সব বাধা ডিঙিয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নবযাত্রা শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কখনোই তাঁর চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং বরাবরই তাঁর পথে পাথর বিছানো ছিল। সংগ্রাম করে করেই তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনিশ্চিত সেই পথ।
সব বাধা ডিঙিয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নবযাত্রা শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কখনোই তাঁর চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং বরাবরই তাঁর পথে পাথর বিছানো ছিল। সংগ্রাম করে করেই তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনিশ্চিত সেই পথ।
প্রতিবার নির্বাচন আসে।
সংক্ষেপে বলা যায়, গত ১৫ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভাবনীয় সব পরিবর্তন এসেছে। প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। কৃষির প্রবৃদ্ধির কারণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা গেছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, কোটিখানেক পরিবারের জন্য সুলভে খাদ্য সরবরাহের কার্ড, খোলাবাজারে ট্রাকে কম দামে খাদ্য বিক্রি, গৃহহীনদের গৃহদান, বিনা মূল্যে বই প্রদান এবং সর্বোপরি এই সময়টায় প্রায় তিন কোটি মানুষকে দারিদ্র্যরেখার ওপরে টেনে তোলার মতো সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বাংলাদেশ। এটা সম্ভব হয়েছে ধারাবাহিকভাবে সরকারের পরিবর্তনের ফলে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে রপ্তানিশিল্পের উপর্যুপরি উন্নতি, প্রবাস আয় বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও জাইকার মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে নিয়মিত সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করার মতো নীতি সফলতার কারণে। তবে প্রায় দুই বছর ধরে সাফল্যের এই ধারা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলতে চেয়েছে অপরিণামদর্শী বিরোধী শক্তিগুলো। বিদেশিদেরও মদদ ছিল এর পেছনে। তবে খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে এসব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
এমনই এক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি যুগোপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে নির্বাচনটি সম্পন্ন করেছেন। এই ইশতেহারে এই মুহূর্তের জনগুরুত্বপূর্ণ সংকট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে তরুণদের মনের দাবি আরো বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা। সক্ষম জনশক্তি তৈরির অঙ্গীকারও বেশ স্পষ্ট ছিল ইশতেহারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলার্যান্সের কথা বলেও এই নির্বাচনী ইশতেহার তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। এসব অঙ্গীকার পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েই নির্বাচনে অংশ নেয় ক্ষমতাসীন দল। বিরোধী দলগুলো অংশ নিলে তারাও নিশ্চয়ই তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করত। যে কারণেই হোক, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনে যোগ না দেওয়ায় দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ বেশ হতাশই হয়েছে বলা চলে।
ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাটি সচল রেখেছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় নতুন সরকার শপথ নিয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে এরই মধ্যে নতুন সরকার কাজ শুরু করেছে। নিঃসন্দেহে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছাড়াও এই সরকারের সামনে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এখনো সক্রিয়। এর বাইরেও আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার ও রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার মতো বাড়তি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। আর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি তো আছেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন, সাহসের সঙ্গে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে করেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তাঁর এই বিশ্বাসের ভিত্তি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশের উন্নয়নের অসামান্য গল্প। ১৫ বছর আগেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭০০ ডলারের মতো। আজ তা এর চার গুণেরও বেশি। তখন মোট অর্থনীতির আকার ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলার। আজ তা ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, অর্থাৎ পাঁচ গুণের বেশি। একইভাবে এই সময়টায় জীবনের গড় আয়ু বেড়েছে চার বছরেরও বেশি। