপদ ডিম ও মুরগি মানুষের হাতে তুলে দেওয়া।’
প্রাণ অ্যাগ্রো বিজনেসের নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ বলেন, ‘করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে পণ্যের দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখছে বলে কথিত রয়েছে। বাজারে বর্তমানে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা প্রায় সাড়ে চার কোটি পিস। উৎপাদনও হচ্ছে একই পরিমাণ ডিম। কিন্তু সব সময় উৎপাদন স্বাভাবিক না থাকা ও কিছু কিছু সময় ডিমের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি হওয়া বাজার অস্থিরতার কারণ।’
তিনি বলেন, ‘বাজারে চাহিদার সঙ্গে জোগানের তারতম্য হলেই পণ্যের দাম বাড়বে। দেশে পোলট্রি খাতে উৎপাদনে প্রভাব পড়ার প্রধান কারণ তাপমাত্রা। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে প্রচলিত ফার্মে প্রচুর মুরগি মারা যাওয়ায় ডিমের উৎপাদন ও ব্রয়লার উৎপাদন কমে যায়। যার প্রভাব বাজারে পড়ে। তাই স্বয়ংক্রিয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির লেয়ার ও ব্রয়লার ফার্ম তৈরি করা গেলে সে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’