<p>এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র কিংবা প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের একাত্তর-পূর্ববর্তী রাজনীতির কথা ছেড়ে দিলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীন রাজনীতির পরিণতি কী হয়েছে, তা আমরা বিভিন্ন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই চাক্ষুষ উপলব্ধি করেছি। বিভিন্ন গণ-আন্দোলন কিংবা বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানের ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার পরিবর্তন হলেও গণতন্ত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় না। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে না। দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোও দ্রুত ক্ষমতা লাভের জন্য যতটা তৎপর হয়ে ওঠে, গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা কিংবা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুত পথে ততটা নিষ্ঠাবান হয় না। এতে গণতন্ত্রহীন ক্ষমতার রাজনীতিতে নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অধিকার হরণ ও একদলীয় শাসনের মতো নৈরাজ্য স্বৈরতান্ত্রিক রূপ লাভ করে। সে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর গত পাঁচ দশকে আমরা পদ্ধতিগতভাবে কোনো অর্থবহ ও টেকসই গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই না, যা মূল্যবোধগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে পেরেছে। একবার গণ-আন্দোলন কিংবা সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর কোনো দল ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা পর্যায়ক্রমে মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলোর প্রতি অবহেলা দেখাতে শুরু করে। তাদের কাছে তখন রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা তাকে দীর্ঘস্থায়ী করার বিষয়টিই মুখ্য হয়ে ওঠে, দলীয় কিংবা গণতান্ত্রিক আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা নয়।</p> <p>উপরোল্লিখিত কারণে বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের চিন্তাশীল কিংবা সুধীসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, এবার রাজনীতির একটা নৈতিক সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে গণতান্ত্রিক আদর্শ বাংলাদেশে কোনো দিনই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে না। গণতন্ত্রের নামে বারবার জেঁকে বসবে স্বৈরতন্ত্র। অপশাসন ও অর্থনৈতিক শোষণ-শাসনের বারবারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। রাজপথে সংগ্রামী <img alt="দেশে রাজনীতির নৈতিক সংস্কার প্রয়োজন" height="456" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/08.July/15-08-2024/Untitled-1.jpg" style="float:left" width="500" />ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরবে, অগণিত প্রাণ যাবে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। শ্রমজীবী মানুষের কিংবা ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দীর্ঘদিনের দাবিটি শুধু নেহাত স্লোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা কখনোই কার্যকর হবে না। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কয়েকবারই ক্ষমতারও হাতবদল হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবারই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল কিংবা হস্তান্তরের জন্য গঠিত হয়েছে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচন ডেকে তাদের দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। পাশাপাশি তারা তাদের মেয়াদকালে গণতন্ত্রকে অর্থবহ এবং রাজনীতিকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে বেশ কিছু সংস্কারের কাজেও হাত দিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের গৃহীত সংস্কার প্রস্তাব, ব্যবস্থাদি এবং সুপারিশমালা নির্বাচিত সরকারগুলো শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে খুব কমই বৈধতা দিয়ে থাকে বা গ্রহণ করে থাকে। নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সংসদে তাদের পছন্দমাফিক কিছু সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করে আর বাকিগুলো দীর্ঘ অপেক্ষায় হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গৃহীত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, সেহেতু তারা খুব কমই আলোর মুখ দেখে। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মোটাদাগে শুধু একটি নির্বাচন দিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তর করেই তাদের সাফল্য দেখাতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের অভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা কিংবা রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো দীর্ঘস্থায়ী অবদান রেখে যেতে পারে না।