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এই সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অর্জন চোখে পড়ার মতো। অবশ্য হালের বছরগুলোতে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে বেশ খানিকটা টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। তবে যেমনটি নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছেন, ঠিক তেমনি করে নতুন সরকারের নেতৃত্বে থাকা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাহসের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির এসব চ্যালেঞ্জ মেকাবেলা করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। আমার বিশ্বাস, ‘তিমির হননের’ এই নেত্রী ঠিকই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন সমৃদ্ধির পথ ধরে। এবারের পথচলায়ও মানুষের জীবনের মানোন্নয়নই থাকবে তাঁর উন্নয়ন কৌশলের মূলকথা। মূল্যস্ফীতি যে মানুষের জীবনকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে, সে কথাটি তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। তাইতো সমস্যাটিকে বাগে আনাকেই তাঁর সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন নির্বাচনী ইশতেহারে। নিশ্চয়ই মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সুসমন্বয় ঘটিয়ে তিনি জনস্বার্থে মূল্যস্ফীতি নামের গরিবের এই শত্রুকে ঠিকই বধ করতে পারবেন। সে জন্য সরবরাহের দিকেও তাঁর সরকার নিশ্চয়ই নজর দেবে। বিশেষ করে কৃষির আধুনিকায়ন ও যন্ত্রায়ণে বিনিয়োগ বাড়িয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠিকই বাগে আনতে পারবে। এ ছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারে যে ১১টি অগ্রাধিকার ঠিক করেছেন, সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নয়া মাইলফলক স্থাপন করবেন। কেননা তিনি যে বঙ্গবন্ধুকন্যা, বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই যে তিনি হাঁটছেন। তাইতো নেতৃত্বের পরম্পরায় উদ্ভাসিত আজকের বাংলাদেশ। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে নিরন্তর ‘চিত্তের সম্বন্ধ’ স্থাপন করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
তাঁর দেশপ্রেম, সাহস ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাকে সক্রিয় চালিকাশক্তির জোরে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে। কবীর চৌধুরী তাঁর এক লেখায় লিখেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার ওপর বিধাতার বিশেষ করুণা ও আশীর্বাদ আছে।’ সেই আশীর্বাদের জোরেই ভয়কে জয় করে এগিয়ে যাবেন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অদম্য সাহসী এই নেত্রীকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
সম্পর্কিত খবর
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা নেই। এটিও গতানুগতিক ধারায় চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন প্ল্যান অনুযায়ী বরাদ্দ দিলেও তারা খরচ করতে পারে না। এর ফলে দফায় দফায় বাড়ে প্রকল্পের খরচ ও মেয়াদ, যার কারণে প্রতিবছরই মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম বাস্তবায়ন হয়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক অতিরিক্ত সচিব জানান, চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে প্রায় অর্ধলক্ষ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হচ্ছে।
আইএমইডির সর্বশেষ এডিপি বাস্তবায়নের তথ্যে দেখা যায়, ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ১৭.৯৭ শতাংশ। এর চেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য সংস্থাটির ওয়েবসাইটে নেই। সেই আলোকে গত এক যুগে এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে ছয় মাসে ৫০ হাজার দুই কোটি টাকা অর্থছাড় হয়েছে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে ৬১ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা ছাড় হয়েছিল এই সময়ে। শুধু গত ডিসেম্বর মাসে অর্থছাড় হয়েছে ১৫ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরের ডিসেম্বর মাসে ছাড় হয়েছিল ১৪ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।
এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আগের সরকারের সময়ে নেওয়া চলমান সব প্রকল্পই সরকার পর্যালোচনা করেছে। অগুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অনেক প্রকল্প বা স্কিম বাদ যাচ্ছে। এতে অর্থ ব্যয়ের চাহিদা কমেছে। আবার জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক চলে গেছেন। অনেক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়নের হারও কমে গেছে। অনেক দেশি ঠিকাদারও প্রকল্প এলাকায় এখনো ফিরে আসেননি। একইভাবে বৈদেশিক অর্থায়নের অনেক প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার অনুপস্থিত রয়েছেন। এই বাস্তবতায় এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে বলে জানান তাঁরা।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাস্তবায়ন গতি কম থাকায় সরকারি তহবিলের চাহিদাও অনেক কমেছে। সাধারণত অন্যান্য অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিল থেকে চাহিদা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এডিপিতে যে পরিমাণ সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়েছে, চাহিদা তার চেয়ে কম রয়েছে। তবে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে চলতি অর্থবছরে চাহিদার চেয়ে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে ৭০-৭৫ হাজার কোটি টাকা চাহিদা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যবহারের গুরুত্ব দেওয়ায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮১ হাজার কোটি টাকার সিলিং দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালকদের কখন কোন কাজ করতে হবে সেই পরিকল্পনা দেওয়া থাকে। কিন্তু সে অনুযায়ী তাঁরা সময়মতো কাজ করতে পারেন না। বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। প্রকল্প বাস্তবায়নে এটি প্রথম বাধা। