উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ। তাই আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি মনে করে, ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ করা উচিত। একই সঙ্গে সংস্থাটি দাবি করেছে, এ সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঠিক হবে না।
এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। গতকাল রবিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও গবেষক মুনতাসীর কামাল অংশ নেন।
বর্তমান ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের ওপর ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ হারে কর বসে। প্রথম সাড়ে তিন লাখ টাকার ওপর কর নেই। পরের প্রথম এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, পরবর্তী চার লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ এবং বাকি অর্থের ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর বসবে।
এ ছাড়া মহিলা করদাতা এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা হলো চার লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা এবং প্রতিবন্ধী স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা হবে পৌনে পাঁচ লাখ টাকা। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা হবে। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পিতা-মাতা বা আইনানুগ অভিভাবকের প্রত্যেক সন্তান বা পোষ্যর জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা আরো ৫০ হাজার টাকা বেশি হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল।
খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এ ছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো যৌক্তিক বলে আমরা মনে করি। আগামী অর্থবছর এটি বাড়িয়ে চার লাখ টাকা নির্ধারণ করা উচিত। চলতি বাজেটে যা রয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা।’
তিনি বলেন, অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে, তবে গ্যাসের দামের যে প্রস্তাব আছে, সেটা যদি অনুমোদিত হয় তবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যাবে। বৈশ্বিক শুল্ক যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতির ধারা বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন শেষে মূল্যস্ফীতির হার ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনার যে পরিকল্পনার কথা বলেছে, সেটি অর্জন করা কঠিন হবে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক পুনুরুদ্ধারকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। নতুন বাজেটে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের পাশাপাশি অর্থনীতিকে কিভাবে স্থিতিশীল করা যায়, তার জন্য মধ্যমেয়াদি সংস্কারের কিছু ভিত্তি স্থাপন করা প্রয়োজন বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের আর্থিক সংকটের ‘দুষ্টচক্র’ ভাঙা, এনবিআরের সংস্কার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, চ্যালেঞ্জপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট প্রণয়ন করবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব সংগ্রহে স্থবিরতা, ব্যাংকিং খাতে তারল্যসংকটসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকট সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব। ২০২৬ অর্থবছরের বাজেট এমন একটি সময়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে যখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এটি মোকাবেলায় দুরদর্শী ও সমন্বিত নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মুদ্রানীতির স্থিতিশীলতা আনয়ন নীতিনির্ধারকদের অন্যতম কাজ। এটি অর্জনের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনেকে মনে করছেন, এর কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে বা চায়নার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ২০১৬-এর পর চায়নার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি কিন্তু কমে গেছে, যা এই বছর আবার বেড়েছে। তাই এর কারণে সরাসরি আমাদের কোনো উপকার হবে, এটা আমি মনে করি না।’
তিনি আরো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের ৯৩ শতাংশ রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক। যুক্তরাষ্ট্রে যে তৈরি পোশাক চায়না রপ্তানি করে, তার বেশির ভাগই হচ্ছে মেনমেইড ফাইবার তথা নন-কটন। কিন্তু বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে তার মোটামুটি পুরোটাই হচ্ছে কটনভিত্তিক। তৈরি পোশাকের মধ্যে যে বৈচিত্র্য সেটিকে মাথায় রাখতে হবে।
এ ছাড়া ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বাড়তি শুল্ক বসানোর যে নীতি গ্রহণ করেছে, এতে বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। বরং বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ ‘সীমিত ও স্থিমিত’ হওয়ার শঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন তিনি।