</p> <p>সেসব কারণে বর্তমান সংগ্রামী ছাত্র-জনতা তাদের সদ্যঃসমাপ্ত গণ-অভ্যুত্থানকে রাজনীতিতে কিংবা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রকে অর্থবহ কিংবা ফলপ্রসূ করার জন্য কিছু ভিন্ন পদক্ষেপ নিতে ব্রতী হয়েছে। তারই পথ ধরে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন (অব.) আভাস দিয়েছেন যে তাঁরা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) অবিলম্বে জাতির সামনে একটি ‘পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট’ উপস্থাপন করবেন। দেশের বর্তমান বৈধ (নিবন্ধিত) রাজনৈতিক দলগুলোকে সেভাবে চলতে হবে। দেশে এমন অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যাদের কখনোই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় না। দলে কোনো অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চাই চোখে পড়ে না। সে কারণেই এখন প্রায় সর্বত্রই প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে দলের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই, সেখানে জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রের দাবি কতটুকু কার্যকর হতে পারে। ফলে দলের অভ্যন্তরে নেতাদের কোনো জবাবদিহি থাকে না, স্বেচ্ছাচারিতা ক্রমে ক্রমে স্বৈরতন্ত্রের রূপ লাভ করে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এগুলো কোনোমতেই অবহেলার বিষয় নয়। যেনতেনভাবে ক্ষমতা দখলই যদি মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের কথা বলে লাভ কী? ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত অপশাসন, কর্তৃত্ব বা আধিপত্যবাদ সেখানে পর্যায়ক্রমে তার নিজস্ব স্থান করে নেবে। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কোনো গণতান্ত্রিক ভূমিকাই থাকবে না। এই বিষয়টি দেশের বর্তমান সংগ্রামী ছাত্র-জনতা এবং এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বাণিজ্য প্রশাসনকে সুচারুভাবে পরিচালনা করা। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্য মন্দাবস্থাকে ঠেকানো।</p> <p>এ কথা অনস্বীকার্য যে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে সবেমাত্র মাঠে নেমেছে। তাদের অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে সামনে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা যত কঠিন কিংবা জটিল, সমাধানের উপায়ও ততটাই সময় নিতে পারে। না হলে কিভাবে আমাদের যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে, তা আলোচনা করার আগেই যদি আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য কার্যকাল নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি, তাহলে বর্তমান এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আবশ্যকতা থাকে কোথায়। সদ্যোগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মুক্তভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের অতীত ও তাঁদের কারো কারো ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে টেলিভিশনের টক শোতে যে পরিমাণ সময় ব্যয় করা হচ্ছে, তা কোনো গঠনমূলক কিংবা অর্থবহ আলোচনা নয়। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যরা কেউ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। তাঁরা দেশের বিভিন্ন চিন্তাশীল বিশিষ্ট ব্যক্তি। নিজ নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি ও প্রতিভা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁদের অবাধে কাজ করতে দিতে হবে। তাঁদের কাজের কোনো গঠনমূলক সমালোচনা হবে না, এমন নয়। এটিই গণতন্ত্রের প্রথম অনুশীলন বা পাঠ। সুতরাং সবাইকে এ ক্ষেত্রে কিছুটা ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে, সহনশীল হতে হবে। এই দেশটি সর্বস্তরের জনগণের। এ ক্ষেত্রে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী কিংবা পেশাজীবী এবং এমনকি শ্রমজীবী মানুষের অবদান থাকতে হবে। শুধু রাজনীতিকরাই দেশের সব কিছু নন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা মূলত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেই শুরু হয়ে থাকে। সুতরাং এটিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সমাধান করতে হবে। একমাত্র সে পথেই আমরা একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করতে পারব। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের সর্বস্তরের মানুষের ইস্পাতকঠিন ঐক্য। আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখা।</p> <p>দেশ নির্বাচিত রাজনীতিকদের দ্বারাই পরিচালিত হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়ন, অপশাসন ও অনিয়মের কারণে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে যে জঞ্জাল জমে উঠেছে, তাকে সবাই মিলে অপসারণ করতে হবে। এটি যদি রাজনীতিকদের একার কাজ হতো, তাহলে আজ এই অচলায়তন সৃষ্টি হতো না। সে কারণেই দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার মধ্য থেকে আমাদের রাজনীতি সংস্কারের বৃহত্তর দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সব কিছু মেরামতের। জেগে উঠেছে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়। এ অবস্থায়ও দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিবিপ্লবের গুজব। অভিযোগ আনা হচ্ছে বিভিন্ন গণবিরোধী ষড়যন্ত্র নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে জনগণকে সজাগ থাকতে হবে। জাতীয় স্বার্থে এবং বিশেষ করে গণতন্ত্র, সুশাসন কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এখন আমাদের আবার যুদ্ধকালের মতো একযোগে কাজ করতে হবে। না হলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারানোর আশঙ্কা আরো জোরদার হবে। বিতর্ক ও অনৈক্য আরো বেড়ে যাবে। দেশের প্রয়োজনীয় আইনি, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য যতটুকু সময় যুক্তিগ্রাহ্যভাবে দরকার, সেটি বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে। সেটি টক শো থেকে নির্ধারিত হতে পারে না। দেশের জনগণ যেটিকে আবশ্যক হিসেবে গ্রহণ করবে, সেটিই হবে চূড়ান্ত। তা না হলে এক নতুন ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।</p> <p>লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক</p> <p>gaziulhkhan@gmail.com</p> <p> </p>