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, যাঁরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, সেই প্রকল্প পরিচালকদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তৃতীয়ত, প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও তাঁদের কারিগরি জ্ঞান খুবই সীমিত।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রকল্পের কাটছাঁটে টাকা বাঁচে ঠিক। তবে সরকারি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হলে রাজস্ব আয় হয় না। আবার মানুষেরও কাজের সুযোগ কমে যায়। এগুলো আবার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। এদিকে সরকারকে ‘ট্রেড অফ’ করতে হবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে কমছে সাধারণ মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান। এর অন্যতম কারণ ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং উৎপাদন হ্রাস। সুদের হার বাড়ার কারণে আমানতকারীরা কিছুটা লাভবান হলেও ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। একদিকে উচ্চ সুদ দিতে চেয়েও আমানত পাচ্ছে না ব্যাংক, অন্যদিকে ঋণসংকটে পড়ছে বেসরকারি খাত।
মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ব্যাংকঋণের সুদের হার ক্রমাগতভাবে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর একমাত্র উপাদান সুদহার বৃদ্ধি নয়; আরো অনেক উপায় রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বা রেপো রেট আরো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদ।
দফায় দফায় ঋণের সুদহার বাড়ানোয় চরম সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাত। ফলে ব্যবসা প্রসারসহ থমকে রয়েছে বিনিয়োগ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান অস্থিরতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমনিতেই ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বেশি সুদ দিয়ে আসছিল। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ীসমাজ। কোথায় কত টাকা খরচ হবে এবং কতটা মুনাফা হতে পারে, সেটা হিসাব করে আমরা বিনিয়োগ করি। কিন্তু মাঝপথে যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে।’
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আর অর্থনীতির ধীরগতিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি কমে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমেছে। নভেম্বরে এই হার দাঁড়িয়েছে ৭.৬৬ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে কভিড মহামারির মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭.৫৫ শতাংশে নেমেছিল।
সরকার পতনের পর নতুন নতুন নীতিমালা, শ্রমিক অসন্তোষ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনীতিকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মামলায় আসামি করা, মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতিসহ নানা কারণে বিনিয়োগে নিম্নমুখী প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছিল।
সূত্র জানায়, সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পথে হাঁটছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও। এবার ১০০ বেসিস পয়েন্ট বা ১ শতাংশ সুদ বাড়ানো হতে পারে। বিষয়টি আগাম আঁচ করতে পেরে ব্যবসায়ী নেতারা গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে বিদ্যমান সুদহার কমাতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
দেশের কর্মে নিয়োজিত বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ( বিবিএস)। সেখানে বলা হয়, কৃষি, সেবা ও শিল্প—সব খাতেই কমেছে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। নারীর চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেশি বেড়েছে।
গেল বছরের শুরুতে দেশে বেকারের সংখ্যা কম থাকলেও বছর শেষে ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যা বেড়েছে। মূলত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের প্রভাবে বছরের শেষ সময়ে বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। বর্তমানে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার।
দেশের রাজনীতির অনিশ্চয়তা ভর করেছে দেশের অর্থনীতিতে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আস্থাহীনতায় ব্যবসা-বিনিয়োগে ভাটা। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ।
অর্থবছরের মাঝপথে চলতি বছরের শুরুতেই আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে অধ্যাদেশ জারি করে অর্ধশতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে নামে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ভোক্তারা।
ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে গদিছাড়া হলেও তাদের রেখে যাওয়া টার্গেট অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না। বরং রাজস্ব আয় বড় ধরনের ঘাটতির পথে। অর্থবছরের ছয় মাসেই রাজস্ব আয়ে টানাটানি চলছে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। বাড়তি এই টাকা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা সংকটে রাজস্ব আদায়ে ধস। প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় তৃতীয় কিস্তির টাকা পেতেই এই পদক্ষেপ। যদিও এর ফলে আগে থেকেই অস্থির থাকা বাজার আরো অস্থির হয়েছে। বেড়েছে ভ্যাটের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি পণ্য ও সেবার দাম। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের খেটে খাওয়া কোটি মানুষ।
নতুন বছরে বিস্কুট, ওষুধ, আমদানি করা ফল, ফলের রস, সাবান, সাবানজাতীয় পণ্য, পোশাক কেনাকাটা, মিষ্টি, বেশ কয়েক ধরনের টিস্যু, মোটরগাড়ির গ্যারেজ, রেস্তোরাঁ, এলপি গ্যাসের মতো পণ্যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সিগারেটে আরেক দফা দাম ও কর বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা বা আইএসপির ওপর প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।
পরে আন্দোলনের মুখে রেস্তোরাঁ, মোবাইল ফোন, ওয়ার্কশপ, ওষুধসহ ৯ পণ্য ও সেবার বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। যদিও আন্দোলনের জেরে এই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইএমএফ সরকারকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের শর্ত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে বসেই আমরা নীতি প্রণয়ন করেছি। সরকার তাতে সম্মত হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ থেকেও কিছু সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনের কারণেই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। বিভিন্ন কারণে সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারের মনে হয়েছে যে কয়েকটি পণ্যের ওপর ভ্যাট সমন্বয় করা প্রয়োজন। তখন এই কাজগুলো করা হয়েছে।’
যদিও ব্যবসায়ীদের অভিযোগের তীর এনবিআরের দিকে। এনবিআরের সমালোচনা করে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব সময়ই এনবিআর এ ধরনের কাজগুলো করে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। এসি চেয়ারে বসে যদি তারা একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তাহলে সেটা ব্রিটিশ জমিদারি প্রথার মতোই হয়ে গেল। গণতান্ত্রিক দেশে এটা হওয়ার কথা নয়। আমলাতন্ত্রের কালো থাবা ও চরম অব্যবস্থাপনার কোনো সীমারেখা নেই, তা আবারও স্পষ্ট হলো। এই সরকারকে একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়ার জন্যই এসব করা হয়েছে।’
টাকা জোগাড়ে ভ্যাট বাড়িয়ে পরে আবার চাপের মুখে ভ্যাট কমানোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো ধরনের প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়নি। খুবই তড়িঘড়ি করে এসব করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হলে সেটার যে একটা পুশব্যাক আসবে তা বোঝার জন্য কোনো বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা তো সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করেই বোঝা যায়। এই অর্থবছরেই রাজস্ব আদায় বাড়ানোর একটা চাপ ছিল আইএমএফের পক্ষ থেকে, কিন্তু এখানে আরো নেগোসিয়েশন করা যেত।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনীতি ও অর্থনীতি দুটি বিষয়কে আলাদা করা যাবে না। একটা দেশে যদি রাজনীতি ভালো না হয়, সেই দেশে কখনোই অর্থনীতি ভালো হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি তথা সার্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। সবাই সামনে তাকিয়ে আছে, সামনে যে দেশের রাজনীতির কী হবে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতিতে নতুন করে ভ্যাট ও কর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে ব্যবসায়ীদের ওপরে নতুন করে কোনো বোঝা চাপানোর সুযোগ নেই। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার যে নীতিতে চলছিল সেখান থেকে ভ্যাট আরোপ করা স্ববিরোধী।’
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির দৈন্যদশা কাটাতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকারও। বেসরকারি খাতে নানা সমস্যার কারণে সৃষ্ট সংকটের সঙ্গে আরো নতুন করে যোগ হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে চরম আস্থাহীনতা ও বাড়তি উৎপাদন ব্যয়ের চাপে আছে শিল্প। এতে বরং ঝুঁকি আরো বাড়ছে।
দেশের রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে আরো দুরবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় দিনে দিনে দায়-দেনা ভারী হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকট কাটেনি।
শিল্প খাতে এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। সব মিলিয়ে শিল্প খাতের আকাশে অমানিশার অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু তেমন সুফল দেখা যাচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ও সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিএস বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে কোনো সংশোধিত বাজেট দিতে পারেনি। এটা না থাকার কারণে প্রবৃদ্ধির ধারা কমেছে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমেছে এবং কর্মসংস্থানে সমস্যা রয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধির ধারা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে যাঁরা সংস্কারকে গতিশীল করতে চান তাঁরা ধৈর্যহারা হয়ে যাবেন।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেছেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অসংগত নীতি। প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা ভয়ভীতির মধ্যে থাকে যে ট্যাক্স বাড়ল কি কমল।’ তিনি বলেন, ‘এরপর আছে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউয়ের হয়রানি। যারা ভালো ট্যাক্স দিচ্ছে তাদের আবার দিচ্ছে। পরের বছর আবার অডিট করছে। লজিস্টিক ঘাটতি রয়েছে। সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা পণ্যের ওপর ডেমারেজ দিয়ে, আরবিটারি ট্যাক্স বসিয়ে দিচ্ছে। ফলে যে দামে পণ্য আনছেন তার দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে কস্ট বেড়ে যাচ্ছে। কে দেখছে? কেউ দেখছে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাওয়া উচিত।’
দেশের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে একের পর এক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো। পরিস্থিতি উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ দিলেও সঙ্গে আছে কঠিন শর্ত। এই শর্ত বাস্তবায়নে জনভোগান্তি বাড়ায় বিপাকে পড়েছে সরকার। এর প্রভাবে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ব্যবসা খরচ, টাকার মান কমে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে বরং আরো বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ভোক্তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। তাই এখন শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যয়ের চাপ সামলাতে না পারায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা, পাশাপাশি সাধারণ মানুষও। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা এবং জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরির দাবি করেছেন তাঁরা।
আইএমএফের শর্তের মধ্যে রয়েছে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, টাকার প্রবাহ হ্রাস, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পদক্ষেপ, ভ্যাটের আওতা ও হার বৃদ্ধি, ভর্তুকি কমানো। এসব বাস্তবায়নে গেছে সরকার, যা সংকট আরো ঘনীভূত করেছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনজীবনে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো নিয়মিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কিছু খাত থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে ইতিবাচক পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার শর্ত বাস্তবায়ন না করে দেশের বাস্তবতায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।
আওয়ামী লীগ সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে তিন অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর মুদ্রানীতিকে আরো কঠোর করা হয়েছে। ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে প্রবৃদ্ধি মাত্র দেড় শতাংশে নেমেছে। ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সৃষ্ট অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ, উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা, ডলারের সংকট, গ্যাস ও বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে ঘাটতি—এসব কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমেছে, ফলে ঋণের প্রবাহও কমে গেছে। অথচ কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে। মাত্র ৫ শতাংশ হচ্ছে সরকারি খাতে। ফলে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নতুন সরকার আসার পর প্রথমে ডলারের দাম বাড়িয়ে ১২০ টাকা করে। গত ১ জানুয়ারি থেকে তা আরো বাড়িয়ে ১২২ টাকা করা হয়। কিন্তু ব্যাংকে আমদানির জন্য আগাম ডলার আরো বেশি দামে বেচাকেনা হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। এতে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। টাকার মান কমেছে। এর প্রভাবে অন্য পণ্য ও সেবার দামও বেড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে, ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এদিকে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। এ কারণে আমদানি খাতেও স্থবিরতা বিরাজ করছে।
ব্যবসায়ীরা অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেখা করে ঋণের সুদের হার কমানোর জোর দাবি করেছেন। কারণ বাড়তি সুদের কারণে শিল্পের খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে তাঁরা শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতি আগামী দিনে শিল্পকে আরো ঝুঁকিতে ফেলবে। এটি উত্তরণে সরকারের সহযোগিতা চান তাঁরা।